বিনোদন জগতের অংশ যাঁরা, তাঁদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে নানারকম ধারণা কাজ করে। অভিনেতা মানেই তিনি লক্ষপতি হবেন, এমনটা সবসময় নাও হতে পারে। আবার সফল চিত্রনাট্যকার বা পরিচালক মানেই তাঁর বিপুল সঞ্চয় নেই। ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শুটিং। অনেকে তাঁদের আগের কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিকটুকুও এখনও পাননি। দীর্ঘায়িত লকডাউনের বিপুল অনিশ্চয়তায় টান পড়ছে সঞ্চিত অর্থে। তার পরেও সাধ্যমতো আমফান-বিধ্বস্তদের অর্থ সাহায্য করছেন, ত্রাণ পাঠাচ্ছেন বাংলা বিনোদন জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষেরা।
বাংলার বহু তারকা-ব্যক্তিত্বরা দুর্যোগের পরেই তাঁদের সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বিনোদন জগতের সকলের সাধ্য ও সামর্থ্য এক নয়। এমন বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী-পরিচালক-সিনেম্যাটোগ্রাফার-শিল্প নির্দেশক-চিত্রনাট্যকারেরা রয়েছেন, যাঁরা দীর্ঘদিন শুটিং বন্ধ থাকার ফলে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। তার পরেও তাঁরা বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে দুর্যোগে বাস্তুহারাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: চারুলতার শেষ দৃশ্য কী হবে, জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি: মাধবী মুখার্জি
এঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন টেলিপর্দার জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকারা, তেমনই রয়েছেন থিয়েটার কর্মীরাও। 'ফোর্থ বেল' ও 'হিপোক্রিট' - কলকাতার দুটি তরুণ প্রজন্মের নাটকের দল। সদস্যরা নিজেদের সঞ্চয় দিয়েই শুরু করেছেন ত্রাণের কাজ, চলছে নিজস্ব উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহ। আবার ডিজাইনার-অভিনেতা অভিষেক রায়ের মতো মানুষও রয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিলি শুরু করেছিলেন প্রাথমিকভাবে বসিরহাট অঞ্চলে। পরে মানালি দে, স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, রোহিত সামন্ত-সহ ছোটপর্দা ও বড়পর্দার বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী তাঁর উদ্যোগে সামিল হয়েছেন। দুর্যোগ বিধ্বস্ত সুন্দরবন এলাকায় বর্তমানে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন অভিষেক ও তাঁর বন্ধুরা।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলা বিনোদন জগতের অন্তত পাঁচ-ছটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে এই মুহূর্তে। নিজেদের সঞ্চয় থেকেই ফান্ড তৈরি করছেন তাঁরা, ত্রাণ সামগ্রী জোগাড় করছেন। অনেকেই একাধিক গ্রুপে অর্থ সাহায্য বা ত্রাণ সামগ্রী পাঠাচ্ছেন, কারণ কোনও একটি এলাকা নয়, বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিনোদন জগতের এই রিলিফ গ্রুপগুলি।
সোশাল মিডিয়া একটি বড় ভূমিকা পালন করছে এই ধরনের উদ্যোগে। অতি সম্প্রতিই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র প্রতিবেদনে প্রকাশিত কীভাবে অভিনেত্রী চৈতী ঘোষাল ও তাঁর পুত্র অমর্ত্য কলকাতার ফুটপাথবাসীদের মুখে রান্না করা খাবার তুলে দিচ্ছেন। ফেসবুকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য। বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। ডিজাইনার অভিষেক রায়ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন যে তিনি এই কাজটি শুরু করার পরে বিনোদন জগতের বাইরের বহু মানুষও সোশাল মিডিয়ায় তাঁর উদ্যোগের কথা জেনে অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আমফান-বিধ্বস্ত কলকাতায় অভুক্তদের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন চৈতী-অমর্ত্য
এই মুহূর্তে যে কয়েকটি গ্রুপ এই ধরনের ত্রাণের জন্য ফান্ড তৈরি করছে, তাদের মধ্যে একটি দলে রয়েছেন চিত্রনাট্যকার অর্কদীপ নাথ। এই গ্রুপটিতে বিভিন্ন পেশার মানুষই অর্থ সাহায্য করেছেন বা করছেন। কিন্তু একটা বড় পরিমাণ অর্থ এসেছে বাংলা বিনোদন জগৎ থেকে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে অর্কদীপ বলেন, ''আমরা একটা দল শুধু এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির লোকেদের কাছ থেকেই ৩৫,০০০ টাকা সংগ্রহ করেছি। আরও আসছে। শুধু একটা বললাম। এমন অনেক ফান্ড আছে।'' এই ফান্ডে ইতিমধ্যেই অর্থসাহায্য করেছেন অভিনেত্রী সানন্দা বসাক, স্নেহা চট্টোপাধ্যায়, সঙ্গীত পরিচালক অম্লান চক্রবর্তী, চিত্রনাট্যকার সাহানা দত্ত, পরিচালক অর্ক গঙ্গোপাধ্যায়, পরিচালক অভিজিৎ চৌধুরী-সহ বিনোদন জগতের বহু মানুষ। এঁদের প্রত্যেকেই একটি নয়, একাধিক রিলিফ গ্রুপকে অর্থসাহায্য করেছেন।
ফিল্মমেকিংয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পেশাদারেরা তাঁদের সাধ্যমতো এই ধরনের ফান্ডগুলিতে অর্থ সাহায্য করছেন। আবার অনেকে বিশেষ ব্রডকাস্ট তৈরি করে বা ছোট ছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছেন। যেমন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পরিচালক দেবরাজ নাইয়া তাঁর শর্ট ফিল্ম প্রদর্শন করছেন একটি বিশেষ লিঙ্কের মাধ্যমে। সেই প্রদর্শন বাবদ দর্শকের কাছ থেকে যে টাকা সংগৃহীত হচ্ছে, সেই অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে 'চাদর' নামক সংস্থার ত্রাণ উদ্যোগে। এই সংস্থাটি একটি রেজিস্টার্ড এনজিও। এছাড়াও দেবরাজ ও তাঁর বন্ধুরা সুন্দরবন এলাকার প্রায় ৫০০টি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। খাবার থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন, সবকিছুই সংগ্রহ করছেন তাঁরা।
রেডিও আবহের মাধ্যমে বিগত কয়েকদিন ধরে আমফান-বিধ্বস্তদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন চিত্রনাট্যকার ও টেলিভিশন উপস্থাপক সুজয়নীল বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫০ হাজার টাকারও বেশি তিনি এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ করেছেন। যার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাঠিয়েছেন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তিনি জানালেন, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে মানুষের মন ভাল রাখতে কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই শুরু করেছিলেন এই অডিও আবহ। কিন্তু আমফান-এর পরে বিগত কয়েকটি আবহে তিনি পারিশ্রমিক ও অনুদানের আহ্বান জানিয়েছেন। নিজের জন্য নয়, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য।
বিনোদন জগতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজন নানাভাবে চেষ্টা করছেন এই দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানুষের পাশে থাকার। পোস্টার ডিজাইনার ও গ্রাফিক আর্টিস্ট একতা ভট্টাচার্য 'আর্ট ফর হিউম্যানিটি' শীর্ষক একটি বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন। লোগো ডিজাইন বা লেটারপ্যাড ডিজাইন বাবদ এই সময়ে যে অর্থ তিনি পারিশ্রমিক হিসেবে পাবেন, তার পুরোটাই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রিলিফ গ্রুপগুলিকে দেবেন, এমনটাই জানিয়েছেন তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে। অভিনেত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্কুলের বন্ধুদের তৈরি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'হিউম্যানস ইন সলিডারিটি'-র হয়ে বহুদিন ধরেই নানা সমাজসেবামূলক কাজ করছেন। আমফান-পরবর্তী সময়ে তাঁরা রিলিফ নিয়ে যাচ্ছেন সুন্দরবনের সাতঝেলিয়া ও রঙ্গবেড়িয়া গ্রামগুলিতে।
টেলি ও টলিপাড়া এভাবেই যতটা সম্ভব আন্তরিকভাবেই মানুষের হাত ধরছেন। শুধু আমফান-বিধ্বস্তদের পাশেই নয়, দীর্ঘায়িত লকডাউনে চূড়ান্ত অর্থ সংকটে রয়েছেন যে সাধারণ মানুষ, তাঁদের উদ্দেশেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে। সম্প্রতি ছোট ব্যবসায়ী এক তরুণী তাঁর মায়ের ওষুধের জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন ফেসবুকে একটি পোস্ট মারফত। অভিনেত্রী সঞ্চারী মণ্ডল পাশে দাঁড়িয়েছেন শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহানুভূতিশীল যে কোনও নাগরিকদের মতোই।
বিনোদন জগতের সঙ্গে জড়িত যাঁরা, তাঁরা একটি বিশেষ পেশায় রয়েছেন, যে পেশায় জনপ্রিয়তা অন্যান্য পেশার থেকে অনেকগুণ বেশি, পরিচিতি বেশি। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবে 'সেলিব্রেটেড', যে কারণে 'পাবলিক ফিগার' বা 'সেলিব্রিটি' শব্দগুলি তাঁদের নামের আগে বসানো হয়। কিন্তু কোনও মানুষ সেলিব্রেটেড মানেই তিনি লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক নন। দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কারণে কিছু মানুষ সব সময়েই আর একদল মানুষের থেকে বেশি আয় করেন, সঞ্চয়ও করেন। তিনি যে পেশা থেকেই আসুন না কেন, বিপদের সময়ে তিনি যদি মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, তবে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
সাধারণ মানুষের একাংশে বিনোদন জগতের মানুষের সম্পর্কে, বিশেষ করে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্পর্কে নানা ধরনের সংস্কার কাজ করে। ধারাবাহিক বন্ধ হওয়ার সংবাদ পেলে তাঁদের একাংশ সোশাল মিডিয়ায় এসে লেখেন যে 'ভাল হয়েছে, বস্তাপচা সিরিয়াল বন্ধ হয়েছে।' অথচ ভিউয়ারশিপ ডেটা বলছে বাংলার ঘরে ঘরে টেলিভিশন সেটগুলিতে ধারাবাহিক দেখা হয় প্রতিদিন। আবার বহুদিন ধরে শুটিং বন্ধ, বাংলা বিনোদন জগৎ আর্থিক সংকটে, এই প্রসঙ্গে উঠলেও সোশাল মিডিয়ায় অনেকে এসে লেখেন 'ওদের অনেক টাকা'-জাতীয় মন্তব্য। ধারাবাহিকের বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা সব সময়েই থাকবে কিন্তু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রতি বা বিনোদন জগতের মানুষের প্রতি অযৌক্তিক বিদ্বেষ কখনোই কাম্য নয়। কয়েক হাজার পরিবারের রুটি-রুজি জড়িয়ে রয়েছে এই জগতের সঙ্গে।
এই সমস্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরেও কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা বোধ করেন না বিনোদন জগতের মানুষেরা। আর পাঁচটা পেশার মানুষ, সাধারণ মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসছেন দুর্গতদের সাহায্যের জন্য, এঁরাও সেভাবেই এগিয়ে আসছেন নিজস্ব সঞ্চয়ের টান সত্ত্বেও। এই উদ্যোগ নিয়েও কিছু মানুষ কটু কথা বলবেন তা জেনেও। নিজেদের সংকটের দিনেও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরে মানুষের থেকেই উড়ে আসা ঈর্ষাপরায়ণ, যুক্তিহীন, এবং অবাস্তব মন্তব্যে ঠিক কী মনে হয় তাঁদের-- একাধিক কলাকুশলীদের কাছে প্রশ্ন ছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র পক্ষ থেকে। তাঁদের সকলেই একটি কথা বলেছেন-- ''কী আর করা যাবে, আমরা আমাদের কাজ করে যাই।''
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন