আমি কি বাঙালি? পৃথিবীটা নাকি বহুদিন আগেই এক ছোট্ট গ্রাম হয়ে গেছে। গ্লোবাল ভিলেজ। তবু তার মধ্যে আমি কলকাতা থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরে থাকলেও তো বাঙালি। কিন্তু আমি কি অন্য সতীর্থ বাঙালির নিন্দা করি? আমি কি আমার প্রতিবেশী, বন্ধু বা পরিচিত বাঙালিদের সাফল্যে ঈর্ষাকাতর? বাঙালি কাঁকড়ার গপ্পোটা মনে পড়লেও বলছি না, ওটি অতি ব্যবহারে জীর্ণ। ক্লিশে। মূল প্রশ্নটি হলো, অভ্যন্তরীণ কলহেই কি বাঙালির সন্তুষ্টি?
আমরা কথায় কথায় জাত বিচার করি। বলতে ভালোবাসি, পাঞ্জাবিরা এমন, 'হিন্দুস্তানি' এমন, দক্ষিণীরা এরকম, বাঙালিরা এরকম। সমাজবিজ্ঞান বলে, ঘরোয়া আড্ডার ভাষা দিয়ে একটা জাতির বৈশিষ্ট্য নিরূপণ অবৈজ্ঞানিক। বাঙালি আবেগপ্রবণ। বাঙালি মাছ খায়, তাই বুদ্ধি বেশি। সর্দার রুটি খান, গায়ে শক্তি আছে, ব্যবসায়ী মন আছে, কিন্তু সৃজনশীল শিল্পী মন কই? এসবই হল চটজলদি সাধারণীকরণ (সুইপিং জেনারেলাইেজশন)। কিন্তু এটাও ঠিক, দীর্ঘসময় নিয়ে দেখতে দেখতে, একটি ভৗেগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের বৈশিষ্ট্যকে সুনির্দিষ্ট করা যায়ও বটে।
যেমন আমরা চিনে এবং আমেরিকান বা ব্রিটিশদের স্বভাবের ফারাক নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করি। 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য' গ্রন্থে খোদ স্বামী বিবেকানন্দ কম করেন নি বলা হয়, ব্যতিক্রম আইনের সত্যতার প্রমাণ দেয়। এই সূত্রে অমৃতা প্রীতম বা বলরাজ সাহনি শিল্পী হয়ে ওঠেন, পাঞ্জাবি হয়েও। হরকিষণ সিং সুরজিৎ ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা না করে, হয়ে যান কমিউনিস্ট।
এবার করোনা দুর্যোগে যখন একদিকে দিল্লি বনাম কলকাতা রাজনৈতিক তরজা চলছে, তখন দেখছি বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের রােজ শয়ে শয়ে রাজ্যে আসার বিষয়ে, হয় তৃণমূল, নয় সিপিএম, নয় বিজেপি-র হয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষােরোপ করছে। আরও মজার বিষয় হলো, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেরা একে অন্যকে সমালোচনা করছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ করছে। করোনাই হোক বা আমফানের মতো ঝড়, এখানে সমস্যার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে কদর্য রাজনীতি। ঝড়ে বিদ্যুৎ নেই বাড়িতে। মমতা তো মুসলমান পাড়াগুলােতে বিদ্যুৎ দিচ্ছে, ঈদের সময় তো, তাই। আবার বিজেপি-অমিত শাহ রাজ্যে ট্রেন পাঠিয়ে করোনাভাইরাস ছড়াতে চাইছে এ রাজ্যে, দিলীপ ঘোষ-মুকুল রায়রা সব জানে। এসব হলো বিজেপি-র ষড়যন্ত্র।
সেনা আনতে দেরি হয়ে গেল কেন মমতার-দুদিন? কংগ্রেসের রাজ্য নেতা মমতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। সিপিএম নেতারা বলছেন, ঝড় হয়েছে, রাস্তায় জল জমছে কেন? রেলে আসার সময় মায়ের মৃত্যু, শিশু সন্তান জানে না মা নেই। প্ল্যাটফর্মে ভাইরাল হয়ে যাওয়া সে ছবি নিয়েও কলকাতা উত্তাল। কংগ্রেস-সিপিএম বলছে, মানবতাবাদের প্রশ্ন এটি। রেলমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিতে হবে। আর দিলীপ ঘোষ বলছেন, এটি ছোট ঘটনা। রাজনীতি হচ্ছে।
সব দলের নেতারাই বলছেন, রাজনীতি হচ্ছে। আমি ভাবছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগেও এতটা পারস্পরিক রাজনৈতিক কলহ, এক একটা জার্সি গায়ে দিয়ে মারামারি, হতে পারে? সর্বভারতীয় ঘটনা, তবু বাঙালির অভ্যন্তরীণ কলহ, কটু মন্তব্য বর্ষণ কি মানুষের বেদনা, ভাইরাসের আতঙ্ককেও ছাপিয়ে যাচ্ছে?
দেখুন, বাঙালির এই পারস্পরিক ব্যঙ্গবিদ্রূপ, কাদা ছোড়াছুড়ির একটা ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ জমানায় কলকাতার ধনী শহুরে পৌরপিতারা 'বসন্তক' নামে এক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকাতে এক পুরপিতা অন্য পুরপিতার কেচ্ছা ছাপতেন। ব্রিটিশ শাসকরা তখন লন্ডন থেকে বহু পত্রিকা প্রকাশ করে ভারতীয়দের সম্পর্কে লিখতেন। ভারতীয়রা স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা লিখবেন, এই উদ্দেশ্যেই বসন্তক প্রথম প্রকাশ পায়। পরে দেখা যায়, এই পত্রিকা বাঙালিরই নিন্দা করছে বেশি।
দুর্ভিক্ষের সময়ও এই পত্রিকার এক পুরপিতা অন্যজন সম্পর্কে কী বলছেন শুনবেন? বলছেন, "আমাদের বাঙালি বাবুদের মনের মতো হওয়া বড় দুষ্কর। এদের কিছুতেই আর মনের তৃপ্তি হয়না। ইংরাজেরা যা কচ্চে; এমন কস্মিনকালে কোন রাজাই পারে না, বিশেষতঃ প্রজার সুখের দিকে দৃষ্টিপাত এত কার ছিল? বিদ্যালয়, ডাক্তারখানা, রাস্তা, ঘাট ইত্যাদি সকল বিষয় কত উন্নত, কত সুবিধা হয়েচে; দেখুন পাবলিক ওয়ার্কার্স ও মিউনিসিপ্যালিটি পথ ঘাট বাড়ি ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত রয়েচে, তা এর প্রতি কারো লক্ষ্য নাই।" নাম প্রকাশ না করে কথোপকথনের ভঙ্গীতে আরও তীব্র সমালোচনা হয়েছে।
হ্যারিসন সাহেব মেয়র, তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর নামে হ্যারিসন রোড (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড) হয়। স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন বলে অভিযোগ করা হয়। এমন বলা হয়, সাহেবকে খুশি করে পুর রাজনীতিতে অংশ নিয়ে তিনি নিজেদের বিষয় সম্পত্তির ওপর ধার্য ট্যাক্স কমান। বাড়ির পাশেই কলের জল, গ্যাসের আলো আর ঘোড়ার আস্তাবলের ব্যবস্থা করেন। পরে জানা যায়, এসব অভিযোগ ছিল অসত্য। সুরেন ব্যানার্জির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠায় তার ফায়দা নিচ্ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তিই। বাঙালির এই কলহ তাই ঐতিহাসিক। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস যখন মেয়র ছিলেন, তখন বিধান রায়কে ভােটের প্রার্থী করা নিয়েও বাঙালির অন্তঃকলহ আজ লিখিত ইতিহাস। অপ্রিয় সত্য।
আমি নিজে তো আজ করোনাভাইরাস নিয়েই চিন্তিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-অগাস্ট মাসে এই ভাইরাস সংক্রমণ এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছবে। পরিযায়ী শ্রমিককে বাংলায় আসতেও দিতে হবে, আবার যেভাবে তাঁরা মুম্বই বা হায়দ্রাবাদ বা দিল্লিতে একসঙ্গেই ভিড় করে ট্রেনে উঠছেন, বাসে উঠছেন, তা দেখে এটা তো বোঝা যায়, সামাজিক লকডাউন বলে কোনও পদার্থই নেই সেখানে। এই সমস্ত শ্রমিক বা বিমানে আসা মানুষ মধ্যবিত্ত সমাজে ১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে থাকছেন কিনা, সেসব কে দেখছে?
বরং আরএসএস-এর মতো সংগঠনের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তাদের কোনও রাজনৈতিক বিবৃতি দিতেও আমি দেখি নি। আরএসএস-এর অধীনে আছে অনেকগুলি সামাজিক সংগঠন, তারা ট্রেনে শ্রমিকদের জন্য খাবারের প্যাকেট দিচ্ছে। ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও কাজ করছে। আবার রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম বা ভারত সেবাশ্রম সংঘ সুন্দরবনে গিয়েও কাজ করছে। কংগ্রেস বা সিপিএম বা রাজ্য বিজেপি নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগত ভাবে কিছু করলেও সেভাবে কাউকেই দলের পক্ষ থেকে ত্রাণের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ দিল্লির বাংলােতে সুখে দিন কাটিয়ে ভিডিও বিবৃতি দিয়ে নিজের প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করছেন। কেউ হাফপ্যান্ট পরে একটি গাছ কাটার ছবি তুলে নিজে খবর হচ্ছেন। আবার প্রতিপক্ষ তাঁর হাফপ্যান্ট পরা নিয়েও বসন্তক স্টাইলের নিন্দা করতে ছাড়ছেন না।
এই কলহপ্রিয়তা কি তবে বাঙালির বৈশিষ্ট্য? কেউ বলতে পারেন, বাঙালির সজীব মস্তিষ্ক। রসবোধ ও রাজনৈতিক সত্ত্বা তীব্র। তাই এত তু-তু-ম্যায়-ম্যায়। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, হাতে ইলিশ, এই ছবিটি বেশ শান্তশিষ্ট বাঙালির। সে ছবিতেও আসলে আছে এক চাপা বিদ্রূপ। কিন্তু আজ এই দুর্যোগে সেই ধুতি সামলাতেই কি বেশি ব্যস্ত বাঙালি? বাঙালির মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছে সেই পরশ্রীকাতর ব্রিটিশ ভক্ত পানুবাবুর চরিত্রটি, নির্ভীক গোরা সম্পর্কে যিনি ছিলেন ঈর্ষান্বিত?
দুঃখ হয়, এই চেঁচামেচি প্রতিদিন হয় বাংলাতে। করোনার জেরে সামনের বছর আদৌ ভোট হবে কি হবে না তাই বুঝতে পারছি না। কারণ ভোট করার আগে ভোটার তালিকার সংশোধন প্রয়োজন হয়। সেসব এখন নির্বাচন কমিশন করবে কী করে? রুটিরুজিই মানুষের বন্ধ, স্বাধীনতার পর এদেশে এত বড় দুর্যোগ কখনও আসে নি। একদা বাণিজ্য বিস্তারের নামে ইংরেজ হানাদারেরা ভারতে এসেছিল সমুদ্রপথে। মাদ্রাজ উপকূলে এবং তারপর গঙ্গা নদী হয়ে প্রাথমিক উপনিবেশ স্থাপন করে। ভারতের রাজধানী দিল্লি করতে তাদের অনেক সময় লেগেছিল (১৯১১)। কলকাতার মতো এক ক্ষুদ্র শহরে তাদের রাজধানী স্থাপিত হয়। আর তাতে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি হয়। বাংলায় নবজাগরণ হয়। ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিকতারও শুরু কলকাতায়। পরে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বাংলাকে অনেক পিছিয়ে দেয়। নীরদচন্দ্র চৌধুরীও সেকথা বলেছেন।
রাজা রামমোহন রায়েরও সমাজে নিন্দায় কান পাতবার জো ছিল না। তাঁকে বিধর্মী বলা হয়েছিল। তবে অতীতকে বিলোপ না করে আধুনিক ভারত নির্মাণে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। আমরা বাঙালিরা আজও সেই প্রগতিশীলতা নয়, কলহপ্রিয় পরনিন্দা-পরচর্চায় পশ্চাৎমুখীতায় আক্রান্ত। এই স্বার্থান্বেষী ভােটের রাজনীতি আর ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ও পাল্টা চেষ্টায় কি বাংলার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল স্বর্ণময় হতে পারে?
এখন ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আমফানে পশ্চিমবঙ্গ আজ বিধ্বস্ত ও ত্রস্ত। সমস্ত সঙ্কীর্ণতা ভুলে আজ আমাদের উচিত, হাতে হাত মিলিয়ে রাজ্যের আর্ত মানুষের সেবা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন