এক সময়ে কলকাতার দেওয়াল ছেয়ে গিয়েছিল। যে কোনও দেওয়ালের দিকে তাকালেই চোখে পড়ত, ‘গলানো সোনা ২৮ টাকা’। সেটা কী সেটা কী, খোঁজ পড়ে গেল। বেশ কিছু দিন পরে জানা গেল, সেটা ছিল সর্ষের তেলের বিজ্ঞাপন। এত দিন পর ফের গলানো সোনার গল্প শোনা গেল। এবার অবশ্য তেল নয়। দুধের সঙ্গে মেশানো গলানো সোনা। রাজনীতিকদের পক্ষেই সম্ভব, তেলে-জলে, তেলে-দুধে মিশিয়ে দিয়ে বুক বাজিয়ে বলা, ‘ঠিকই তো বলেছি’। 'সূর্য কাঁদলে সোনা' বলে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার উপন্যাস ছিল। তা বলে দুধ দুইলে সোনা! বলতেই পারেন এযুগের কোনও রাজনৈতিক ঘনাদা।
মুখ ফসকে আলটপকা কিছু বলে ফেলা, না জেনে ভুল বলা, এসব তো হতেই পারে। প্রকাশ্যে বলা জ্যোতি বসুর এমন কোনও মন্তব্য অনেক খুঁজলে হয়তো এক আধটা বেরোবে, কিন্তু সেসব ওই সোনার দুধের কাছে নস্যি। আলটপকা কথা বলে বিতর্ক সৃষ্টিতে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী কম যান না। তবে তার অনেকটাই মুখ ফসকে বলা। ঠিকই, এটা একজন উঁচুদরের রাজনীতিককে মানায় না। বুদ্ধদেববাবুরও এই দোষ কিছুটা ছিল। 'মাথা ভেঙে দেব', 'পেইড বাই দ্য সেম কয়েন', মাদ্রাসা নিয়ে কিছু কথা প্রবল বিতর্ক তৈরি করেছিল।
বিমান বসুর বক্রেশ্বর নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালিখির প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বরাহনন্দন বলা, বা হাইকোর্টের বিচারপতি লালাকে, 'লালা বাংলা ছেড়ে পালা' বলা বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করা এবং পরে তা নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা কেউ নিশ্চয়ই ভুলে যান নি। যদিও বিমান বসুর সুদীর্ঘ সৎ বামপন্থী জীবনযাপনের মধ্যে এমন ঘটনা কিছুটা ব্যতিক্রমই।
আরও পড়ুন, বাঙালির হিন্দু উগ্রবাদ কখনোই বিজেপি-নির্ভর নয়
কিন্তু ইচ্ছে করে বাজে কথা বলা, কুকথা বলা, গাল দেওয়া, এই ধরনের রাজনৈতিক অসভ্যতা বাড়তে শুরু করল ২০০৬-এর পর থেকে। বিনয় কোঙারের মেধা পাটকরকে পশ্চাদ্দেশ প্রদর্শনের ডাক, 'লাইফ হেল' করে দেওয়ার হুমকি, অনিল বসুর মমতার চুলের ঝুঁটি ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ, ওই সময় থেকে। ধীরে ধীরে অভদ্রতা বঙ্গ রাজনীতিতে রোজকার ব্যাপার হয়ে উঠল। অনুব্রত মণ্ডলের মতো রাজনীতিক খবরে যতটা জায়গা পেতে শুরু করলেন, সেখানে সুগত বসুর মতো পণ্ডিত বা সৌগত রায়ের মতো দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানদের খবর সংবাদপত্রে অনেক ক্ষেত্রেই ভিতরের পাতায় চলে গেল। এটা অবশ্যই সংবাদ মাধ্যমের ত্রুটি।
এর পর বঙ্গ রাজনীতিতে পদ্মের উত্থান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেমন দীর্ঘ লড়াই করে বিধানসভায়, লোকসভায় আসন জিততে হয়েছিল, তুলনায় এই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদীরা কিছু না করেই একটা বড় জনসমর্থন পেয়ে গিয়েছেন। লোকসভা ভোটের ফলে তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তুলে ধরার মতো মুখের অভাবেই সম্ভবত, পদ্মনেতারা অনেকেই খুব দ্রুত অনুব্রতের ইস্কুলের ফার্স্ট বয়, সেকেন্ড বয় হয়ে উঠেছেন। এখন এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায় দেখ।
একজন বলছেন, যাদবপুরের ছাত্রদের কলার ধরে টেনে বের করবেন, আর একজন বলছেন, মেমসাহেব বিয়ে করেছেন বলেই নোবেল পেয়েছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। কেউ আবার বলছেন কাশ্মীরে মুর্শিদাবাদের যে মানুষরা খুন হয়েছেন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে, তাঁরা বাঙালি নন। কখনও বলা হচ্ছে 'সহজ পাঠ' লিখেছেন বিদ্যাসাগর, কখনও বলা হচ্ছে সতীদাহ রদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এইরকম বাজে কথা, অর্থহীন মন্তব্য, সভ্যতা-ভদ্রতাবোধহীন কথা, ভুলভাল কথা বলার এক নতুন ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে এই রাজ্যে। যার সর্বশেষ মণি-মুক্তা হল গরুর দুধের সোনা।
এসব অল্প-বিস্তর আগেও ছিল। কিন্তু কম ছিল। অনেক বেশি ছিল অন্য রকমের দৃষ্টান্ত।
১৯৯২ সালে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর সেই সময়ের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং বলেছিলেন, "ঠিকাদার দিয়ে কাজটা করাতে বহু দিন সময় লাগত, কর সেবকরা করেছে বলে এক দিনে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।" ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন অনেক সাংবাদিক এবং ফোটোগ্রাফার আক্রান্ত হন। তার প্রতিবাদে আমরা পরের দিন অযোধ্যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিংহলের প্রেস কনফারেন্স বয়কট করি।
তার বেশ কিছু দিন পরে কল্যাণ সিং কলকাতায় আসেন। উঠেছিলেন আলিপুরে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। সকাল ন'টা নাগাদ আমি সেখানে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখি, সমর্থক আর ফোটোগ্রাফারদের ভিড়ে দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। হইচই চিৎকারে কান পাতা দায়। বিজেপি নেতারা সবাইকে বেরোতে বলছেন, কেউই কথা শুনছেন না। এমন সময় বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি (প্রয়াত) বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী বেশ চিৎকার করে আমাকে বলে উঠলেন, "তখন থেকে আপনাকে বলছি বেরিয়ে যেতে, কথা শুনছেন না, এখনই বেরিয়ে যান।" কাজ করতে গেলে এসব শুনতে হয়, গায়ে মাখতে নেই। আরও কিছুক্ষণ থেকে আমি বেরিয়ে এলাম।
দুপুরে কলকাতা প্রেস ক্লাবে কল্যাণ সিং-এর সাংবাদিক বৈঠক। সাংবাদিকরা বেঁকে বসলেন। অযোধ্যায় সাংবাদিকদের উপর হামলার নিন্দে করতে হবে। প্রথমে গাঁইগুঁই করে অবশেষে কল্যাণ সিং সেদিনের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করার পর শুরু হল সাংবাদিক বৈঠক। বৈঠক শেষে হঠাৎ দেখি বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে। আমি সেদিকে তাকাতে তিনি হাত জোড় করে বললেন, "আমি সকালে আপনার সঙ্গে খারাপ করে কথা বলেছি, কাজটা আমি ঠিক করিনি, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।" আমি বিস্ময়ে অভিভূত। বিজেপির এমন নেতাও তো এই রাজ্যে ছিলেন। নতুন প্রজন্মের বাঙালি নেতারা এই সব নেতাদের থেকে কিছুই কি শেখেননি?
আরও পড়ুন, অযোধ্যা: আদালতের রায়, বাদুড় চুরি এবং হিজবিজবিজের হাসি
অশোক মিত্র ছিলেন বামফ্রন্টের প্রথম অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, "আমি ভদ্রলোক নই, কমিউনিস্ট।" কাজের প্রয়োজনে বহুবার ওঁর বাড়িতে গিয়েছি। কাজ শেষ হলে তিনি বেরিয়ে এসে সদর দরজা খুলে, লিফটের দরজা খুলে বলতেন, "আসুন"। লিফটের দরজাও তিনি নিজেই টেনে দিতেন। যতবার ওঁর বাড়িতে গিয়েছি, ততবারই এমন দেখেছি।
আগে সব ভালো ছিল, এমন নয়। আগে কোনও অসভ্যতা ছিল না, এমনও নয়। কিন্তু অন্যরকমটাও ছিল। এখন যেন সেই অন্যরকমটা লুপ্তপ্রায়। কংগ্রেসিরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বলবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। ১৯৬২ সালে ভারত সীমান্তে চিনের হানার পর কমিউনিস্টদের দেশদ্রোহী প্রমাণে উঠে পড়ে লাগেন কংগ্রেসিরা। তখন এত বেশি জ্যোতি বসুর কুশপুতুল পোড়ানো হতো যে এক ভদ্রলোক কালীঘাটে কুশপুতুলের একটা দোকানই দিয়ে বসলেন।
কুশপুতুল পোড়ানো যথাযথ প্রতিবাদের একটা সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি। জ্যোতি বসুর আত্মজীবনী 'যত দূর মনে পড়ে' বইয়ে এই দোকানের উল্লেখও রয়েছে। সেখানে তখন জ্যোতিবাবুর কুশপুতুলের সঙ্গে বিক্রি হতো চৌ এন লাই, মাও সে তুং-এর কুশপুতুলও। এই সব প্রতিবাদের মধ্যে একটা সভ্যতার মাত্রা ছিল। সেটা যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। আজকাল আবার মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, শাসকদলের নেতানেত্রীর কুশপুতুল পোড়াতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে বাধা আসে।
বিধানসভায় আমরা জ্যোতি বসু-সিদ্ধার্থ রায়কে দেখেছি। দুই বন্ধুর একজন শাসকদলের নেতা, অন্যজন বিরোধী দলের নেতা। ১৯৭২-৭৭, সিদ্ধার্থশংকর রায় যখন বাংলার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তখন কলকাতার ফুটপাথের চায়ের দোকানে লোকজনকে বলতে শোনা যেত, "একটা চা আর একটা সিদ্ধার্থ দিন।" এখানে 'সিদ্ধার্থ' মানে খালি গেলাস। সিদ্ধার্থ রায় নাকি এতই শূন্যগর্ভ কথাবার্তা বলতেন, যে খালি গেলাসের নাম সিদ্ধার্থ। ঠিক হোক বা ভুল হোক, এর মধ্যে একটা রসবোধের ব্যাপার ছিল।
বামফ্রন্টের আমলে গোড়ার দিকে লোডশেডিং লেগেই থাকত। এই আলো আছে তো এই নেই। লোকে বলত, যাঃ, জ্যোতি গেল। আলো এলে বলত, ওই জ্যোতি এল। একবার পুজোয় ঝাপসা কালো আর সাদা রঙের লোডশেডিং শাড়ি বেরোলো। হকাররা বিক্রির জন্য লোডশেডিং শাড়ি বলে চেঁচাচ্ছিলেন। এই নিয়ে একদিন গড়িয়াহাটে সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে কয়েকজন হকারের বেশ গোলমালও হয়। সে খবর তখন কাগজেও বেরিয়েছিল। রসবোধের ব্যাপার ছিল রেজ্জাক মোল্লার ‘হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে গেছে’ উক্তিতেও। এই রসবোধ রাজনীতি থেকে, সমাজ থেকে হারিয়ে গিয়েছে।
কিছুটা অবশ্য টিকে আছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। তবে তার বেশিরভাগটাই নিম্নমানের। কখনও কুরুচিপূর্ণও। সেটুকুও সরকার সহ্য করতে পারে না, গ্রেফতার হতে হয়। এতটাই অসহিষ্ণুতার রাজনীতির যুগ এখন। অতীতে অসভ্যতার উদাহরণ যে নেই তা নয়। আছে। ১৯৫৩ সালের ২৫ জানুয়ারি। বিধান রায়ের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী নলিনীরঞ্জন সরকার মারা যান। ২ ফেব্রুয়ারি বিধানসভা এবং বিধান পরিষদে শোক প্রস্তাব পাঠ। সব সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে দু’মিনিটের নীরবতা পালন করে শ্রদ্ধা জানালেন। শুধু বসে রইলেন জ্যোতি বসু এবং কমিউনিস্ট বিধায়করা। রাজ্যপালের অনুরোধে জ্যোতি বসু সেদিন বলেছিলেন, "শোক প্রস্তাবে যে সব প্রশংসাবাক্য লেখা হয়েছে, সেই বিষয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। আমরা ওঁর সামাজিক ও রাজনীতির ভাবনার সঙ্গে একমত নই, তাই কোনও কমিউনিস্ট ওঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না।" এর মধ্যে সততা হয়তো আছে কিন্তু সামাজিকতা, ভদ্রতা নেই।
১৯৫৩ সালের জ্যোতি বসু এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু অবশ্য এক মানুষ ছিলেন না। এই নিয়ে একটি ছোট্ট ঘটনার বর্ণনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। মুর্শিদাবাদের কান্দির কংগ্রেস বিধায়ক অতীশ সিংহ তখন সম্ভবত বিরোধী নেতা। একদিন বিধানসভায় ওঁর ঘরে গিয়ে দেখি, বিয়ের নেমন্তন্নের কার্ডে নাম লিখছেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, "কী মুশকিলে পড়েছি বলুন তো, মেয়ে বলছে বেশি লোকজন ডাকা যাবে না। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একমাত্র জ্যোতি বসু। কংগ্রেসেরও কেউ নয়।" শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়ের দাবি সবটাই মেনে নিয়েছিলেন, না একটা বোঝাপড়া হয়েছিল, তা জানা নেই।
জ্যোতি বসু অসুস্থ থাকাকালীন মমতা বারবার তাঁকে দেখতে গিয়েছেন। জ্যোতি বসুও অসুস্থ শরীরে নিজের বাড়িতে বসে সিঙ্গুর নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "ওঁর কথাটাও শোনা উচিত।" এটা খুব বড় কথা। যদি সবাই মনে করেন, মানা হোক বা না হোক, ওঁর কথাটাও শোনা উচিত, তাহলেই কুকথার কলুষ অনেকটা ধুয়ে যেতে পারে রাজনীতি থেকে।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)