Advertisment

মমতার বিরুদ্ধে মুখ কে? বিজেপিতে ছায়া মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল

সমস্যা হল মমতার বিরুদ্ধে রাজ্য বিজেপির মুখটি কে? একজন নয়, বিজেপিতে ছায়া মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
mamata banerjee, modi, mamata

মোদী-মমতা

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। আর তো মাত্র ৮ মাস বাকি। এবার লড়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম বিজেপি। এ নিয়ে আর কোনও বিতর্ক নেই। সিপিএম এবং রাজ্য কংগ্রেস হাতে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের সিপিএম নেতারাও স্বীকার করেছেন যে একদা যে লড়াই ছিল কংগ্রেস বনাম সিপিএম। তারপর ৭৭ সালে সিপিএম ক্ষমতায় আসার পর লড়াই হল সিপিএম বনাম কংগ্রেস, তারপর সিপিএম বনাম মমতা। আজ সেই সিপিএম, সেই কংগ্রেস প্রধান নির্ধারক শক্তি নয়। প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠল বিজেপি।

Advertisment

সমস্যা অন্যত্র। সমস্যা হল মমতার বিরুদ্ধে রাজ্য বিজেপির মুখটি কে? একজন নয়, বিজেপিতে ছায়া মুখ্যমন্ত্রীর মিছিল। অর্থনীতিতে একটা কথা আছে প্রাচুর্যের সংকট, রাজ্যে বিজেপিতেও হয়েছে তাই। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, তিনি খুবই সক্রিয়। এমএলএ হয়েছিলেন, এখনতো এমপিও। রাজ্যের অনেক নেতা ভেবেছিলেন তিনি যখন সংসদ সদস্য হয়ে গেছেন তবে এবার হয়তো তাকে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরানো হবে। কিন্তু ২০১৯ -এর লোকসভা ভোটের ফলাফল বেরোনোর পরও তো এক বছর হতে চলল, দিলীপ ঘোষ বহাল তবিয়তে রাজ্য সভাপতি পদে টিকে আছেন। দিলীপবাবু অভিজাত নন। কিন্তু তিনি মাটির কাছাকাছি। জেলায় জেলায় গিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অসন্তোষকে মূলধন করে সংগঠন তৈরি করতে সচেষ্ট। কিন্তু তার বিতর্কিত নানা মন্তব্য নিয়ে শহুরে অভিজাত ও বাঙালির মধ্যে তুমুল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। গরুর মূত্র থেকে রামলালার পুজো নিয়ে তার হিন্দুত্ববাদী নানা মন্তব্যকে সামন্ততান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক কুসংস্কার বলে বিদ্বৎসমাজের এক বড় অংশ বিরক্ত। তাতে দিলীপবাবু কিন্তু কোনভাবেই উদ্যম হারাননি। বরং তিনি মনে করেন, এভাবে বিতর্কে থাকাটাই জরুরী।

তবে দিলীপবাবু এতদিন যেভাবে এগোচ্ছিলেন তাতে হঠাৎই একটা আচমকা ধাক্কা সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎই আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায়। তিনি একদা রাজ্য সভাপতি হয়েছিলেন এ রাজ্যে। রাজ্যপাল হয়ে চলে গেলেও তিনি একদিনের জন্য দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়ে সংবিধানের ঘেরাটোপে বন্দী হতে পারেননি। তথাগত বাবু ত্রিপুরার রাজ্যপাল হয়ে রাজভবনে যখন যান, তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মানিক সরকার। পরবর্তীকালে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী হন বিপ্লব কুমার দেব। বিজেপি এরাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন আরও গতিশীল হয়ে ওঠে। তথাগতবাবু ত্রিপুরার রাজভবনের বন্দিত্ব মেনে নিতে পারতেন না। এই রাজভবন ছিল রাজপ্রাসাদেরই অংশ। রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে যে চেয়ার ব্যবহার করেছেন সে চেয়ারটিও নাকি এখানে আছে। তবুও এসব ইতিহাস তথাগত বাবুকে যতটা আকর্ষণ করে তার চেয়ে তার মন বরাবর পড়েছিল পশ্চিমবাংলায়। তিনি নিয়মিত উগ্র হিন্দুত্ববাদী টুইট করা শুরু করেন। একবার তো তথাগত বাবুর টুইটার জন্য রাজ্য সভার অধিবেশন মুলতুবি করে দিতে হয়। তখন অরুণ জেটলি ছিলেন রাজ্যসভার দলনেতা। তাকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। তথাগতবাবু দিল্লিতে এলেও অমিত শাহকে একাধিকবার বলেছেন, আমি পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সক্রিয় রাজনীতি করতে চাই। তথাগত বাবুকে ত্রিপুরা থেকে মেঘালয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যপালের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই তিনি চলে গেছেন কলকাতায়। কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্য থেকে তৃণমূলকে সরানোর জন্য এখন তিনি পুরোদমে আবার সক্রিয় রাজনীতি করবেন। জেলায় জেলায় তার সফরও শুরু হবে। শুধু তাই নয়, তথাগত বাবু জানিয়ে দিয়েছেন তিনি দিল্লির অনুমতি নিয়েই আসরে নেমেছেন। অর্জুন সিংহ থেকে মতিলাল ভোরা, বাংলার দৃষ্টান্ত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এরা যদি রাজ্যপাল হওয়ার পর আবার রাজনীতিতে আসতে পারেন তবে তথাগত বাবুইবা কি দোষ করলেন?

অতএব এই মুহূর্তে মূল লড়াই হল দিলীপ ঘোষ বানাম তথাগত রায়। তবে শুধু এই দুইজনই তো নয়! কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র ফ্যান ক্লাব খুব শক্তিশালী। বাবুল একজন শক্তিশালী গায়ক। বলিউডের যেমন ঘনিষ্ঠ, তেমন ঘনিষ্ঠ বাবা রামদেবের। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ স্নেহভাজন। বাবুল সোশ্যাল মিডিয়াতেও সক্রিয়। তবে বাবুল নিজে দিলীপবাবুর কাজকর্মের স্টাইলে যে খুশি নন, তা জানেন না এমন সংশ্লিষ্ট মানুষ খুব কমই আছে। তবে বাবুল যদি হতে পারেন প্রার্থী, তবে টলিউড অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় কেন নয়? লকেট সিনেমা জগৎকে কার্যত বর্জন করে ২৪×৭ রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। তাকে মহিলা সংগঠনের নেত্রীর পদ থেকে সরানো হয়েছে, কিন্তু তিনি সংসদ সদস্যা। প্রধানমন্ত্রী তো নিজের বাসভবনে সাংসদের প্রাতরাশঃ বৈঠকে সকলের সামনেই লকেটের কাজের প্রশংসা করেন। মহিলা সংগঠনটি হারানোর পরও তার কাজের উৎসাহ একচুলও কমেনি। এছাড়া জিষ্ণু বোসের মত মোহন ভাগবতের ঘনিষ্ঠ খুব বেশি নিজের ঢাক নিজে না পেটানো ব্যক্তিত্ত্ব, শিক্ষিত বাঙালি। তার নাম নিয়েও সংঘ পরিবারে আলোচনা আছে।

অবশ্য এ সমস্ত নাম দূরে সরিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত বিজেপি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করতে প্রস্তুত? পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় চায়ের দোকান গুলি এখন যেন এক একটা পার্লামেন্ট। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও আলোচনা চলছে। আরে বাবা বিজেপি চাইলেই তো হলোনা! দাদা কি রাজী? দাদাকে তো রাজি হতে হবে। বিসিসিআই থেকে দাদা আইসিসিতে যাবেন। খামোকা রাজনীতিতে আসবে কেন? আবার পাল্টা বক্তব্য, বিজেপি এই ধরনের সেলিব্রিটি কোন ব্যক্তিত্ব যাকে বলা হয় দলে ল্যাটারাল এন্ট্রি, তাকে কখনো মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী করেছে। সাধারণ এমন কাউকে করা হয় যার সঙ্গে সংঘ পরিবারের দীর্ঘ রাজনৈতিক পটভূমি বা ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে। ভুলে গেলে চলবে না, যোগী আদিত্যনাথও কিন্তু বিধানসভায় যাবার আগে লোকসভার প্রার্থী ছিলেন দীর্ঘদিন।

দিল্লির খবর, কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী কে হবে তা নিয়ে এই মোরগ লড়াই দেখে মোদী এবং অমিত শাহ যুগপৎ বিরক্ত। এমনকি বিজেপি দলের সভাপতি জগৎ প্রকাশ নাড্ডা, যার স্ত্রী শুধু বাঙালি এমন নন, তার শাশুড়ি ও স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে রায়পুরে বিজেপি তথা সংঘের রাজনীতি করেছেন। এই বাঙালি পরিবার বাংলাকে জানে অনেকটাই। কেউ কেউ আবার বলছেন স্মৃতি ইরানীকেও কলকাতায় নিয়ে আসা সম্ভব। শেষ পর্যন্ত তিনি তো বাগচী-দুহিতা। মা বাঙালি শুধু নয়, মেয়ে যেভাবে বাংলা বলে, সংস্কৃতির দিক থেকেও স্মৃতি অনেক বাঙালির চেয়েও বাঙালি।

এই গোলযোগ দেখে কৈলাস বিজয়বর্গীয় ঘোষণায করেছেন যে মুখ্যমন্ত্রী ঠিক হবে জেতার পর। পরিষদীয় দল নেতা নির্বাচন করবে। এখানে একটাই কথা বলার, ১৯৫৭ সালে যখন উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে জনসংঘ অংশ নেয়, তখনও জিততে পারবে না জেনেও অটল বিহারি বাজপেয়ি কে মুখ্যমন্ত্রীর ছায়া প্রার্থী করা হয়। প্রথম থেকে এটাই ছিল জনসংঘের সংস্কৃতি। ভোটের আগে সব সময়ই দলে নেতা নির্বাচিত হত। পরে অবশ্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে দল এ নীতি থেকে সরে আসে। যেখানে হয় সেখানে হয়, যেখানে হয় না সেখানে হয় না।

অবশ্য এই পরিস্থিতিতে এত গোলযোগেও একটা ইতিবাচক ব্যাখ্যা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা বলছেন, এবার বিধানসভা ভোটে বিজেপির জয় লাভের সম্ভাবনা যে আছে, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল দলীয় নেতাদের এভাবে প্রায় সকলের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বাসনা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী সেকথা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করে। মমতাকে কোনোভাবেই তাই মোদি–শাহ আন্ডারএস্টিমেট করেন না। ক্ষমতায় টিকে থাকার আর্ট বা রণকৌশল যে মমতা জানেন না, তা নয়। কিন্তু জেলায় জেলায় ১০ বছরে তৃণমূল বিরোধী অসন্তোষ যে বেড়েছে তাতে বিজেপি নিশ্চিত। এর মধ্যে ধর্মীয় মেরুকরণ হিন্দুত্বকে লোকসভা ভোটের স্টাইলে আবার পুনরুজ্জীবিত করা, এইসবই বিজেপির কৌশল। জেলায় জেলায় এক শ্রেণীর লুম্পেন এলে তাবিয়াত সিপিএম থেকে শাসক তৃণমূলে আসে, অর্থনৈতিক কারণে জেলায় জেলায় নানা গোষ্ঠী তৈরি হওয়ায় এই লুম্পেন বাহিনী অনেকে বিজেপিতে আসতে শুরু করেছে বলে দিলিপ ঘোষরা মনে করেন।

এ অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী কে হবে তা নিয়ে এহেন লড়াই দেখে তাই বিরক্ত দিল্লি। আপাতত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, ভোট হোক আর কেউ নন মোদীর নামেই। হোক না বিধানসভা ভোট, তবু পোস্টারে ছবি থাকবে একমেবাদ্বিতীয়ম নরেন্দ্র মোদিরই। অতএব, লড়াই মমতা বনাম মোদি? কিন্তু ভোটের পর? মোদি তো মুখ্যমন্ত্রী হবেন না!

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

tmc bjp Mamata Banerjee Delhi Theke Bolchi modi
Advertisment