আসাম দুটি নদীবিধৌত উপত্যকায় বিভক্ত। বরাক উপত্যকা আর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা। দুই উপত্যকাতেই অসমিয়া এবং বাঙালিদের মধ্যে চিরকালীন একটা সংঘাতের পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। ১৮৭৪-এ যখন শ্রীহট্ট এবং গোয়ালপাড়াকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো, এই জুড়ে দেওয়াটা বাঙালি এবং অসমিয়া, কেউই ঠিকভাবে নেন নি। কারণ যে 'অ্যাসিমিলেশন'টা হওয়ার কথা ছিল, সেটা এই দীর্ঘ সময়ে ঘটেনি। দুপক্ষ দুপক্ষকে অবিশ্বাস করেছে। এটা বাস্তব সত্য। এটা কখনোই নয় যে বাঙালিরা ভীষণ আগ্রাসী এবং অসমিয়ারা আধিপত্যবাদী। উল্টোটাও নয়। দুপক্ষ পরস্পরকে অবিশ্বাস করেছে, এবং তার জন্যে আশেপাশে অবিশ্বাসের উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছিল।
পাশাপাশি উল্টো দিকে ১৯০৫-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও কিন্তু কলকাতা এবং ঢাকা কেন্দ্রিক বঙ্গসমাজের দাবিদাওয়ার মধ্যে অবিভক্ত বাংলার এই অঞ্চলগুলি বাদ পড়ে যায়। বাংলার একটি বিস্তৃত অংশ বাংলার বাইরেই পড়ে থাকল প্রথম বঙ্গভঙ্গের অনুচ্চারিত বেদনার ইতিহাস নিয়ে। বাংলা এবং আসাম, দু'জায়গাতেই অবহেলিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাদৃত হয়ে। পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি নিয়েই এক বিস্তৃত অঞ্চলের বাঙালির পরিচয় হয়ে গেল আসামে বসবাসকারী বাঙালি হিসাবে।
স্বাধীনতার সময়ে একমাত্র সিলেটে রেফারেন্ডাম হয়েছিল। সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরে যেটা হলো, উদ্বাস্তু বাঙালির সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেল। অসমিয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে অসমিয়াদের বুঝিয়েছেন, 'এই বাঙালি ভোট বেড়ে যাওয়ায় তোমরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে, কৃষিকাজের জমি থেকে শুরু করে চাকরিবাকরি, সব জায়গায় শুরু হবে বাঙালি প্রভুত্ব'। অজ্ঞ, নিষ্ক্রিয়, বশ্য একটি জাতিকে হিংসার বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ। ফলে প্রাথমিকভাবে উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সামাজিক, বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক নেতারা। দেশভাগ ও সীমানা নির্ধারণের প্রাক মুহূর্তে তখনকার একমাত্র ইংরেজি দৈনিক ‘আসাম ট্রিবিউন’ লিখল, "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিলেট পাকিস্তানে চলে যাক।" সেই সঙ্গে মন্তব্য ছিল, "দ্য অ্যাসামিজ পাবলিক সিম টু ফিল রিলিভড অফ আ বার্ডেন।"
সীমানা ঘোষিত হওয়ার পর 'শিলং টাইমস' পত্রিকায় এক বিবৃতিতে বলা হয়, "উইথ সিলেট জয়েনিং পাকিস্তান, আসাম হ্যাজ গ্রোন স্মলার ইন এরিয়া বাট অ্যাটেইন্ড গ্রেটার হোমোজেনিইটি, হুইচ হ্যাজ প্রোমোটেড আসাম টু বি ফ্রি অ্যান্ড সোভরেইন।" প্রাক-স্বাধীনতাপর্বে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলই ঘোষণা করেন, "আসাম শুধুমাত্র অসমিয়াদেরই।" ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হলো, সাইনবোর্ডে অসমিয়া লিখতে হবে। এই দিয়ে দাঙ্গার শুরু, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আসামে, মানে ব্রহ্মপুত্র-বরাক উপত্যকায়। বরাক-উপত্যকাকে ওঁরা কখনোই নিজের জায়গা মনে করেন না। বরাক-উপত্যকার মানুষও কখনো ওঁদের নিজেদের লোক মনে করেন না।
১৯৫১ সালের আগুপিছুতে চর এলাকার ময়মনসিংহ মুসলিমরা নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসাবে ঘোষণা করেন সেন্সাসে। একদিকে বাঙালি মুসলিমদের একটা বড় অংশের ১৯৫১ সালের সেন্সাসে নিজেদের অসমিয়াভাষী হিসাবে দেখানো (বায়োলজিকাল মিরাকল), পাশাপাশি সিলেট ভাগের ফলে একটা বৃহৎ অংশের বাঙালির পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায়, অসমিয়া ভাষাভাষীরা আবার সংখ্যাগুরু হয়ে দাঁড়ালেন। ১৯৬০ সাল থেকে দাবি উত্থাপিত হওয়া শুরু হলো, অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করতে হবে। প্রতিবাদে গর্জে উঠলো বাঙালি-অধ্যুষিত কাছাড় জেলা, যা বর্তমানে বরাক-উপত্যকা বলেই বেশি পরিচিত।
আরও পড়ুন: ভাষা শহীদ দিবস কেন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই
১৯৬১ সালের ১৯ মে শহীদ হলেন ১১ জন। তারপরে সে দাবি প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। মেনে নেওয়া হলো, আসামের জন্য আংশিকভাবে ওই অঞ্চলটুকুতে বাংলা চালু থাকবে। ভাষা আন্দোলনে গুলি চলার পর এবং ১১ জন শহীদ হওয়ার পর দুটি তদন্ত কমিশন বসেছিল। প্রথমটি, অর্থাৎ সরকারি মেহরোত্রা কমিশনের রিপোর্ট আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। যাঁরা করাতে পারতেন তাঁরা, অর্থাৎ বরাক উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশই, চিরকাল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার রাজনৈতিক নেতাদের ধামাধরা। গণ উদ্যোগে একটি প্রাইভেট কমিশনও হয়েছিল, এন সি চ্যাটার্জি কমিশন নামে, এবং স্নেহাংশু আচার্য, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সেই কমিশনে ছিলেন। তার রিপোর্ট এখন সুলভ।
আজ ১৯ মে। বরাক উপত্যকা তথা সারা বিশ্বের বাঙালিদের আত্মপরিচয়ের অধিকার রক্ষার ইতিহাস-ভূগোল। এতকাল আসামের রাজনীতি আবর্তিত হতো অসমিয়া এবং বাঙালির দ্বন্দ্বকে ঘিরে। দীর্ঘদিনের কংগ্রেস একাধিপত্যের যুগে অসমিয়া-বাঙালি সংঘর্ষে কাঁপত আসাম। বাঙালি বিদ্বেষ থেকেই উদ্ভব হলো অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) এবং তার রাজনৈতিক শাখা অসম গণ পরিষদের (এজিপি)। কংগ্রেস এবং এজিপি-র মধ্যে কে কত বড় বাঙালি-বিদ্বেষী, সেটা প্রমাণ করার তাগিদ ছিল দু'পক্ষেরই। 'আসাম ফর অ্যাসামিজ' স্লোগানে তখন উত্তাল আসাম। দুই রাজনীতির জাঁতাকলে তখন পিষ্ট হচ্ছে বাঙালি হিন্দু সত্তা। বাঙালি মুসলিম অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই সেন্সাসে নিজেদের মাতৃভাষা অসমিয়া লিখিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে আসাম চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। মুসলমানেরাও বুঝতে পারেন, নিজেদের রাজনৈতিক দল ছাড়া আত্মরক্ষা অসম্ভব। প্রথমে ইউ.এম.এফ, এবং পরে এআইইউডিএফ তৈরী হয়। কংগ্রেস ক্রমশ চোরাবালিতে তলাতে থাকে। ক্ষমতায় এসে অসমিয়া এবং বাঙালি, দু'পক্ষকেই হিন্দু-মুসলমান এই দুই মেরুতে ভাগ করতে সক্ষম হওয়াটা বিজেপির প্রথম সাফল্য। ভাষা সাম্প্রদায়িকতার ওপর বিজয় পতাকা প্রোথিত করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা।
আজ অসমিয়াদের জন্য ভারতবাসীর প্রায় অগোচরে দুটি প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। আসাম চুক্তির ৬ নং ধারায় বলা আছে সাংবিধানিক, আইনি, ও প্রশাসনিক সুরক্ষা হিসাবে অসমিয়া জনগণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভাষাগত পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য সরবরাহ করা হবে। অসমিয়া জনগণের জন্য এই ৬ নং ধারা টোপ হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বাঙালি এবং অ-খিলঞ্জীয়া মানুষ আতঙ্কিত। কারণ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক সুরক্ষা নয়, সামাজিক, ভাষাগত পরিচয় এবং ঐতিহ্য রক্ষার বিষয়টিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে ভাষার প্রশ্নটি এখানে বাংলাভাষিদের হাড়ে কাঁপুনি ধরাচ্ছে।
এখানে প্রশ্ন উঠবেই, অসমিয়া কারা? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, খিলঞ্জীয়া বা ভূমিপুত্র কারা? শ্রীহট্ট বা গোয়ালপাড়ার প্রাচীন বাসিন্দা কিন্তু বাংলাভাষী, তাঁরাও কি ভূমিপুত্র নন? ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যারা সেই বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে এসে জমি আবাদ করলেন, তাঁরা ভূমিপুত্র নন? তা ছাড়া ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত রাজ্যের ভূমিপুত্রদের জন্য সিংহভাগ সংরক্ষণ করা শুরু হলে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এই একই দাবি উঠবে। নাগরিক ও অনাগরিক প্রভেদ, আর শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারী (!!!) প্রভেদের পর ভূমিপুত্র ও বহিরাগত নিয়ে সারা ভারতে নতুন করে আগুন জ্বলবে।
এখনও অসমিয়া হোমোজেনিটি এবং অসমিয়াভাষী সংখ্যাগুরুত্ব বিবেচনা করে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা বড় অংশ চান, বরাক উপত্যকা আসাম থেকে আলাদা হয়ে যাক। এ প্রসঙ্গে নিহত সাংবাদিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক পরাগ কুমার দাস বলেছেন, এমন আশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীতে দুর্লভ। মূল ভূখণ্ড (এ ক্ষেত্রে আসাম রাজ্য) চাইছে একটা অংশকে আলাদা করে দিতে, কিন্তু সেই অংশ (বরাক উপত্যকা) আলাদা হতে চাইছে না। সর্বত্র এর উল্টোটাই পরিলক্ষিত হয়। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে এক ভূখণ্ড আলাদা হতে চাইলে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু বরাকের রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্য সমীকরণ আছে, যার বলি হচ্ছেন উপত্যকার মানুষ।
আসামের অন্যতম এবং সর্বজনমান্য বুদ্ধিজীবী হোমেন বরগোহাঞি লিখেছিলেন, "বাংলাভাষী বরাক উপত্যকা আসাম থেকে বেরিয়ে গেলে অসমীয়া ভাষা তার নিজভূমে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আশা করা যায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য রাজ্যগুলি আর বরাক উপত্যকা কোনোদিনই আসামের অন্তর্ভুক্ত ছিল না এসব অঞ্চল বাধ্যতামূলক ভাবে আসামের সাথে ছিল, কিন্তু আসামের আত্মার সাথে তাদের যোগ কোনোদিনই ছিলো না। এই অঞ্চলগুলি আসামের ভূগোলের অংশ হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের নয়।"
কিছুদিন হলো বরাক পৃথকীকরণ এবং তার লুপ্ত ইতিহাস নিয়ে খুব কথাচালাচালি হচ্ছে। পুরোনো দিনের কথা মানেই ইতিহাস নয়। তাছাড়া ইতিহাসের কোনোদিন চূড়ান্ত বৈধতা ছিল না, থাকবেও না। কারণ ইতিহাস সবসময় শাসকদলের পদানুসরণ করে। রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের শেষ আশ্রয় ইতিহাস। তবে লিখিত, মুদ্রিত, বৈজ্ঞানিকভাবে পরিক্ষিত, তথ্যপ্রমাণের কথা আলাদা। তার জন্য নিবিড় গবেষণা শুরু হয়েছে। পৃথক বরাক মানে পৃথক বরাক। পৃথক বরাক মানে বাঙালিস্তান নয়। বরাককে আসাম থেকে পৃথক করার প্রচেষ্টা। এবং তিনটি জেলার সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। আপাতত এটি গুটিকতক স্বাধীনচেতা তরুণ-তরুণীর আত্মসম্মানবোধের বহিঃপ্রকাশ।
ভাষা ও ধর্মের বিভাজন বরাকের লৌহবাসরের ছিদ্রপথ। ফলে ভাষা ও ধর্ম বিষবৎ পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হোক। বরাক এক আজব উপত্যকা। তিনটি জেলার দুটিতে মুসলিম সংখ্যাধিক্য। অথচ রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক নেতৃত্ব মূলতঃ হিন্দুদের হাতে। এবং এই বিরোধ জিইয়ে রাখা হয়। হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস জিইয়ে রাখা হয়। হিন্দুরা ভাবে, পৃথক বরাক হলে মুসলিমরা কবজা করে নেবে। অন্যদিকে মুসলিমরা ভাবে, পৃথক হলে দলে দলে হিন্দু বাংলাদেশি এসে ঢুকে যাবে।
এই সমস্যার সমাধান কী করে সম্ভব? সম্ভব তখনই, যখন ভাষা ধর্মের উপর বিজয় প্রাপ্ত হবে। তা সম্ভব হবে তখনই, যখন রাজনৈতিক দলদাসদের এড়িয়ে চলার কর্মসূচি একটি সর্বজনগ্রাহ্য অবস্থান নেবে। পৃথক বরাক একটি সময়ের দাবি। আবেগের দাবি। কিন্তু আবেগসর্বস্ব ছিল বলে দাবিটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি। এ বিষয়ে আবেগের চর্চার চাইতেও প্রয়োজন, তার সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখা। তার অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, তার জিও-পলিটিকাল, সোশিও-ইকনোমিকাল, তার ইউনিটি-ফ্যাক্টরস খতিয়ে দেখা।
মানসিকতার দিক থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার থেকে বরাক কোন ক্ষেত্রে আলাদা, সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি। বরাক উপত্যকা বহুভাষিক ভূখণ্ড। আন্দোলনে তাঁরা শামিল না হতে পারলে আন্দোলন ব্যর্থ হবে। 'বাঙালি খিলঞ্জিয়া'দের অতিরিক্ত সুবিধার দাবিতে 'আমরা বাঙালি' বা 'বাঙালি পক্ষ' হয়ে উঠবার যুগলক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা, এ সবই ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।
(লেখক চলচ্চিত্র তথা এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন