Advertisment

লোভের মারণখেলায় মত্ত দুনিয়া, পরিবেশের বাঁচার আশা ক্রমশ মরীচিকা

পরিবেশবিধি ভেঙে কী করে রবীন্দ্র সরোবরের যত্রতত্র শুটিং-পরবর্তী আবর্জনা ফেলে রাখার ও প্লাস্টিক ব্যবহার করার অনুমতি পাচ্ছে শুটিং ইউনিট?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata rabindra sarobar pollution

রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজোর স্নান। ফাইল ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

শহরের বুকে ওই তো ছোট্ট একটুকরো সবুজ, তার ওপরে কিছুটা খোলা আকাশ, ছোট এক স্বচ্ছ জলাশয়। মাছেরা নিশ্চিন্তে বিচরণ করে সেখানে। সবুজের সামান্য ঔদার্যেই নেচে ওঠে পাখিরা। চারপাশের ইট-কাঠ-পাথরের মাঝখানে এখানকার পরিবেশ যেন মরুভূমিতে মরুদ্যান। পাখিদের কলতানে মুখর সকাল-সন্ধ্যা। প্রাণের আরাম মনের শান্তি পান শহরবাসীও। বিশেষত দক্ষিণ কলকাতার মানুষ। চারপাশের দূষণ থেকে অতি কষ্টে বাঁচিয়ে রাখা সেই স্বর্গের ওপর কেন বার বার এই আক্রমণ? অতি সম্প্রতি এই প্রশ্ন আরও একবার আলোড়িত করেছে কলকাতার তামাম পরিবেশ সচেতন মানুষকে।

Advertisment

রবীন্দ্র সরোবর। একদার বিশাল লেক ছোট হতে হতে এখন ক্ষুদ্র জলাশয়ে পরিণত। তবু তো সে আছে। আকাশছোঁয়া বাড়ি আর পথ চলতি অজস্র গাড়ির ধোঁয়ার মাঝে সামান্য সবুজের আলপনা। সেই সামান্য শান্ত প্রকৃতিটুকু ঘিরেও মাঝে মাঝেই জ্বলে ওঠে লোভের আগুন। লোভই তো! সবুজটুকু নির্ঝঞ্ঝাটে থাকলে আমরাও যে বাঁচি, সেকথা ভুলে পরিবেশের ক্ষতির বিনিময়ে আর্থিক লেনদেন। দুনিয়া জুড়েই চলছে এই মারণখেলা। এই অঞ্চলটুকু আর কী করে এই থাবার বাইরে থাকে?

সরোবর সংলগ্ন নজরুল মঞ্চ তো আছেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক সভা। পাশের সরোবরের জলে, কিছুটা হলেও দূষণের ঢেউ তো ওঠেই। বাতাস ভারী হয়। গাছেদেরও কাতরতা বাড়ে। এখানেই রক্ষে নেই। 'ছট মাইয়ার' ভাসান থেকে সিনেমার শুটিং, আইনকে কলা দেখিয়ে আরও কত কী সংগঠিত হবে এখানে, ইদানীং তাই নিয়েই প্রবল দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে পরিবেশবিদদের কপালে।

আরও পড়ুন: ‘তাতে আমার কী?’ বলার সময় শেষ

একদিকে পরিবেশকর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব একে সুরক্ষিত রাখা যায়, তার। তাঁদেরই ঐকান্তিক চেষ্টায় একটা সময় জাতীয় পরিবেশ আদালত নির্দেশ দেয়, রবীন্দ্র সরোবরের ক্ষেত্রে কোনওভাবেই ভাঙা যাবে না পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ। সরোবরের চতুর্দিকে সেই বাবদ প্ল্যাকার্ডও লাগানো রয়েছে। সেই নির্দেশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কিছুদিন আগে সরোবরে হৈ হৈ করে হয়ে গেল ছট পুজোর বিসর্জন।

এবার সিনেমার শুটিং! শহরের বিভিন্ন অঞ্চল, গঙ্গাবক্ষ, দিঘা, দার্জিলিংয়ে সিনেমার শুটিং, তাকে ঘিরে তোড়জোড়, আয়োজন, অতি চেনা এক ঘটনা। কলকাতা তো বটেই, মুম্বইয়েরও বহু পরিচালক এই রাজ্যে সিনেমার শুটিং করেছেন অতীতে। কিন্তু রবীন্দ্র সরোবরের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। একটি শুটিংকে কেন্দ্র করে যে যে বিষয় ঘটে, তার সমস্তটাই এখানকার পরিবেশের পক্ষে প্রতিকূল। তীব্র আলো, প্রবল শব্দ থেকে স্তূপীকৃত আবর্জনা জড়ো হওয়া, কোনওটাই পরিবেশ সংরক্ষণের অনুপন্থী নয়।

bob biswas movie কলকাতায় চলছে 'বব বিশ্বাস' ছবির শুটিং

পরিচালক সুজয় ঘোষের ছবি 'বব বিশ্বাস'। অভিনয় করছেন অভিষেক বচ্চন। সম্প্রতি তাঁকে নিয়েই রবীন্দ্র সরোবরে ছবির শুটিং চলেছে, যাকে ঘিরে এই মুহূর্তে বিতর্ক তুঙ্গে। একদিকে প্রাতঃভ্রমণকারী পরিবেশবন্ধু মানুষ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, পরিবেশবিধি ভেঙে কী করে এভাবে যত্রতত্র শুটিং-পরবর্তী আবর্জনা ফেলে রাখার ও প্লাস্টিক ব্যবহার করার অনুমতি পাচ্ছে শুটিং ইউনিট? চড়া আলো, বিভিন্ন যান্ত্রিক শব্দ, জেনারেটরের আওয়াজ - এই সবই তো এখানকার পরিবেশের শত্রু। অন্যদিকে শুটিং উপলক্ষে কর্মরত ইউনিটের সদস্যের মাধ্যমে এই প্রশ্ন যখন পরিচালক সুজয় ঘোষের কাছে পৌঁছয়, তখন তাঁর জবাব, "এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।" পাশাপাশি রবীন্দ্র সরোবরের দায়িত্বে থাকা কেএমডিএ-র সিইও অন্তরা আচার্যের কথায়, "আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই শুটিং করা হচ্ছে রবীন্দ্র সরোবরে। কোথাও জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অমান্য করা হয়নি। বেআইনি কিছু হচ্ছে না ওখানে।"

আরও পড়ুন: বনজঙ্গল ও বনছেদন

এরপর আর কীই বা বলার থাকে? সরকারি তরফেই যেখানে জানানো হচ্ছে, যা ঘটছে তা সরকারি অনুমোদন সাপেক্ষেই। এক্ষেত্রে আইন-আদালতের সঙ্গে প্রশাসনের সমীকরণটা আমার-আপনার কাছে দুর্বোধ্য হলেই বা কী? আমরা তো শেষ পর্যন্ত নিতান্তই ক্ষমতাহীন আম জনতা।

আসল কথা হলো এই যে, পরিবেশ আদালতের নির্দেশ, যেখানে সরোবরের পরিবেশবিধি ভাঙ্গা যাবে না বলা হচ্ছে, সেখানে একটা ছোট্ট ফাঁক রয়েছে। সেটি হলো, এই নির্দেশে কোথাও পৃথকভাবে সিনেমার শুটিংয়ের বিষয়টির উল্লেখ নেই। সম্ভবত সেই ফাঁকটি দিয়েই বাণিজ্যিক লোভের কালনাগিনী প্রবেশ করেছে। সে হোক না, শুটিংয়ে যা কিছু ঘটে, প্রত্যেকটিই পৃথকভাবে পরিবেশ রক্ষার পক্ষে প্রতিকূল। ভুল তত্ত্বকে কেমন করে নিজেদের কাজের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে খাড়া করা যায়, সেটা যারা জানে, তারা জানে। এক্ষেত্রে শহরের পরিবেশ রক্ষার বাহক এই একটুকরো অঞ্চলকে নিয়ে যে পরিচালক সুজয় ঘোষও একান্তে কিছু ভাববেন, সে প্রশ্ন তোলাও বোধহয় বাতুলতা বলেই গণ্য হবে।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে মুম্বইয়ের একটি প্রতিবাদী আন্দোলনের ঘটনা। সেখানে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে একসঙ্গে অনেকগুলি গাছ কাটা পড়ছিল। আর তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে নেমেছিলেন মুম্বইবাসীরা, যেখানে সামিল হন বলিউডের বেশ কয়েকজন তারকা অভিনেতা ও পরিচালক। এই তথ্য কি আলোচ্য পরিচালকের ভান্ডারে ছিল না? নাকি বিষয়টা তাঁর কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়? পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে যেখানে এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে  প্রবল গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে সংগত কারণেই, সেখানে আমরা কী করে এতখানি উদাসীন হতে পারি?

আরও পড়ুন: স্থানীয় জঙ্গল, আগাছায় আজও লুকিয়ে আছে আমাদের সুরক্ষা

লক্ষ্যনীয়, রবীন্দ্র সরোবরের ক্ষেত্রে এই উদাসীনতার ঘটনা খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বার বার ঘটছে। ছট পুজো বিসর্জনের সময়ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তখন বলা হয়, এটা বহু বছর ধরে চলে আসছে। মানুষের আবেগকে আঘাত করা যাবে না। পূজার আয়োজকরা বিসর্জনের পর সব পরিষ্কার করে দিয়ে যাবেন। কিন্তু কার্যত সেটা হয়নি। অনেকদিন পর্যন্ত বাসি ফুল, পচা ফল যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ব্যাপারে কেএমডিএ-র দিক থেকেও তেমন সাড়াশব্দ ঘটনা চলাকালীন শোনা যায়নি। পরে এলাকা পরিষ্কার করে দায় সারে তারা।

উল্লেখ্য, এবার বিষয়টাকে একেবারে আইনি তথা সরকারি সিলমোহর লাগিয়েই ঘটানো হয়েছে। যার ফলে, শুটিং ইউনিট একেবারে দ্বিধাহীন বিচরণে যাবতীয় আয়োজনে মাঠে নেমেছে। রান্না, খাওয়া, বাসনপত্র ধোয়া থেকে শুরু করে প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনা জড়ো করে রাখা। সকাল থেকে দুপুর চড়া আলোয় শুটিং পর্ব, প্রচুর মানুষের কোলাহল, জেনারেটরের শব্দ থামিয়ে দিয়েছে গাছের পাতা ঝরে পড়ার মৃদু ধ্বনি। পাখিরা ভুলেছে গান। বাতাস গাঢ় হয়েছে দূষণের কালো ধোঁয়ায়। নিত্য ভ্রমণে আসা মানুষজন বলাবলি করছেন সামনের বিষময় দিন নিয়ে। তবে, তাঁদের বলা কথা আর কতদূর পৌঁছয়?

আরও পড়ুন: পুকুর কাটার বিদ্যা

সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকের বরফ গলার খবর সংবাদ মাধ্যমে আসা মাত্র লোকজন নতুন করে আতঙ্কিত। বরফ গলছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু এখন সেটা মাত্রা ছাড়িয়েছে। এর ফলে সামনের কোনও দিনে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার ভয়। এরই সঙ্গে ভয়াবহ পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। সবুজের বিনাশে দূষণের হার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। শুধু গাছপালা, জলাধার নয়, মানুষের অবহেলা, অত্যাচারে মুখ ফেরাচ্ছে প্রকৃতির অনুষঙ্গে থাকা জীবজন্তুরাও। পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছিরা হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগের খবর, সেলফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে বিরক্ত মৌমাছিরা আর ফুলের পরাগ বহন করতে ইচ্ছুক নয়। তাদের কাজটা এখন কৃত্রিমভাবে মানুষকে দিয়ে করাতে হচ্ছে। অর্থাৎ, মৌমাছি-মৌচাক-মধু এই ত্রিবেণী পরম্পরাটাই বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার যাবতীয় লিখন মুছে ফেলে নিজেদের কপালে কী লিখেছি, আমরা সবাই এখন জানি সেটা। তবু এই অজ্ঞতা, নির্মম উদাসীনতা কেন? রবীন্দ্র সরোবরকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা এ প্রশ্ন আসলে বৃহত্তর সর্বনাশের ইঙ্গিত। যা এখন সংশ্লিষ্ট মানুষজন দেখেও দেখছে না। বুঝছে না, যে বাতাসকে অক্সিজেন-বিহীন করার খেলায় নেমেছে তারা, সেই বাতাস একদিন তাদের সুরক্ষিত ঘরেও হানা দেবে। আর সেটা খুব শিগগিরই ঘটবে।

Pollution
Advertisment