scorecardresearch

একটি নদীর জন্মবৃ্ত্তান্ত

প্রথমেই বৃষ্টির জলকে যতটা পারা যায় পাহাড়ের গায়ে আটকানো। তার জন্য শুরু হল পাহাড়ের গায়ে গর্ত কাটা। ঢাল ধরে আটহাত দূরে দূরে দুহাত লম্বা, দুহাত চওড়া, দুহাত গভীর গর্ত কাটা শুরু হল। একসারির নিচে আরেক সারি।

River, Birth of River
১৯৭৩ সালে গাছ কাটার বিরুদ্ধে যে চিপকো আন্দোলন হয়েছিল, তাতে মহিলাদের ভূমিকাই ছিল অগ্রণী

পূর্ব হিমালয়ের গাড়োয়াল অঞ্চলে গঙ্গা-যমুনাসহ উত্তরভারতের অনেকগুলি প্রধান নদীর জন্মঘর। ওখানকার মানুষরা এই বিষয়টিকে খুবই ভালোবাসা ও গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। গঙ্গা জাতিধর্ম নির্বিশেষে ওখানকার সমস্ত মানুষদের কাছে এত প্রিয় যে ওই জায়গার যে কোন জলধারাকেই গঙ্গা বলা হয়। চিরকাল। যেমন বিষ্ণুগঙ্গা, ফুলগঙ্গা, কেদারগঙ্গা, বিরহীগঙ্গা। এরকম একটি নদীর জন্মের কথা বলি।

গাড়োয়ালের  পৌড়ি এলাকাটি সমুদ্রতল থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচহাজার ফুট উঁচুতে। প্রচুর বৃষ্টি হবার দরুন এখানে ছিল ঘন জঙ্গল। পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম। শহরের জীবনের জায়গা থেকে দেখলে মনে হবে এরা দরিদ্র। বিজলিবাতি নেই, পাকা রাস্তা নেই, বড় বড় গাড়ি চলে না। দশবারোতলা উঁচু বাড়ি, ট্যাব, এসি কিছুই নেই। কিন্তু এই লোকেরা ভারি শান্তিতে জীবন কাটাতেন। চারপাশে ঘন বন, সেখান থেকে ঘর তৈরির সামান্য কাঠ, শুকনো ঘাসপাতা বা ডাল থেকে, জ্বালানি, নিজেদের ছোট ক্ষেত থেকে জোয়ার বা ভুট্টা উৎপাদন করা, ভেড়া চরানো, এতে নিজেদের প্রয়োজন মিটে যেত।

জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য

বাইরে থেকে আনতে হয় নুন আর কাপড়। সে ক্ষেত্রে টাকাপয়সার চেয়ে বড় সম্পদ হল ভেড়া। বর্ষার আগে ভেড়ার লোম ছেঁটে দেওয়া হয়। তা থেকে মেয়েরা উল তৈরি করে। সেই উলে বোনা কাপড়ই কেবল ওই অঞ্চলের শীতকে জব্দ করতে পারে। এছাড়া ঐ লোম ওজন করে কিনে নিয়ে যায় সমতলের গরম কাপড়ের ব্যবসায়ীরা। নেয় ভেড়ার দুধ, মাংস, চামড়া এমনকি শিং খুরও। গাড়োয়ালিদের মূল ব্যবসা চাষবাস নয়, পশু চরানো। ওখানকার প্রকৃতির জন্যেই এরকম। পাহাড়ের ঢালে ফসল চাষ করা কঠিন। কিন্তু গাড়োয়ালের উচ্চতা, বৃষ্টি ইত্যাদি কারণে এখানে হিমালয়ের অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক কম উচ্চতা থেকেই তৃণভূমি আরম্ভ হয়। এই তৃণভূমিকে বলে ‘বুগিয়াল’। এখানে গাছপালা থাকে না, বছরে পাঁচমাস সমস্তটা বরফে ঢাকা থাকে বলে গাছ বাঁচেনা। বরফ গলে গেলে সতেজ সুস্বাদ ঘাসে সমস্ত জায়গা ভরে যায় বলে তৃণভোজী পশু পালন করার পক্ষে আদর্শ। অধিকাংশ গ্রামই ওপর আর নিচ দুই ভাগে বিভক্ত। পশুপালকরা বছরে ছয়মাস, জুন থেকে নভেম্বর, ওপরে বুগিয়ালে আর বাকি ছয়মাস হাজারখানেক ফুট নিচে নিজেদের পরিবারের সঙ্গে থাকে। এই জীবনে এরা এত অভ্যস্ত যে সারাবছর ঘরে থাকতে ঘুমোতে পারেন না, কষ্ট হয়।নিচের গ্রামে থাকে ছোটরা, মেয়েরা আর বয়স হয়ে যাওয়া লোকেরা।

যে অঞ্চলের কথা বলছি, তার নাম দুধাতোলি। পৌড়ি জেলায়। এখানে পাহাড়ের মধ্যে যেসব ছোট ছোট গ্রাম ছিল, তারাও এরকম করেই জীবন কাটাতেন। নানারকম কষ্ট অসুবিধা থাকত কিন্তু সে আর কোথায় থাকে না। শহরেই কি লোকে সবরকম সুবিধে পায়? শান্তিতে থাকে? নিজেদের সমস্যা এই মানুষরা চিরকাল নিজেদের জ্ঞান আর বুদ্ধি দিয়েই নানামত করে মেটাতেন। তাই সবাইকে সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হত। কিন্তু এমন কিছু বড় সমস্যা দেখা দিল যেটা এঁদের নিজেদের বুদ্ধি বা চেষ্টায় সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। সরকারি ঠিকাদাররা সত্যি-মিথ্যে ‘পারমিট’ দেখিয়ে জঙ্গলের হাজার হাজার গাছ কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। অবশ্য এ সমস্যা শুধু দুধাতোলি বা পৌড়ির নয়, সমগ্র পাহাড়েরই। এই একই কারণে গাড়োয়ালের অন্য অঞ্চলে সত্তরের দশকে ‘চিপকো’ আন্দোলন হয়েছিল।

বর্বর গরিষ্ঠতার শক্তি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল

দুধাতোলিতে গাছ কেটে নেবার পরিমাণ এমন বেড়ে যায় যে স্বয়ং বসুমতীও তার টাল সামলাতে পারেন না। গ্রীষ্ম-বর্ষায় নিচে নেমে আসা পশুপাল জঙ্গলের বড় গাছের নিচের যে ঘাস ও ছোট ঝোপঝাড় খেত, তা গজানো বন্ধ হয়ে যায়। কারণ জঙ্গল কমে যাওয়ার ফলে বর্ষাকালে পাহাড়ের মাটি ধুয়ে ঢাল বেয়ে নামে যেতে শুরু করল। ওপরের নরম মিহি মাটি ধুয়ে গেলে গাছ/ঘাস গজাবে কোথায়? ফলে সেই ছয়মাসও পশুপালকরা ঘরে, মা-বাবা বৌ-ছেলেমেয়ের কাছে ফিরতে পারতেন না। ভেড়া নিয়ে তাঁদের চলে যেতে হত আরো দূর কোথাও। পরিবারগুলো সারাবছরে কখনও একসঙ্গে বাস করতে পারত না। বাচ্চারা দুঃখী হয়ে থাকত।

শেষ পর্যন্ত দুধাতোলির মেয়েরা এই অবস্থাটাকে পালটালেন। উফরেংখাল  গ্রামের ইন্টারমিডিয়েট কলেজের (পশ্চিমবাংলার হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সমতুল্য) একজন মাস্টারমশাই ছিলেন। তিনি ওই গ্রামেরই ছেলে। তাঁর নাম সচ্চিদানন্দ ভারতী। তাঁর বাবা শাকম্ভর দত্ত ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। ছেলে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ফিরে নিজের গ্রামের স্কুলেই যোগ দিলেন। গ্রামের এই কষ্ট দেখে তাঁর খুব মন খারাপ হত। কী করা যায়, কীভাবে এই দুঃখ মনখারাপ থেকে ছাড়া পাওয়া যায়, এই কথা ভাবতে ভাবতে তিনি গ্রামের মেয়েদের আর বয়স্ক মানুষদের ডেকে আলোচনা করতে লাগলেন।

১৯৭৮ সালে ওই স্কুলের উদ্যোগেই তিনদিনের এক পরিবেশ শিবির হল উফরৈংখালে। আশপাশের অঞ্চল থেকে মেয়েপুরুষ মিলে ১৫০ জন সেখানে যোগ দিয়ে নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করলেন। কথা বললেন। তৈরি হল ‘দুধাতোলি লোক বিকাশ সংস্থান’। তারপর ‘মহিলা মঙ্গল দল’। সকলেই একমত হলেন যে জঙ্গল ফিরিয়ে আনা ছাড়া নিজেদের সংসারের এই বিপদ বা দুর্দশা এড়াবার আর কোন উপায় নেই। পুরোন জঙ্গল ফেরানো যাবে না কিন্তু গাছ লাগাতে শুরু করলে অন্তত নতুন জঙ্গল তো পাওয়া যাবে। সেই জঙ্গলই দিনে দিনে পুরোন হবে। কিন্তু গাছ লাগানো হবে কী করে? বীজ  কিংবা চারা পাওয়া যাবে কোথায়? সেই চারা লাগানো হলে তা বাঁচবে কী করে, পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই তো মাটি ধুয়ে যাচ্ছে। জল নেই, ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। কেবল পাহাড়ের পায়ের কাছে একটি ছোট জলের ধারা আছে, খুব অল্প জল চলে বলে লোকে তার নাম দিয়েছে সুখানালা। এই অবস্থায় জঙ্গল বানানোর বা বাঁচানোর উপায় কী? লোকে বলে দশজনের সভার মধ্যে ভগবান থাকেন। মানে, দশজনে যদি কোন কিছু খুব মন দিয়ে চেষ্টা করে তাহলে একটা না একটা বুদ্ধি অবশ্যই পাওয়া যায়। দুধাতোলিতেও হল তাই।

পুরোন মানুষরা বললেন, এসব জায়গায় পাহাড়ের গায়ে জল আটকাবার একটা উপায় ছিল আগে। তাকে বলত ‘জলতালাই’। সচ্চিদানন্দজির বাবাও সমর্থন করলেন সেই কথা। ব্যাপারটা কী তা নিয়ে কয়েকদিন বিস্তারিত আলোচনা হল। তারপর শুরু হল কাজ। জোয়ান ছেলেরা তো নেই, ফলে কাজটা করল প্রধানত মেয়েরা। সঙ্গে ছোটদের মধ্যে যারা একটু বড়, তারাও। বুড়োবুড়িরা সঙ্গে থেকে দেখাশোনা করলেন, যতোটা হয় ঘরের কাজ সামলালেন। কী কাজ?-প্রথমেই বৃষ্টির জলকে যতটা পারা যায় পাহাড়ের গায়ে আটকানো। তার জন্য শুরু হল পাহাড়ের গায়ে গর্ত কাটা। ঢাল ধরে আটহাত দূরে দূরে দুহাত লম্বা, দুহাত চওড়া, দুহাত গভীর গর্ত কাটা শুরু হল। একসারির নিচে আরেক সারি। এরকম করে করে তাদের পাহাড়টির অনেকখানি এলাকা জুড়ে গর্ত কাটল মেয়েরা। নিজেদের ঘরের কাজ, রান্নাবান্না ছেলেপুলে সামলে ওই মাটিকাটা কাজ করে গেল। সচ্চিদানন্দজি তো ছিলেনই তাদের সঙ্গে রোজ, প্রতিদিন। বলতে কি, তিনি সাহস না দিলে বোধহয় মেয়েরা এতখানি সাহস-ভরসা পেত না। তার সঙ্গে এলেন ঐ গ্রামেরই আরো একজন, তাঁর একটি ছোট দোকান আছে গাঁয়ে। অর্থাৎ, কেবল পশুপালক পরিবারগুলি ছাড়া আরো কিছু মানুষ এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন।

গর্ত কাটার সঙ্গে সঙ্গে ছিল গাছের চারা তৈরি করার কাজ। সেও করল মেয়েরা আর বাচ্চারা। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে যোগাড় করতে লাগল নানা রকম স্থানীয় গাছের বীজ। মহিলামঙ্গল দলের সদস্যরা স্কুলের মাঠে সেই সব বীজ থেকে চারা তৈরি করলেন কমবেশি একলক্ষ। গর্ত কাটার কারণ ছিল বৃষ্টির জলকে পাহাড়ের গায়ে আতকানো। সে কাজ হল বর্ষাকালে। একএকটা গর্ত বৃষ্টির জলে অনেকবার করে ভর্তি হল আর প্রতিবারই সেই জল মাটিতে অর্থাৎ পাহাড়ের মধ্যে টেনে গেল। মাটির তলায় জমা হল জল। শেষদিকে গর্তগুলো ভরে রইল জলে। এইবার চারা বসান শুরু হল। গর্তের মধ্যে নয়, তার পাশে। ‘ঐ গর্তে জমা জল যেন গাছবাচ্চাদের মায়ের দুধ। খেয়ে ওরা শিগগির করে বাড়বে’ বলল মেয়েরা। পরপর বাদলে আরো আরো জল গেল পাহাড়ের ভেতরে। ভিজে রইল শুকিয়ে ওঠা মাটি। নতুন নতুন গাছেরা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে লাগল পাহাড় জুড়ে। ঘাস গজাল তাদের পায়ের নিচে, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে।

দশ বছর, বারো বছর। মহিলামঙ্গল দলের অনুপ্রেরণায় আশপাশের অঞ্চলে গড়ে উঠল আরো আরো জঙ্গলমাতাদের গোষ্ঠী। এখনও জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে ঘুরে দেখাশোনা করে এই অসাধ্যসাধিকারা। একটা বাঁশের লাঠি, তার ডগায় বাঁধা দুটো ঘুঙুর। সেটা কাঁধে ফেলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটলে ঝুমঝুম শব্দ হয়। দূরে থাকা লোকজন, এমনকি হয়ত পশুপাখিরাও জানতে পারে ঐ যে ‘খাঁকর’এর শব্দ হচ্ছে, মহিলামঙ্গল দলের কেউ আসছে।

গ্রামের মধ্যে জায়গা বেছে নিয়ে নার্সারি তৈরি করেছেন এই মহিলামঙ্গল দলের সদস্যরা। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে বছরে প্রায় দু-আড়াই লক্ষ স্বাস্থ্যোন্নত স্থানীয় গাছের চারা ওঠে। নিজেদের গাছ লাগানো ছাড়াও একটাকা করে এই চারা এঁরা বিক্রি করেন আশপাশের এলাকায়- ভাটবো উখলিউ কাফলগাঁও। বনদফতর কেনে। সেই টাকা থেকে হয় রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, সরকারি বেসরকারি কোন সংস্থান থেকে কোন টাকা নিতে হয় নি এই বিশাল কর্মকাণ্ডের জন্য। আর দূরে যেতে হয় না ‘ঘরের মানুষ’দের। দশ বছর আগে দেখেছিলাম জঙ্গলের মধ্যে ‘খড়কে’ (জঙ্গলে গৃহপালিত পশু রাখার ঘেরা জায়গা) থাকে ২৫,০০০ পশু। শুধু কি তাই? পাহাড় বেয়ে বৃষ্টির সব জল হুড়মুড় করে নেমে যাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে জলস্তর বেড়েছে। সেই শীর্ণকায় সুখানালা এখন হয়ে উথেছে এক বারোমাসের নদী। নিজেদের অভ্যাস বশে উফরৈংখাল দুধাতোলির মানুষরা তার নাম দিয়েছেন গড়গঙ্গা।

এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Opinion news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Birth of a river garhwal womens power