Advertisment

স্থানীয় জঙ্গল, আগাছায় আজও লুকিয়ে আছে আমাদের সুরক্ষা

গাছ লাগানোর একটা উদ্যোগ সরকার বা বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি অনেক মানুষের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য রকম ভাবে চোখে পড়ছে।তবু গাছের সংখ্যা কিন্তু ততখানি বাড়তে দেখিনা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Jol Mati, Green

ভারতীয় যে কোন জনগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়ার একটা বড় অংশের প্রয়োজন মিটত আশপাশের শাকপাতা, ফলমূল, গাছ বাঁশ থেকে

ভারি সুন্দর একটি গল্প শুনেছিলাম। ভেষজ চিকিৎসার গুরু যে সুশ্রূত, যিনি ‘সুশ্রূত সংহিতা’র রচয়িতা, তাঁর নামে।

Advertisment

গুরুর কাছে শিক্ষা শেষ হয়েছে সুশ্রূতের, গুরু প্রসন্ন হয়ে তাঁকে বলেছেন গৃহে ফিরে গিয়ে অধীত বিদ্যার চর্চা করতে। কিন্তু গুরুদক্ষিণা? গুরু বলেছেন, তোমাকে বিদ্যা দান করে আমি যে তৃপ্তি পেয়েছি, তাইই আমার দক্ষিণা। সুশ্রূত তবুও দুঃখী, কথিত আছে দক্ষিণা না দিলে শিক্ষা সমাপ্ত হয় না, তবে কি গুরু তাঁর ওপর প্রসন্ন নন? শিষ্যের মন বুঝে গুরু শেষে বললেন, "বেশ একটি কাজ করো। কোনো কাজে লাগে না এমন একটি কোনো উদ্ভিদ আমাকে এনে দাও, তাই তোমার দক্ষিণা হবে।" শিষ্য সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলে গেলেন। তারপর সারাবেলা গেল, রাত গেল, সুশ্রূত ফেরেন না, পরদিন গেল, সূর্যাস্তের সময় ম্লানমুখে সুশ্রূত ফিরে এলেন, দুই দিন ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটি উদ্ভিদও পাননি যার কোনো ভেষজ গুণ নেই। গুরু শিষ্যকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন তার শিক্ষা সুসম্পন্ন হয়েছে, এই আনন্দে।

আরও পড়ুন, তামাকের বিশ্বজয়, তামাকের অর্থনীতি

সুশ্রূতের সময়ে পার্থেনিয়াম ছিল না, সে কথা ঠিকই, কিন্তু গল্পের বার্তাটি তাতে আটকায় না। আর এইসব ছোট ছোট ঝোপঝাড় গাছপালা সবই যে কেবল মানুষের রোগ চিকিৎসার কাজেই লাগত, এমনও তো নয়। এর মধ্যে অনেকগুলি, অনেক শাক, শেকড়, ছত্রাক, ফল বা সুঁটি, খাদ্য হিসাবেই সুপরিচিত ছিল। সেই পরিচিতির প্রচলন এমনকি খুব বেশিদিন আগেকার কথাও নয়। ‘পথের পাঁচালী’কে যদি বলা যায় বাংলার গ্রামীণ দরিদ্র গৃহস্থের খাদ্যের বিশ্বকোষ, তাহলে দেখা যাবে ভারতীয় যে কোন জনগোষ্ঠীর থাকা-খাওয়ার একটা বড় অংশের প্রয়োজন মিটত আশপাশের শাকপাতা, ফলমূল, গাছ বাঁশ থেকে।

বস্তুত, পূর্বভারতের যে সব জায়গায় প্রচুর বাঁশ জন্মায়, সেখানকার অনেক জনগোষ্ঠী বাঁশ দিয়ে, মনে হয়, কেবল ভাত রান্নার হাঁড়ি আর জল রাখবার কলসি ছাড়া সবকিছু বানাতে পারতেন। খাদ্যে নানাভাবে ব্যবহারও তার মধ্যেই পড়ে। অল্পদিন আগেও রেললাইনের ধারেকার গ্রামগুলোর খরাকালীন খাদ্যের বেশ কিছুটা আসত নয়ানজুলি থেকে। ধান কেটে নেওয়া মাঠ থেকে। ছোট পুকুর কী জলা থেকে।

Jol Mati, Green শুধু ভেষজ ওষুধ নয়, খাদ্যও

বড় বড় গাছলতার বিশাল অরণ্য ছাড়াও এর সবগুলোই কিন্তু স্থানীয় জঙ্গল। দশ-কুড়ি বছর আগেও এরকম স্থানীয় জঙ্গল শহরেও দেখা যেত। পাড়ার খেলার মাঠ, পুকুরপাড়, কয়েকটা পুরোনো বাড়ির আশপাশে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছোট-মাঝারি নানারকম 'বুনো' গাছের ঝোপ, থাকত। কুল আকন্দ কাঁটা-নটে বনতুলসি কুকসিমা তেলাকুচো লজ্জাবতী ধুঁধুল - আরো নানারকম নাম জানা-না জানা ছোট ছোট লতা, ঝোপ - যাদের বলে গুল্ম - এরা প্রায়ই আমাদের নিকট প্রতিবেশী ছিল।

এদের সকলের ভেষজগুণ বেশিরভাগ মানুষের আর মনে না থাকলেও প্রকৃতিতে এইসব উদ্ভিদের ভূমিকা রয়ে যায় একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে বাস করে নানা রকম পোকামাকড়, খুব ছোট নানান প্রাণী, যেমন প্রজাপতি, ফড়িং, মৌমাছি, নানারকম পিঁপড়ে, ব্যাং, মেঠো ইঁদুর, সাপ। প্রাকৃতিক সুশৃঙ্খলার জগতে এদের প্রত্যেকের ভূমিকা আছে, আছে পারস্পরিক সম্পর্ক। আমরা হয়ত কেবল সেই ফলাফলগুলোই, দেরিতে হলেও, বুঝতে পারি যা মানুষের জীবনকে কোনরকম ভাবে প্রভাবিত করে। তার বাইরে যে সব বিশৃঙ্খলা হয় তা মানুষের সাধারণ জ্ঞানের অগোচরেই রয়ে যায়, এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও।

অন্য উদাহরণ বাদ দিয়ে কেবল গৃহস্থালিতে পোকামাকড়, তার পিছু-পিছু রাসায়নিক কীটনাশক, ফলত নানাবিধ অসুস্থতা বাড়তে থাকার একটা বড় কারণ যে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম নষ্ট হওয়া, একথা এখন প্রায় সকলেরই জানা। সাপেদের নিজস্ব আবাস নষ্ট হওয়ার ফলে শহরেরও এলাকার মধ্যে সাপ চলে আসা, ইঁদুর বেড়ে ওঠা, একই কারণে ব্যাং খুব কমে যাওয়ায় তার খাদ্য পোকাদের সংখ্যাবৃদ্ধি...তালিকাটা লম্বা করা যায় কিন্তু নিষ্প্রয়োজন।

Jol Mati, Green গাছ লাগালাম, কিন্তু রক্ষা করলাম না, এই নীতিতে চলে লাভ নেই

গাছ থাকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বোঝানোর প্রশ্ন ওঠে না। যেটা বলবার সেটা হলো, গাছ লাগানোর পাশাপাশি, এমনকি হয়ত তার চেয়েও বেশি, দরকার হলো গাছ রক্ষা করা। গাছ লাগানোর একটা উদ্যোগ সরকার বা বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি অনেক মানুষের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য ভাবে চোখে পড়ছে। তবু গাছের সংখ্যা কিন্তু ততখানি বাড়তে দেখি না। তার কারণ অনেক। নতুন লাগানো একটি গাছ বৃক্ষ হয়ে উঠতে (যেহেতু অধিকাংশ সময়ে বড় গাছেরই চারা লাগানো হয়) দীর্ঘ সময় লাগে। বেদনাদায়ক ঘটনা এই যে, নতুন লাগানো গাছের একটা বড় অংশই বাঁচে না।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গাছেদের ক্ষেত্রেও স্থানিকতাকে বোঝা। মাটির গঠন, চরিত্র, জলধারণ ক্ষমতা, বৃষ্টিপাত, এরকম বহু ব্যাপারের সঙ্গে অন্য সমস্ত জৈবিক জিনিসের মতোই গাছেদেরও ভারি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অন্য অনেক বিষয়ের মতোই গাছদের বিষয়ে এই কথাটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। ভারতবর্ষে প্রায় ২,৬০০ প্রজাতির গাছ পাওয়া যায়, যার মধ্যে বনদপ্তর বা উদ্যান বিভাগ ব্যবহার করে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ টি প্রজাতিকে। বাকি অসংখ্য প্রজাতির যে অতুল সম্পদ, সেগুলো মূলত নিজেরাই জন্মায়, যাকে আমরা বলি ‘গজায়’, বড় হয়, মরে, তাদের বীজ থেকে আবার নতুন করে জন্মায়। জনপদে এখনও টিকে থাকা যেসব গাছপালার কথা বলছিলাম, তার বেশিরভাগই এই ‘বুনো আগাছা’র মধ্যে পড়ে।

‘নিরানব্বই পয়েন্ট নয় নয় ভাগ জীবাণুনাশকারী’ রাসায়নিক, এসি মেশিন, এয়ার পিউরিফায়ারের তুলনায় গাছেদের দেওয়া স্নিগ্ধ স্থায়ী সুরক্ষাই যদি আমাদের প্রার্থনা হয়, তাহলে গাছ - সব গাছ, যা আমরা এখন যত্ন করে লাগাচ্ছি, যা আমাদের আছে, যা কিছু প্রকৃতি মানুষের অবিমৃষ্যকারিতার পরও দুহাত উজাড় করে এই দেশকে, এই ভূমিকে দেন - সেই সমস্ত বৃক্ষ-লতা-গুল্ম-তৃণকে যেন সযত্নে রক্ষা করি।

এই কলামের সব লেখা একত্রে পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে

Jol Mati
Advertisment