ওরা ওদের কথা বলতে পারে না। ওরা চরম অসহায়। ওরা ধর্না, মিটিং, মিছিল জানে না। ওরা সম্পূর্ণভাবে বড়দের ওপর নির্ভরশীল। অন্যায়-অবিচারে কান্নাই ওদের প্রতিবাদের ভাষা। কিন্তু ওদের সেই প্রতিবাদ আমাদের কানে বেশিরভাগ সময়ই পৌঁছয় না। ওদের মৃত্যু খবর হয়। কিন্তু অন্য সব ইস্যুর মতো মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ওদের নিয়ে সোরগোল পড়ে না।
দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, "আমার দেশবাসী আমার পরিবার", তখন সেখানেও বিস্মৃতই থাকে ওরা। রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা, সেখানেও ওরা নেই। কারণ ওরা ভোট দেয় না। যদিও ওদের মৃত্যু নিয়ে চূড়ান্ত ও নির্লজ্জ রাজনীতি শুরু হতে দেরি হয় না। সরকার ও বিরোধী, একে অপরকে দোষারোপ করে। কিন্তু শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু মিছিল থামবে কি করে, তা নিয়ে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।
ওরা চূড়ান্ত অবহেলিত!
ওরা অনাহারে, অপুষ্টিতে, বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, মারা যায়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটি, পরিচ্ছন্নতা বোধের অভাব, জল নিকাশের দুরবস্থা - উৎস অজস্র। কিন্তু উন্নতির ভাবনা ও প্রয়োগ বিশ বাঁও জলে।
ওদের মৃত্যু নিয়ে মোমবাতি মিছিল হয় না। ওদের মৃত্যু নিছক এক পরিসংখ্যান হয়ে থাকে। ওরা দুর্ভাগা। ওরা ভারতবর্ষের শিশু। ওদের মৃত্যু এদেশে সবচেয়ে সস্তা, ওদের জন্মের মতোই।
রোগের নাম অ্যাকিউট এনকেফেলাইটিস সিনড্রোম। অতি সম্প্রতি এই রোগেই বিহারের মুজফফরপুরে দেড়শোর বেশি শিশু মারা গেছে। ঘটনার শুরুতেই যদি বিষয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো, তাহলে এই মৃত্যু মহামারীর আকার ধারণ করত না।
অথচ ইঙ্গিত ছিল। সেই ১৯৯০ থেকে এই অঞ্চলটিতে এই রোগের প্রকোপ ও তার প্রেক্ষিতে শিশুমৃত্যুর ঘটনা প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে। স্থানীয় নাম 'চমকি ফিভার'। বর্ষার ঠিক আগে শুরু হয় এর প্রকোপ। মূলত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শিশুরা এতে আক্রান্ত হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার সময়ই পাওয়া যায় না। খুব তাড়াতাড়ি ব্রেন ডেথ-এর শিকার হয় তারা।
এবছর জুনের শুরুতে যখন প্রথম কয়েকজন আক্রান্ত হয়, তখনই তো সরকারি স্বাস্থ্য দফতরে এর রেকর্ড ছিল। বোঝা উচিত ছিল, বিষয়টা দু-একজনের মধ্যেই থেমে থাকবে না। তার মানে রেকর্ড পর্যবেক্ষণ বা বিশ্লেষণ করা হয় নি। কী করেই বা হবে? এমন মারাত্মক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পাণ্ডে তখন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে যান অন্য একটি ইভেন্টে যোগ দিতে। অর্থাৎ নিজের রাজ্যের এক বিরাট সংখ্যক শিশু যে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে, সেটা তাঁর কাছে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। অবহেলাটা শুরু হয় তো এখান থেকেই।
অবহেলা। হ্যাঁ, সামগ্রিকভাবে অবহেলা, দায়িত্ববোধের অভাবকেই দায়ী করেছে দিল্লীর এইমস-এর অনুসন্ধানী দল। এইমস-এর এই দলটি বিহারের মর্মান্তিক শিশুমৃত্যুর জন্য সরকার ও প্রশাসনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ওঁরা মুজফফরপুরের ওই অঞ্চলটিতেও যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, অঞ্চলটিতে জল নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। নেই ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করেন মৃত শিশুদের পরিবারগুলি। সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। গত ১০ বছরে একই রোগে ১,৩৫০ জন শিশু মারা গেছে এখানে। এরপরও কী করে হাত গুটিয়ে বসে ছিল সরকার? প্রসঙ্গত, এ বছর ১২টি জেলার ২২২ টি ব্লকের শিশুরা আক্রান্ত হয়েছে এই মারাত্মক রোগে।
অবহেলা, অবজ্ঞা প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, এই রাজ্যেরই একদা স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য। সাল ২০০২। সেপ্টেম্বর মাস। অকুস্থল কলকাতার বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল। "এক দিনে ১০ জন শিশু মারা যাওয়াটা নতুন বা অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়," বলেছিলেন তিনি। যখন এটা বলছেন, তখন চারদিনে ১৮ জন শিশু মারা গেছে ওই হাসপাতালে। এমন এক স্পর্শকাতর বিষয়ে সূর্যকান্ত মিশ্রের এই 'স্টেটমেন্ট' ঠিক কতটা মানবিকতার পরিপন্থী ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের পরিকাঠামো ব্যবস্থার ত্রুটির কথা রিপোর্টে উল্লেখ করেন, বলেন যে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও বেড-এর অভাব প্রকট ছিল। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা যাবে না, এমনই নির্দেশ ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। অর্থাৎ বিষয়টি চাপা দিতে হবে। তারও আগে ২০০০ সালে ওই একই হাসপাতালে ৪১ জন শিশু মারা যায়, সেপ্টেম্বরেই। কারণ আজও অজানা।
পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুর মৃত্যুর হার ভারতে প্রতি ১,০০০ জনের মধ্যে ৩৯ জন। লজ্জাজনক ভাবে এই সংখ্যাটি নেপাল ও বাংলাদেশের মতো ছোট ও গরিব রাষ্ট্রের থেকে বেশি। ভারতে কেরালা ও গোয়াতে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম, তুলনা করা যায় ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে। শিশুমৃত্যুর হার বেশি মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহারে। কম যায় না উত্তরপ্রদেশও। উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরে বিআরডি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৭-য় মারা যায় ১,৩১৭ জন শিশু। এক্ষেত্রেও অ্যাকিউট এনকেফেলাইটিস সিনড্রোমই প্রধান কারণ। এছাড়াও পরিকাঠামোগত ত্রুটিও শিশুমৃত্যু ডেকে এনেছে।
২০১৭-র পরিসংখ্যান বলছে, এদেশে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০-এ ৩২, সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রে সেটা ২৪। উল্লেখ জরুরি, আর এক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় সদ্যোজাত শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ৬, যা সারা বিশ্বের সদ্যোজাত শিশুমৃত্যুর যে গড়, তার থেকেও কম। ওদের দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হাজারে ৮, যা ২০১২ থেকে এক জায়গায় থেমে আছে।
একটা হলো স্বাস্থ্য পরিষেবা, আর একটা চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিকাঠামো। শিশুদের ক্ষেত্রে এই দুটো জায়গাতেই প্রচুর গাফিলতি চোখে পড়ে। মুজফফরপুরের কথাই ধরা যাক। অঞ্চলটি দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটে এখানকার বেশির ভাগ শিশুর। অ্যাকিউট এনকেফেলাইটিস সিনড্রোম-এর বিরুদ্ধে যুঝবার ন্যূনতম শক্তিও ওদের শরীরে ছিল না। হাসপাতালে ভর্তির পরও সঠিক যত্ন, মনোযোগ, পরিকাঠামো পায় নি ওরা।
সারা দেশে এমন অসংখ্য মুজফফরপুর আছে। প্রতিদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও বাঁচার ন্যূনতম উপকরণগুলি যোগাড় করতে হিমশিম খেয়ে যান বাড়ির বড়রা। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁদের জন্য অধিকন্তু হয়ে দাঁড়ায় বহুক্ষেত্রে। শিশুর জন্ম বা মৃত্যু, দুটি ক্ষেত্রেই সচেতন ভাবনার অভাব প্রকট। শিশু জন্মের আগে থেকেই অপুষ্টির শিকার হতে থাকে। কারণ তার মায়ের ভাগ্যেও যে লেখা ওই আধপেটা খাওয়া। শিক্ষা দেয় চেতনা। শিক্ষার সুযোগ নেই। চেতনা আসবে কোথা থেকে? স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি তাই প্রবল অবহেলিত। একই ভাবে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে প্রচুর অবহেলা, দায়িত্ববোধ ও মানবিক চেতনার ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যন্ত গ্রাম ও শহরের বস্তি অঞ্চলে পানীয় জল থেকে পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, সব ব্যাপারেই আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আরও বেশি বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র দরকার, যথাযথ পরিষেবা ও পরিকাঠামো সহ।
সেটা না হলে এই মৃত্যু মিছিল থামানো যাবে না।