১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকায় ১১ টি তরুণ প্রাণ মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়েছিল, ভারত রাষ্ট্রে। ১৯৭২ ও ১৯৮৬ সালে আরও তিন তরুণ প্রাণ আত্মবলিদান দেয় সেখানে। তারও আগে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন মানুষ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের বাইরে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। দুটো ক্ষেত্রেই মাতৃভাষার নাম বাংলা। চাপিয়ে দেওয়া ভাষা যথাক্রমে অসমিয়া ও উর্দু। এ লড়াই দুটো ভাষার লড়াই নয়, বরং আধিপত্যবাদের লড়াই।
স্বাধীনতার পর পরই বাংলা ভাষা আসামের আধিপত্যবাদের শিকার হয়। ১৯৪৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই, রাজ্যপাল আকবর হায়দারি, সাংসদ নীলমণি ফুকনরা চেষ্টা করতে লাগলেন, কীভাবে বাংলা ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করা যায়। তারই জেরে ১৯৬০ সালে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব নেওয়া হয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বাঙালিরা আক্রান্ত হন। প্রায় এক থেকে দেড় লক্ষ বাঙালি আসাম ছাড়তে বাধ্য হন। নয় জন বাঙালি নিহত হন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চলিহা পুনরায় প্রস্তাব আনেন, অসমিয়া হবে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা। এ সবের বিরোধিতা চলতে থাকে, মূলত বাঙালিরাই করেন। এসবের ফলে শিলচরে ১৯৬১ সালের ১৯ মে ১১ জনকে আসাম সরকারের পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। সে সব ইতিহাস।
কেন এই পুরনো ইতিহাস ঘাঁটি আমরা? কেনই বা আত্মবলিদানকে স্মরণ করি? সে কি শুধু বাংলা ভাষার জন্য? পুরনো ইতিহাস মনে করতে হয়, আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে বোঝার জন্য। স্বাধীনতার পর আসামে যে এনআরসি হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, বহু এলাকায় তা কার্যকরী করা হয়নি, যেখানে যেখানে অসমিয়াভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এমন 'ছোট্ট' ঘটনায় বোঝা যাবে, আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও রাজনীতির কদর্য রূপ। আত্মবলিদান স্মরণ করা হয় এই কারণে যে তাঁরা শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় পাননি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করেছেন, নিরস্ত্র সংগ্রাম কিন্তু বীরের লড়াই। কোন ভাষার জন্য লড়েছিলেন তাঁরা, তা একটি নিছক তথ্যমাত্র। ঘটনা হলো, তাঁরা লড়েছিলেন মাতৃভাষার জন্য, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন।
মাতৃভাষা সহজাত। অন্য ভাষা অর্জন করতে হয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় আমি মনের ভাব মাতৃভাষার মতো ব্যক্ত করতে পারি না। তাছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষরা একটিমাত্র ভাষা জানেন, তা হলো তাঁর মাতৃভাষা। অসমিয়াকে বা উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা করলে বাঙালি রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ওই ভাষার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রাষ্ট্রের আদেশনামা পড়তে পারবেন না, বুঝতে পারবেন না; সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অসমিয়াদের থেকে পিছিয়ে পড়বেন তাঁরা। মাতৃভাষা কেড়ে নিলে জীবনের প্রায় সব দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। এ হলো শাসিতের উপর শাসকের চরম আক্রমণ। সাদা চোখে এই আধিপত্য বোঝা সহজ নয়। যেমন সাঁওতালরা বাংলার আধিপত্য মেনে নিয়েছেন, বাধ্য হয়েছেন। ভাষাগোষ্ঠীর সংখ্যালঘুরা গরিষ্ঠের শাসন মেনে নেন। আসামে কিন্তু বাঙালি সংখ্যালঘু ছিল না, যেমন পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুভাষী ছিল হাতে গোনা।
আসামে শাসক চেয়েছিল বাংলার জায়গায় অসমিয়া চালু করতে। অন-অসমিয়াদের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিতে। আর তার জন্য চাই মাতৃভাষার উপর আঘাত হানা। ঠিক তাই করা হয়েছিল।
আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু তিনটি জিনিসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় - ভাষা, চিন্তন ও জগৎ। ভাষা ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। মাতৃভাষায় আমরা চিন্তা করি, কল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি। ভাষা ছাড়া চিন্তন অসম্ভব। চিন্তনের একটি মূল জায়গা হল জগৎ বা 'ওয়ার্ল্ড'। ভাষার উপর আঘাত হানতে পারলে চিন্তার জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করা সম্ভব হবে, আর সেটা সম্ভব হলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জগতকে বুঝতে পারবে না মানুষ। সে পঙ্গু হয়ে পড়বে। প্রশ্ন করবে না, শাসিত ও শোষিত হবে বিনা প্রশ্নে।
ভাষার এই সংগ্রাম শুধু বাঙালিদের একচেটিয়া, এরকম মনে হতে পারে। না। তামিল, কন্নড়, মালয়ালম, কোঙ্কনি ভাষা নিজেদের অধিকারের জন্য দশকের পর দশক আন্দোলন করেছে। সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার তকমা পেতে মৈথিলি, কোঙ্কনির বহু সময় লেগেছে। সাঁওতালিকে জনজাতি ভাষার মর্যাদা দিতেও দেরি করা হয়েছে অনেক।
আজ ১৯ মে। কয়েক দিন আগেই গেল ২১ ফেব্রুয়ারি, মাতৃভাষা দিবস। ভাষার এই যুদ্ধ হলো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। শাসকের দৃশ্য-অদৃশ্য শেকল কাটার লড়াই। আর তার নাম 'মুক্তিযুদ্ধ'। আজ স্মরণ করি ১১ জন শহীদ ভাষারোহীকে, শ্রদ্ধায় ও চিন্তায়।
(লেখক ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ও দর্শনের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন