অকুস্থল বরানগরের লেকভিউ পার্ক। বাড়ি থেকে পথে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন এক মহিলা। দাউদাউ করে জ্বলছে তাঁর সমস্ত শরীর। হতবাক প্রতিবেশীরা ছুটে এসে ব্যবস্থা নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার মধ্যেই পুড়ে যায় মহিলার দেহের ৯০ শতাংশ। বাঁচার জন্য প্রাণপণ লড়াই ব্যর্থ হয়। হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর।
শ্যামলী দাস। বধূহত্যার সাম্প্রতিক জ্বলন্ত নিদর্শন। আক্ষরিক অর্থেই জ্বলন্ত।
যেন এদেশে অনন্তকাল ধরে ঘটে যাওয়া অগণিত গৃহবধূর শ্বশুরবাড়িতে জ্বলেপুড়ে মরার প্রতীকী চিত্রনাট্য। এ চিত্রনাট্যে আছে অবর্ণনীয় দুঃখ, আক্ষেপ, হতাশা। আর আছে অন্তহীন এক অসহায় জ্বালা। আসলে পুরোটাই এক জ্বালাময় উপাখ্যান। বলা যায়, ধারাবাহিক ও পুনরাবৃত্ত উপাখ্যান।
খবরে প্রকাশ, একই বাড়ির দুটি তল মিলিয়ে বসবাস করেন শ্যামলীর পরিবার। দু'ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে অশান্তি। শেষ পর্যন্ত এই ভয়াবহ পরিণতি। দেওর এবং জা মিলে শ্যামলীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। জা সুস্মিতাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। দেওর পলাতক। খোদ কলকাতা শহরের বুকে ঘটে যাওয়া এই ভয়ঙ্কর অপরাধ আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের সমাজের নগ্ন চেহারাটা।
এই প্রতিবেদন লিখতে লিখতেই খবরে দেখছিলাম, বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া এমন অজস্র ঘটনার খবর। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, রোজ গড়ে একটি-দুটি করে বধূহত্যার ঘটনা ঘটে। হ্যাঁ, এখনও ঘটে! এই 'ডিজিটাল ভারত', থুড়ি 'এগিয়ে বাংলা'-তেও ঘটে। মানে, যে ক'টি ঘটনা খবরে প্রকাশ পায়। প্রকাশ পায় না, ধামাচাপা দেওয়া হয় যেসব, সেসব তো জানতেই পারি না আমরা। জানা যায় না তারও আগের দীর্ঘ নির্যাতনের ইতিহাস।
কোথাও পণ না দেওয়ার জন্য, কোথাও সম্পত্তির লোভ, কোথাও অন্য কিছু। এমনকি স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্যও চলে হুমকি, শেষে হত্যা। বধূহত্যার সবচেয়ে চালু ও সহজ উপায় হলো, গায়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দাও। একেবারে হাতের কাছেই থাকে উপকরণ, তেল ও দেশলাই। তারপরই আছে বিষ প্রয়োগ। তারও অনেক বৈচিত্র্য। কীটনাশক থেকে জটিল রাসায়নিক। আবার অন্য কোনওভাবে মেরে দড়িতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার রূপ দেওয়া, এটাও খুব চেনা ছক।
মোদ্দা কথা, বধূহত্যা-লীলা চলছে, সভ্যতার আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত, নানা অভিমুখ ও চেহারায়। হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে তাকে কাজে পরিণত করা, রীতিমতো গবেষণা করে বিষয়টিকে রূপ দেয় লোকজন। বলা বাহুল্য, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই কাজটা করে তারা। শতাংশের হিসেবে যে ক'জন ধরা পড়ে, তারাও অনেকেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ, যারা এটা করে, তারা শুধু অপরাধী নয়, চতুর, কুশলী এবং সংঘবদ্ধ। একই পরিবারের একাধিক সদস্য মিলে এক নিরীহ মহিলাকে হত্যা করার সময় এদের হাত কাঁপে না। এরা পরস্পর হাত ধরাধরি করে নিজেদের শক্তির প্রমাণ রাখে। এদের একতাবদ্ধ অপরাধের কাছে কঠোরতম আইনও যেন শিশু।
আসল কথা, আইন-প্রশাসন অপরাধ দমনে যতই ক্রিয়াশীল হোক, কোনও 'ব্যবস্থা' কখনও সমাজকে বদলাতে পারে না। সেটা বাস্তবে সম্ভবও নয়। সব অপরাধের মতোই এখানেও অন্ধকার আমাদের মনে। মন চায় বলেই এসব ঘটে। আর আইনের কথাও যদি ধরি, সেখানেও অপরাধ গোপন করা থেকে গুরুতর অপরাধে লঘু দন্ড, উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো এমন নানা নাটক চলতে থাকে।
শ্যামলীর কথাই যদি ধরি, তাঁর হত্যার ষড়যন্ত্রে সামিল তাঁর দেওর ও জা। এটা তো ইতিমধ্যেই পরিষ্কার। শ্যামলীর গায়ে আগুন লাগিয়েছে তারাই। এক্ষেত্রে তদন্ত ও তারপর আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়াটা খুব বেশি সময়সাপেক্ষ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবাই জানেন, সেটাও এখন এদেশে এক অসম্ভব ঘটনা। এখানে যত দিন যাচ্ছে, 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে' দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন মানুষ। সাম্প্রতিক নির্ভয়া মামলা তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
একটা প্রশ্ন, খুবই অপ্রিয়, তবু এর উল্লেখ না করলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কিছু কথা না বললে সত্যের অপলাপ হয়। বধূহত্যা কিন্তু কখনওই নিছক নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচার নয়। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদও এক্ষেত্রে একাকার। সর্বত্র শ্বশুরবাড়ির পরিবারের নারী-পুরুষ মিলেমিশে এই হত্যালীলা চালায়। কোথাও কোথাও তো পরিবারের মহিলারাই এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা কি চাইলে বাধা দিতে পারে না?
তর্কের খাতিরে নাহয় মেনে নিলাম, আগেকার দিনে বেশিরভাগ পরিবারেই মহিলারা অসহায় দর্শক হিসেবেই অন্যায়-অবিচারের সাক্ষী হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু এখনও কি তাই? শ্যামলীর জা-ও তো আজকের মেয়ে। একেবারে গন্ডগ্রামের কথা ছেড়ে দিলে এখনকার শাশুড়িরাও অধিকাংশই তো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত। তাঁরা তো যথেষ্ট খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেন। তারপরও এই মানসিকতা কোথা থেকে আসে? হয় তাঁরা বধূর প্রতি অত্যাচার বা নিধনযজ্ঞে উদ্যোগী হন। নয়তো হাত গুটিয়ে মজা দেখেন। তাহলে সমাজটা কী করে বদলাবে? আইনের শাসন তো অপরাধের পরে আসে। পরিবারের মেয়েরা চাইলে কিন্তু এই অপরাধ ঘটে যাওয়ার আগেই অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
সভ্যতার পর এতগুলো যুগ কাটিয়ে ফেললাম আমরা। তারপরও এই প্রবল অমানবিক ও পৈশাচিক কান্ড ঘরে ঘরে ঘটে চলেছে। অত্যন্ত লজ্জার কথা, বধূহত্যা কমে যাওয়া দূরের কথা, বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে চিন্তার ব্যাপার হলো, এই অপরাধের শিকড় এতটাই গভীরে, এতই বিস্তৃত, যে নিছক আইনের শাসন দেখিয়ে কখনওই এটা থামানো যাবে না। এর সমাধান যদি খুঁজি, তাহলে আরও একবার সেই আয়নায় নিজেদের মুখগুলো দেখতে হবে। বদলাতে হবে নিজেদের অন্তরমহল। সেই মহল, যেখানে বাস করে লোভ, ঈর্ষা, ঘৃণার পোকারা। ছেলেকে বড় করেছি অনেক টাকা খরচ করে। সেই টাকা ফেরত আনতে হবে ছেলের বিয়েতে পণ নিয়ে। প্রতিশ্রুত বধূর বাপের বাড়ি সেই পণ দিয়ে খুশি করতে না পারলেই শোধ তোলো বধূর ওপর। দরকার হলে মেরে ফেলে আবার ছেলের বিয়ে দাও। এই অসুস্থ প্রক্রিয়াগুলি কি আবহমানকাল ধরে চলতে দেব আমরা?
আমরা। হ্যাঁ, আমরাও পারি কিছুটা হলেও এর প্রতিরোধ করতে। কোনও সংগঠিত আন্দোলনের কথা বলছি না। একেবারে ব্যক্তিগত স্তরে - বাড়িতে, পাড়ায়, আত্মীয় বা বন্ধুমহলে বধূ নির্যাতনের ঘটনা দেখলেই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি কৃত প্রতিবাদ আপনা হতেই সমষ্টির প্রতিবাদে পরিণত হবে। প্রথমে নির্যাতন, তারপর হত্যা, এটাই সাধারণত ঘটে। অর্থাৎ নির্যাতনটা বন্ধ করতে পারলে বাকিটাও বন্ধ হবে। সর্ব শক্তি দিয়ে দাঁড়াতে হবে নির্যাতিতার পাশে। তাঁকে সাহস যোগানো একটা বড় কাজ। এ ব্যাপারে আইন ও প্রশাসন যে তাঁর পাশে, সেটাও বোঝানো জরুরি। একটা শক্তপোক্ত জনমত তৈরি করা দরকার এই কাজগুলির বিরুদ্ধে। তাতে আর যাই হোক, অপরাধীরা কিছু করার আগে দুবার তো ভাববেই। একেবারে দ্বিধাহীন ভাবে মারণযজ্ঞে নামবে না, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
'অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে'...এ শুধু কবির লেখা কথার কথা নয়। এ একেবারে সমাজের হাতের মোক্ষম অস্ত্র। সমাজ তো আমরাই। আমরা কেমন হব, তার ওপরেই সমাজের যাবতীয় গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। আমরা চাইলে শ্যমলীদের প্রতি অবিচার বন্ধ হবে। নাহলে আমার আপনার ঘরের শ্যমলীরাও নিস্তার পাবে না।