Advertisment

গণতন্ত্রের উৎসব পালন করি, কিন্তু নিজের দেশেই আমি বিদেশি

সিএএ-র কল্যাণে এখন আমার বার্থ সার্টিফিকেটের প্রয়োজন, কিন্তু আরও কয়েক লক্ষ মানুষের মতোই আমিও আবিষ্কার করেছি যে সরকারের কাছে আমার জন্মের কোনও প্রমাণ নেই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
republic day 2020,

পাসপোর্ট দিয়ে যায় চেনা? অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

republic day 2020,

Advertisment

ফের একটি প্রজাতন্ত্র দিবস, সঙ্গে পালিত হলো আরও একটি উৎসব - দেশভক্তি। সারা দেশে উঁচু হয়ে উড়ল পতাকা, গান গাওয়া হলো, টিভিতে সম্প্রচারিত হলো যুদ্ধের ছবি, এবং গর্বিতভাবে লেফট রাইট করলেন কচিকাঁচা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা। কিন্তু সেইসব ভারতীয়দের কী হবে, যাঁরা 'মিশ্র' জাতির বা বংশের? আজকের দিনে দেশভক্তির যে সংকীর্ণ গণ্ডি, যা কিনা ধর্ম, বর্ণ, এমনকি খাদ্যের খুঁটিতে বাঁধা, যখন দিগন্ত জুড়ে রয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), সেখানে এই 'মিশ্রদের' স্থান কোথায়? এই জটিল প্রশ্নটা আমার ক্ষেত্রে খুব সত্যি। এর উত্তর কেউ এখনও দিতে পারেন নি।

প্রথমেই স্পষ্ট করে দিই, আমি জন্মসূত্রে, নাগরিকত্বের সূত্রে, এবং স্বঘোষিত পরিচিতির সূত্রে ভারতীয়। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে আমার পূর্বপুরুষেরা তৎকালীন অতি সুদূর পারস্য সাম্রাজ্য (Persian Empire) থেকে 'সিল্ক রোড' ধরে সোজা কলকাতা (বা তখন তার যতটুকু ভৌগোলিক অস্তিত্ব ছিল) মুখো হন, ব্যবসায় উন্নতি করার আশায়। গোঁড়া আর্মেনিয়ান হওয়ার সুবাদে আমাদের ধর্মান্তর নিয়ে কোনও মতভেদ নেই - কোনও অবস্থাতেই তা অনুমোদিত নয়। আপনি আর্মেনিয়ান, কারণ আপনার বাবা আর্মেনিয়ান। গল্প শেষ।

এর ফলে ধর্মীয় বিবাদ এড়াতে সুবিধে হয়, যেহেতু কোনও ধর্মীয় অ্যাজেন্ডাই নেই আমাদের। হিন্দুদের মধ্যে কিছু বিশেষ ব্যবসায়িক জাতির উত্থানের বহু আগে থেকেই আমাদের বিচক্ষণতা ও অর্থের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তির কারণে আমরা সবার সঙ্গেই লাভের ব্যবসা শুরু করি, তা সে মুসলিম মোগলই হোক, বা দক্ষিণের মশলা ব্যবসায়ী (ভাস্কো ডা গামা এদেশে পদার্পণ করার সাত শতাব্দী আগে থেকে আর্মেনিয়ানরা মালাবার উপকূলে ব্যবসা করেছেন), গুজরাটি স্বর্ণব্যবসায়ী হোক বা বাঙালি বস্ত্রব্যবসায়ী।

আরও পড়ুন: পার্ক সার্কাস অনেক ব্যবধান ঘুচিয়ে দিচ্ছে

এসবের পাশাপাশি চলছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হাসিমুখে দোহন করাও। বস্তুত, কোম্পানির কাছ থেকে অনেক সময়েই ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিলেও আর্মেনিয়ানদের যথেষ্ট খাতির ছিল সাহেবদের কাছে। লন্ডনের লেডেনহল স্ট্রিটে তাঁদের সদর দফতরে পাঠানো বিভিন্ন চিঠিচাপাটিতে কোম্পানির আধিকারিকরা লিখছেন, আর্মেনিয়ানরা "...সর্বাপেক্ষা ধনী, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আমাদের দেখা সবচেয়ে দক্ষ ব্যবসায়ী"। কোম্পানির তরফ থেকেও একটি চিঠিতে ভারতে তাদের আধিকারিকদের বলা হচ্ছে, কোনোরকম ব্যবসায়িক লেনদেন ততক্ষণ পর্যন্ত শুরু না করতে, যতক্ষণ না কোনও আর্মেনিয়ানকে পাওয়া যাচ্ছে দর কষাকষির নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।

বাংলায় দিব্য ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়ে আর্মেনিয়ানরা, এতটাই, যে বাংলার সুবিখ্যাত পটলের দোলমার জন্ম দেয় মূল 'আর্মেনিয়ান দোলমা', যা আদতে ছিল আঙুরের পাতায় মোড়া মাংসের কিমা এবং ভাত। উনিশ শতকের প্রায় কোনও সাংস্কৃতিক স্মৃতিচিহ্নই কলকাতার বুকে রেখে যায় নি আর্মেনিয়ানরা, কিন্তু আপনি চাইলেও এড়াতে পারবেন না শহরের পথেঘাটে ছড়ানো তাদের ব্যবসায়িক কৃতিত্বের ছাপ - নিজাম প্যালেস, কুইনস ম্যানশনস, পার্ক ম্যানশনস, গ্র্যান্ড হোটেল এবং আরও বহু চোখধাঁধানো বাড়ি হয় নির্মাণ করে তারা, অথবা কিনে নেয়। এছাড়াও কলকাতার বিখ্যাত 'আর্মানি গির্জা' তো আছেই।

আমার ঠাকুরদা বর্মায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। কিছু অসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় শত্রু এলাকায় আটকা পড়ে যান তিনি। যে জাপানিদের হাতে তিনি ধরা পড়েন, তারা তাঁকে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে, দুই পায়ে গুলি করে ফেলে রেখে যায়, তিলে তিলে রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু অবধারিত জেনে। একটি বর্মী পরিবার খুঁজে পায় তাঁকে, ভেষজ ওষুধপত্র দিয়ে চিকিৎসা করে তুলে দেয় মার্কিন সেনাবাহিনীর এক পল্টনের হাতে। আরও কিছু চিকিৎসার পর সেই মার্কিনরা তাঁকে ভারতের কাছে ফেরত দেয়। পরিতাপের বিষয়, ঠাকুরদা যাঁকে বিয়ে করেন, আমার সেই ঠাকুরমার বাবার মৃত্যু হয়েছিল হাওড়া ব্রিজের ওপর এক মার্কিন সেনাবাহিনীর ট্রাক চাপা পড়েই!

ঠাকুরদা-ঠাকুরমা থাকতেন ওড়িশায়, যেখানে আমার বাবার জন্ম। সেখান থেকে কলকাতার রিপন লেনে চলে আসেন তাঁরা, এবং সেই রিপন লেনের বাড়ি স্থান পায় ফেলুদার এক বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারে। 'গোরস্থানে সাবধান' পড়া আছে তো? শেষমেশ আমার ঠাকুরদা বসতি গাড়েন কল্যাণীতে, যেখানে জুলিয়ান ডে স্কুলে পড়াতেন আমার ঠাকুরমা। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কল্যাণীর পাট চুকিয়ে আমাদের কাছে চলে আসেন ব্রিটেনে। কিন্তু তার প্রায় এক দশক পরে, ব্রিটেনে নিজের মৃত্যুর আগে, তিনি জোর দিয়ে আমাদের বলে যান যে তাঁকে যেন কল্যাণীতেই কবর দেওয়া হয়, আমার ঠাকুরদার সঙ্গে। দুই সপ্তাহ, গোটা পঞ্চাশেক নথিপত্র, এবং লাখ পাঁচেক টাকার বিনিময়ে আমরা ঠাকুরমাকে অবশেষে কল্যাণীতে তাঁর 'বাড়িতে' নিয়ে আসি, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। আজ সেখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে তিনি।

আরও পড়ুন: নয়া নাগরিকত্ব আইন: ভবঘুরে রাস্তাবাসীদের কী হবে?

আমার মায়ের দিক থেকে আমি ফরাসি। মায়ের আত্মীয়-পরিজন কয়েক শতাব্দী ধরে এদেশে আসেন মরিশাস হয়ে। আমার মায়ের জন্ম বিহারের ধানবাদে। তাহলে কী দাঁড়াল? আমি এক ওড়িয়া এবং বিহারীর সন্তান, যার জন্ম কলকাতায়, অতএব জন্মস্থানের ভিত্তিতে আমি বাঙালি!

ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে আর্মেনিয়ান কলেজ বোর্ডিং স্কুলের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে সুরক্ষিত ছিল আমার ছোটবেলা। আমার যখন ন'বছর বয়স, ১৯৯০ সাল, আমার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটেনে চলে যাওয়ার। আর সেই যে 'কালচার শক' শুরু হলো, তা আজও সমান তালে চলেছে। লন্ডনের মানুষ আর্মেনিয়ান বলে কোনও জাতির নামই শোনে নি। অবাক বিস্ময়ে তারা প্রশ্ন করত, আমাকে দেখলে 'ইন্ডিয়ান' মনে হয় না কেন, আমার পাগড়ি নেই, গায়ের রঙ বাদামী নয়, ইত্যাদি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের পর্যায়েও ঠিক ফেলা যেত না আমাকে, সুতরাং, আরও অনেক মিশ্র জাতির মানুষের মতো আমার পরিচয় হলো 'ব্রিটিশ এশিয়ান'।

অদ্ভুত ব্যাপার, আমার নাগরিকত্ব কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি, এমনকি যখন আমি পুলিশে (স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে) যোগ দিই, এবং দশ বছর সেখানে চাকরি করি, তখনও নয়। সেই ১৯৯৩ সালে আমি ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও কোনোদিন আমার ভারতীয় নাগরিকত্ব বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন মনে করি নি, ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্যবার সফর করার সময়ও নয়। কেউ দেখতে চায় নি আমার জন্মের অথবা ব্যাপটিজমের (খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার) সার্টিফিকেট, এমনকি যখন আমি 'অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে' সই করছি, অথবা পুলিশের উচ্চপর্যায়ের পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছি, তখনও নয়।আমি লন্ডনের বাসিন্দা, এইটুকুই যথেষ্ট ছিল আমার, আমার বন্ধুবান্ধব, এবং পুলিশের পক্ষে।

অথচ আজ, ২০২০ সালে, আমার গায়ে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে আমার খ্রিষ্টান পরিচিতি, যার সহধর্মীয়রা দেশময় দাপিয়ে বেড়ায় মানুষের ধর্মান্তর করাতে। অথবা আমি একজন 'বিদেশি', যে বাংলা বা হিন্দি কোনটাই গড়গড় করে বলতে পারে না, পড়তেও পারে না। আমার ভারতীয় পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরোলে নতুন করে করাতে গেলে ভারত সরকার জানতে চায়, তাতে ব্রিটেনের ঠিকানা লেখা কেন, যদিও পুরোনো পাসপোর্ট জারি হয়েছে তাদেরই লন্ডন দফতর থেকে, এই ঠিকানাও তারাই লিখেছে।

আরও পড়ুন: প্রজাতন্ত্র-৭০: দলীয় সত্যের সঙ্গে মানবধর্মের মতো চিরসত্যের সংঘাত

সিএএ-র কল্যাণে এখন আমার বার্থ সার্টিফিকেটের প্রয়োজন, কিন্তু আরও কয়েক লক্ষ মানুষের মতোই আমিও আবিষ্কার করেছি যে সরকারের কাছে আমার জন্মের কোনও প্রমাণ নেই। সম্প্রতি আমার একটি কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন করাতে গেলে আমাকে বলা হয়েছে প্রমাণ করতে যে আমি কোনোদিন ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাই নি। যা করি নি, তার প্রমাণ কীভাবে দেব? আমি বাধ্যত ভারতের জাতীয় সঙ্গীত শুনলে উঠে দাঁড়াই, যদিও আমার মতন এক অভিবাসীকেও ব্রিটেনে কোনোদিন তাদের জাতীয় সঙ্গীতের সময় উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয় নি।

মিডিয়াতে প্রায়ই এমন কিছু অনাবাসী ভারতীয়দের নিয়ে লেখালেখি হয়, যাঁরা মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল করেছেন - যেমন সুন্দর পিচাই, বা ইন্দ্রা নুয়ি, এমনকি ক্যানাডার সংসদে বা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে শিখরা পর্যন্ত। আমিও তো গর্বিত ভারতবাসী হিসেবেই সেবা করেছি, অন্যান্য অসংখ্য ভারতীয়ের মতো প্রথম সুযোগেই নাগরিকত্ব বিসর্জন দিই নি।

অথচ আজ দেখুন, ভারতীয় হিসেবে প্রজাতন্ত্রের উৎসব পালনের দিনেও ভাবছি, কেন আমার দেশে থাকা আমার পক্ষে কঠিন, কিন্তু ব্রিটেনে থাকা সহজ। বুক ঠুকে পতাকা ওড়ানো যদি দেশভক্তির পরীক্ষা হয়, তবে আমি ফেল। কিন্তু সেই পরীক্ষা যদি একটা কাগজ আঁকড়ে থাকায় হয়, যা আমার পিতৃপুরুষের ভূমির সঙ্গে আমাকে বেঁধে রাখে, পশ্চিমের সমস্ত প্রলোভন উপেক্ষা করেও, তবে আমি এখনও দেশভক্ত নই কেন?

(লেখক-ইতিহাসবিদ অ্যান্টনি খাচাতুরিয়ান কলকাতার আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। মতামত ব্যক্তিগত)

অনুবাদ: যাজ্ঞসেনী চক্রবর্তী

Republic Day 2020
Advertisment