Advertisment

রাজনীতিনামা: বাংলায় বিজেপি উত্থান

স্বাধীনতার পর বাঙালি আর অবাঙালিদের মধ্যে বাংলায় প্রায় একটা অলিখিত চুক্তি ছিল যে রাজনীতি মূলত বাঙালিদের হাতে থাকবে এবং বাংলার রাজনীতি, বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ করবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
BJP, Bjp in Bengal

ছবি- শশী ঘোষ, গ্রাফিক্স- অভিজিৎ বিশ্বাস

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলোর মধ্যে বাংলায়, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি-র) সাফল্য অভূতপূর্ব। রাজ্যে যেখানে মাত্র তিন বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে যে দল দশ শতাংশ ভোট পায় আর ২৬৩ আসনে তাদের প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয় সেই নিরিখে লোকসভা নির্বাচনে ৪০.৩০ শতাংশ ভোট ও একলাফে মাত্র দুটো সাংসদ থেকে ১৮ আসনে জয় পাওয়া প্রায় অকল্পনীয়।

Advertisment

বঙ্গে বিজেপির পক্ষে আদিবাসী, দলিত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট ব্যাপক হারে বেড়েছে। এ রাজ্যে বিজেপি ২০১৪ সালে উচ্চবর্ণীয় ভোটারদের বিশেষ করে কাছে টানতে পেরেছিল। কিন্তু উচ্চবর্ণের মধ্যে বিজেপি একদিকে যেমন তাদের সমর্থন বাড়িয়েছে (২৪ থেকে ৫৭ শতাংশে) তেমন দলিতদের মধ্যে তা ২০ থেকে ৬১ শতাংশে, ওবিসি-র মধ্যে ২১ থেকে ৬৫ শতাংশে এবং আদিবাসীদের মধ্যে পাঁচ গুণের উপরে (১১ থেকে ৫৮ শতাংশ) বিজেপির ভোট বেড়েছে। সেন্টার ফর স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস (সিএসডিএস) এর উত্তর-নির্বাচনী সমীক্ষা যা ভারতীয় নির্বাচক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, তার ফল সেরকম বলছে। কিন্তু বিজেপি কি কেবল বিগত কয়েক বছরে হঠাৎ বাড়ল নাকি এই বাড়বাড়ন্তের পিছনে কাজ করেছে অন্তত কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা কয়েকটা নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া?

আরও পড়ুন, গণতন্ত্রের স্বার্থে এবার দ্রুত ঘর গোছাক কংগ্রেস

প্রথমে আসা যাক কয়েকটা নিকট অতীতের কথায়। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে ব্যাপক রিগিং হয়েছিল, ভুরি ভুরি ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে উঠেছিল এবং যে ভোটে প্রায় ৩৪ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে, ৩৩ শতাংশ পঞ্চায়েত সমিতিতে এবং ২৪ শতাংশ জেলা পরিষদের আসনে  বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিল। বিরোধীদের সঙ্গে শাসক দলের অনেক ভোটার গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। সেই জমে থাকা ক্ষোভ ও তৃণমূলকে উচিৎ শিক্ষা দেবার তাগিদ থেকে বহু মানুষ শাসক দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে তৃণমূলের রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার প্রবণতার ফলে তৃণমূল বিরোধী ভোট রাজ্যে বিজেপির দিকে সংহত হয়। বাংলায় বামফ্রন্টের সিংহভাগ ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে। এই প্রবণতা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং গত তিন বছরে বিভিন্ন উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছিল।

২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের সিঙ্গুর রায়ের পর বামফ্রন্ট তাদের আমলের কয়েকটি ভুলগুলো মানুষের কাছে খোলা মনে স্বীকার না করে, কেন্দ্র বিরোধী গণ আন্দোলন ও রাজ্য স্তরের অনেক ইস্যুগুলো নিয়ে ব্যাপক লড়াই আন্দোলন না করার ফলে তারা মানুষের থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়। এমতাবস্থায় বাংলার সিপিআই(এম) ক্রমাগত কংগ্রেস নির্ভরতায় ভুগছিল। ফলে যখন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআই(এম) এর শেষ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনী জোট হল না তখন তৃণমূল বিরোধী একটা বড় অংশের মানুষ বুঝলেন যে কেন্দ্রে যেহেতু বিজেপি সরকার এবং তৃণমূলকে শায়েস্তা করতে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস অপারগ এবং তাদের জোট না হওয়াতে তারা আরও দুর্বল, তাই অযথা ভোট নষ্ট করে লাভ নেই। বিজেপিকে ভোট দিয়ে যদি তৃণমূলকে জব্দ করা যায় এই ভাবনা থেকে অনেকে ভোট দিয়েছেন।

আরও পড়ুন, এন আর সি ও আসামে ‘বিদেশি পাকড়াও’ করার নানা হাতিয়ার

কিন্তু গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দিয়ে এই রাজ্যে বিজেপির উত্থানকে বোঝা যাবে না। বিজেপি উত্থানের পিছনে নির্দিষ্ট কিছু আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ আছে। স্বাধীনতার পর বাঙালি আর অবাঙালিদের মধ্যে বাংলায় প্রায় একটা অলিখিত চুক্তি ছিল যে রাজনীতি মূলত বাঙালিদের হাতে থাকবে এবং বাংলার রাজনীতি, বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ করবে। অবাঙালিরা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কাজ নিয়ে থাকবে কিন্তু রাজনীতিতে তারা সরাসরি প্রবেশ করবে না বা বাংলার রাজনীতি তারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে না। গত তিন দশকে দেখা যাচ্ছে যে অবাঙালি জনসংখ্যা বাংলায় তাৎপর্যপূর্ণ হারে বেড়েছে এবং অবাঙালিদের মধ্যে থেকে আজ অনেকে সরাসরি বাংলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে—নেতা, সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী হচ্ছে। পিছন থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে আরও কিছু অবাঙালি কুশীলবরা। অবাঙালি অংশের মানুষ বাংলায় এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। তার একটা প্রতিফলন হল উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের প্রধান প্রধান আরাধ্য দেবতাদের কেন্দ্র করে ধুমধাম করা পুজো এবং পুজোকেন্দ্রিক মিছিল।

বাঙালি হিন্দু মূলত শাক্ত ঘরানার। তাঁরা মূলত মাতৃশক্তির আরাধনা করেন। সে কারণেই বাংলায় পুজোকেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবহুলি ঘিরে থাকে মূলত মাতৃমূর্তি- দুর্গা, কালী, লক্ষী, সরস্বতী। এ ছাড়াও পূজা হয়ে থাকে জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, শীতলা, মনসাদেবীর।

আরও পড়ুন, অর্থনীতির স্বাস্থ্য: স্বাস্থ্যের অর্থনীতি

এ বাংলায় জনপ্রিয়তায় দেবীদের পরেই রয়েছেন শিব এবং রাধা-কৃষ্ণ। এঁরা রাম-হনুমানের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয়। বাংলার জেলা মফস্বলে ঘুরলে বোঝা যায় যে রাম মন্দিরের তুলনায় কালী, মনসা, শীতলা মন্দিরগুলো অনেক বেশি সংখ্যায় বিরাজমান।  দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলায় সবথেকে বড় ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব সংগঠিত হয়। এক্ষেত্রে সম্প্রতি অমর্ত্য সেন যে খাঁটি কথাটি বলেছেন যে বাংলায় রামের থেকে মা দুর্গা অনেক বেশি জনপ্রিয় তা বাংলার ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে যাঁরা অবহিত এবং সচেতন তাঁরা অবশ্যই সমর্থন করবেন।

কিন্তু ইদানিং বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজোর জাঁকজমক কমেছে। তুলনায় গত কয়েক বছরে আমাদের রাজ্যে পশ্চিম ভারতের মতো গণেশ পুজোর দাপট বেড়েছে। এই রাজ্যে পুজো অর্চনার নাম করে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য দেবতাদের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে মিছিল সচরাচর দেখা যেত না। অবাঙালি জনসংখ্যা রাজ্যে বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবাঙালি রাজনৈতিক সংস্কৃতির হাত ধরে বাংলায় এই নতুন রীতি আমদানি হচ্ছে। অন্যদিকে জনপ্রিয় টেলিভিশন ধারাবাহিক থেকে জনপ্রিয় বাংলা সিনেমাতেও হিন্দি সংস্কৃতির বেশ কিছু চিহ্ন, হিন্দি গান এবং হিন্দি সংলাপ প্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে যেখানে শৈল্পিক দিক থেকেও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অর্থাৎ বিগত কয়েক বছরে একটি উত্তর এবং পশ্চিম ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে বাংলাকে যেতে হচ্ছে এবং নবীন প্রজন্ম বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা প্রসঙ্গে বেশ উদাসীন। এইরকম একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিজেপির বাড়বাড়ন্তকে সাহায্য করেছে।

আরও পড়ুন, যুক্তি প্রমাণের দুনিয়ায় তথ্যের স্বচ্ছতা

বিজেপিকে বাংলায় রুখতে গেলে কেবল নির্বাচনী রাজনীতির ছক কষে হবে না। বিজেপিকে এই রাজ্যে রুখতে প্রতিদিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে এক বিকল্প সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আখ্যান গড়তে হবে। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। তবু দেরিতে হলেও এমন একটি বিকল্প সামাজিক ও রাজনৈতিক আখ্যান গড়া সম্ভব যা বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে বহু শতকের নিবিড় সম্পর্ক আছে এবং যা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে কড়া ভাবে মোকাবিলা করতে পারবে।

(মইদুল ইসলাম সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

bjp
Advertisment