দাউদ হায়দার: ধর্মজাতপাত নিয়ে সম্রাট আকবরের কোনও গোঁড়ামি ছিল না, বরং খাঁটি অসাম্প্রদায়িক। ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু ইদানীং ভারতের কিছু অঞ্চলে, কয়েকটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল সম্রাট আকবরকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেছে। গত বছর কলকাতা থেকে একজন ফোনে জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে এবছর শহরে পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ ঢিলেঢালা, জমজমাট নয়। প্রসঙ্গত এও বললেন, একদল কট্টর হিন্দুত্ববাদী ফতোয়া দিচ্ছে, বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক আকবর, তিনি মুসলিম, অতএব সাচ্চা হিন্দুর উচিত বর্জন।
এতদিন জানতুম, বাংলার হিন্দুমুসলমানের সবচেয়ে সেকুলার উৎসব বাংলা নববর্ষ। হিন্দুমুসলমান সব এক, ভেদ নেই। বাঙালি। জলহাওয়া, আনাজপাতি, মাছ, গাছগাছালির ধর্ম নেই যেমন। সম্প্রতি গরু ও দুধ নিয়ে ধর্মের বাহাস।
বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক কে, এই নিয়ে বাঙালির ঘিলু খামচানোর স্বভাব নেই। ছিল না। বাংলা নববর্ষ মূলত এথনিক কালচার। বাংলার মাটি ভূমির। শহুরে কালচার নয়। গ্রামেগঞ্জে দেখেছি পয়লা বৈশাখের আগে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। ‘চড়কমেলা’ নামেও অঞ্চলভেদে পরিচিত। মেলায় হিন্দুমুসলমান একত্রে সমবেত। মেলা উপলক্ষে উৎসব। নানা পসরা সাজিয়ে হাট, বিক্রিবাট্টা। গ্রামীন বাণিজ্য। অর্থনীতি। দোকানে, বাজারে হালখাতা। গতবছরের খেরোর খাতায় বাকি, পাওনা, হিসেবনিকেশ। নতুন বছরে আবার শুরু। এথনিক কালচার।
গ্রামীন সংস্কৃতি গোল্লায় যাচ্ছে, কর্পোরেট ব্যবসা গিলে খাচ্ছে। আধুনিক সংস্কৃতির প্রচন্ড দাপট। হাতে স্মার্ট ফোন। গান শোনে কানে। ছবি দ্যাখে। হোয়াটসআপে, ফেসবুকে, টুইটারে যোগাযোগ। গ্রামে গাজন প্রায় বিলুপ্ত। নদীতে মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালি গান নেই। আব্বাসউদ্দীন, শচীন দেববর্মনের গান শুনতে হয় সিডিতে বা ইউটিউবে। স্মৃতি উথলে ওঠে। বাংলার নদী, রূপ ক্রমশ বিলীন। পহেলা বৈশাখে, নববর্ষে এখন শহর থেকে কেউ গ্রামে যায় না। যেত গত শতকের পঞ্চাশ দশকেও। গ্রামের বাড়িতে বাবা মা আত্মীয়স্বজন অপেক্ষারত নববর্ষে শহর থেকে সন্তানাদি আসবে, সবাই পারিবারিক নববর্ষ উদযাপন। গ্রামের পরিচিত মানুষের সাথে দেখাসাক্ষাৎ, কুশলাদি বিনিময়। নানারকম খাওয়া, হরেক মিষ্টি, পিঠেরও আয়োজন। এবং নতুন বছরের জন্যে আশীর্বাদ।
বাংলার হালখাতা নিয়ে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (আর কে গুপ্ত নামেও পরিচিত। ‘সাটুল গুপ্ত’ বন্ধুকুলে)-র একটি লেখায় আছে: “গ্রামবাংলায় এবং শহরগঞ্জে হালখাতায় যার নামে বাকি নেই, তিনি বুক উঁচিয়ে চলতেন না।”
হালখাতার বালাই কবে থেকে উধাও, অজানা। হালখাতা মানেই ব্যবসায়ীর দোকানে যাওয়া। বাকি পরিশোধ, মিষ্টি খাওয়া, ডাবের জল খাওয়া। খেয়েদেয়ে আবার বাকি নেওয়া। হালের খাতায় নতুন হিসেব। হালখাতা।
পুরোনো ঢাকায়, গ্রামেগঞ্জের কিছু অঞ্চলে এখনও টিকে আছে। তাও থাকবে না। নতুন প্রজন্মের হাতে ব্যবসা। বাকির বদলে নগদ। বড়ো বড়ো ব্যবসা ও ব্যবসায়ীর মধ্যে ভিন্ন লেনদেন। কিস্তিতে পরিশোধ। কেউ কেউ ঋণখেলাপি। দেউলিয়া।
কলকাতার বইপাড়ায়, কলেজ স্ট্রিটে হালখাতার চরিত্র আলাদা। লেখক হাজির হলে রয়ালটি বাবদ প্রাপ্য, যতটুকু সম্ভব পরিশোধ। সব প্রকাশক অবশ্য নয়। গেলে মিষ্টিমুখ। ক্রেতাও পান। ঢাকায় এই কালচার নেই। সরকারি ছুটির দিনে ছুটি উপভোগ।
১৯৬৭ সাল থেকে নববর্ষ আবাহনে নব্যরূপ, ঢাকার রমনা পার্কে। সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের উদ্যোগে। আয়োজক ছিলেন সঙ্গীত বিশারদ ওয়াহিদুল হক, রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা সনজিদা খাতুন, আরো দু’য়েকজন। সকালে অনুষ্ঠান। তিনচারটে রবীন্দ্রসঙ্গীত। গোটা পাঁচছয় কবিতাপাঠ। পুরো অনুষ্ঠান একঘণ্টাও নয়। আর, গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে? রমনা পার্কে (সোহরওয়ার্দি উদ্যান নামে এখন পরিচিত) ভোর থেকে তিল ধারনের জায়গা নেই। আশেপাশের রাস্তায়। মাঠেও। কেবল গানবাজনা, হরেক অনুষ্ঠানাদিই নয়, নানারকম পসরা সাজিয়ে বিক্রিবাট্টা। তাঁতের শাড়ি থেকে শুরু করে ঘুঙুর, মাটির বাসনকোশন, চুড়ি, টিপ মায় নোলকও। বাংলার ঐতিহ্যের গহনা। তৈজস। পুরুষের পরনে বাহারি পাঞ্জাবি। রঙবেরঙের মুখোশে শোভাযাত্রা। নামকরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলার এথনিক কালচারের মেলা। সমারোহ।
কার মাথা থেকে বুদ্ধি গজিয়েছিল নববর্ষের প্রথম দিনে ইলিশ পান্তা খাওয়া? রহস্য। ইতিহাসে লেখা নেই। গুঞ্জরণ এই, একজন গরিব এক হাঁড়ি পান্তা ও ইলিশ ভাঁজা নিয়ে মাঠের এক কোণে বসে সানকিতে বিক্রীর আয়োজন করে। খাদকের জটলা। চাহিদা। বিক্রেতা অসম্ভব দাম হাঁকে। হাভাতেরা চড়া দামে কেনে। খায়। পরের বছর থেকে শুরু হয় পান্তাইলিশ বা ইলিশপান্তার কালচার। ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। হুজুগে বাঙালি। নববর্ষের আগের দিনে, নববর্ষের দিনে ইলিশের দাম আকাশছোঁয়া। পান্তাইলিশ না খেলে নববর্ষের স্ফূর্তি, আমেজ নেই।
পৃথিবীর নানা দেশে মার্চের শেষে এপ্রিলের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে নববর্ষ উদযাপন। এথনিক কালচারের প্রকাশই মুখ্য। তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যে দেখেছি “নওরোজ” ( নতুন বছর। অঞ্চলভেদে নাম ‘নয়রোজ’ ‘নিউরোজ’) উপলক্ষে তিনদিন/সাতদিনব্যাপী বিশাল মেলা, উৎসব। মুসলিম দেশে গানবাজনা নাচ তো আছেই, মেয়েরা উলুধ্বনিও দেয়। মিশরে জিজ্ঞেস করেছিলুম উলুধ্বনির রহস্য। শুনি: ‘এটা তো আমাদের কালচার। বিয়েতেও আছে। এসেছে ইরাকের বেবিলন থেকে, কম করেও দশ হাজার বছর আগে।’
বৈশাখে নববর্ষ আবাহন, উৎসব, উদযাপন কেবল বাংলায় নয়। ভারতের আসামে (যেমন বিহু নাচ, নাচের উৎসব), উত্তর প্রদেশেও। শিখদের বৈশাখী মেলা, উৎসব। বৌদ্ধদের বৈশাখী পূর্ণিমা, উৎসব। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশগুলোয়। বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শনে। বার্লিনে এথনিক কালচারের নামে পাঁচদিন মেলা। নাম: কার্নিভাল জ্যের কুলট্যুরেন।
বাংলাদেশে উগ্রবাদী ইসলামিক মৌলবাদীরা জিগির তুলেছে, নববর্ষ হিন্দু কালচার। মেয়েরা কপালে টিপ পরে, হিজাব পরে না মাথায়, অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। ইত্যাদি। ধর্মের লেবাসে, রাজনীতির মোড়কে বাংলার এথনিক কালচার, হিন্দুমুসলিম মিলন নস্যাতে গভীরগোপনে তৎপর।
পহেলা বৈশাখের ইংরেজি তারিখ নিয়ে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গে ঝামেলা। বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল, পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল। ঢাকার বাংলা একাডেমির বাংলা তারিখ-মাস-বছর বিশেষজ্ঞরা বিস্তর ঘেঁটে ঠিক করেছেন এপ্রিলের ১৪ তারিখই বাংলার নববর্ষ। লেখালেখি করে জানিয়েছেন তারিখ নির্ভুল। পশ্চিমবঙ্গের পাঁজিপুঁথিইতিহাসবিদকুল কেন ১৫ এপ্রিল আঁকড়ে আছেন, বাংলাদেশের ১৪ তারিখ কেন খণ্ডন করছেন না, চুপ, প্রশ্ন উঠছে। বাংলা নববর্ষের সঠিক তারিখ নিয়েও রাজনীতি? পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ব রাজনীতি? বাংলাদেশের মুসলিম রাজনীতি? এথনিক কালচারের রাজনীতি? দুই বাংলার এথনিক কালচারে, মানবমিলনে?
করোনার কারণে গতবছর এবং এবছর দুই বাংলার মানুষ বার্লিনে একত্রিত নই। সব অনুষ্ঠান বরবাদ। উৎসব, মিলনে হা-হুতাশ। বার্লিনের বহুমান্য গায়ক মাঈন চৌধুরী, ছায়ানটের শিল্পী গান বেঁধেছেন: “সহে না যাতনা/ দূর হ করোনা।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন