অভিনন্দন তৃণমূল কংগ্রেসকে, তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনেই জিতল তারা। সাদা চোখে সামরিক জাতীয়তাবাদ আর ধর্মের রাজনীতির বিরুদ্ধে জয়ী হল অসাম্প্রদায়িক শক্তি আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাংলার উন্নয়ন। তৃণমূল আর বিজেপির কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবার বাম কংগ্রেস জোটের জামানত নিয়ে টানাটানি। গত ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোটের শরিক হিসেবে কালিয়াগঞ্জে জিতেছিল কংগ্রেস। করিমপুর আর খড়গপুরে দ্বিতীয় স্থানে ছিল জোট। লোকসভা নির্বাচনের বিধানসভাভিত্তিক ফলের হিসেবে এই তিন কেন্দ্রেই তৃতীয় স্থানে পিছিয়ে গিয়েছিল তারা।
এবারেও ফলাফল প্রায় একই। ভোট শতাংশ আরও কমে গেছে জোটের। গত বিধানসভা এবং সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূলের ভোট বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। লোকসভার তুলনায় অবশ্যই বেশ খারাপ ফল করেছে বিজেপি, কিন্তু মোটের ওপর তারাই এই রাজ্যের দ্বিতীয় শক্তি হিসেবে জায়গা ধরে রাখল। পরিস্থিতি যা, তাতে সামনের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ভবিষ্যৎবাণীতে অবশ্যই অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল। নারদা-সারদা-দলবদলের প্রভাব একেবারেই পড়েনি এই উপনির্বাচনে। এবার দেখতে হবে এর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা কী কী হতে পারে।
আরও পড়ুন, মোদী-শাহের রাজনীতির বিকল্প হয়ে উঠছেন বাঙালি মমতা
প্রথমে ধরে নেওয়া যাক তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে কোন গোপন আঁতাত নেই। সেক্ষেত্রে এই লড়াই মুখোমুখি। জাতীয় নাগরিকপঞ্জী (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) নিয়ে বিজেপি যে ধরনের রাজনীতি করছে তা যে সারা ভারতের জন্যে নয় সকলেই বুঝতে পারছেন। আপাতত এর মূল লক্ষ্য আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গ। অবশ্যই এর মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি আছে। বিজেপি আশা করছে যে এইভাবে সার্বিক হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারবে তারা। কিন্তু আধার থেকে ডিজিটাল রেশন কার্ড, সব কিছুতেই আমাদের দেশে যে কি হয়রানি তা সকলেই জানেন। তার ওপর আসামে হিন্দুদের একটা বড় অংশের নাম যে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ গেছে সে খবর বহুল প্রচারিত। ফলে বাঙালি হিন্দুরা যে মহানন্দে বিজেপিকে ভোট দেবেন এমনটা নয়। সেই ফলাফল সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে এবারের নির্বাচনে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হল বিজেপি এবং তৃণমূল দুজনেরই সবথেকে বড় শত্রু বাম এবং কংগ্রেস। বিজেপির ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আর তৃণমূলের ক্ষেত্রে রাজ্যে। সেই হিসেবে রাজ্যের দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দল যদি বেশিরভাগ ভোট নিজেদের ঝুলিতে নিয়ে আসতে পারে, সেক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ নিকেশ। সেটাই ঘটছে। গত কয়েকবছরে দেশ এবং রাজ্যের বিভিন্ন নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রতি সমর্থন শূন্য থেকে মহাশূন্যের দিকে পৌঁছে যাচ্ছে। বিজেপি আর তৃণমূলের আঁতাতের কথা মেনে নিলেও এটা বলতে হবে যে এই দুটি দল তো আর বামেদের হাতে ভোটের ঝুলি পৌঁছে দিয়ে আসবে না।
আরও পড়ুন, বিজেপির ঔদ্ধত্যের রাজনীতি পরাজিত হয়েছে: ‘বিজয়িনী’ মমতা
কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে বামেদের ফল যে আর ভালো হচ্ছে না তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই উপনির্বাচনের ভোটফল। গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায়ও খারাপ ফল এবারের নির্বাচনে। জোটের যোগফল শুধু সামান্য বেড়েছে খড়গপুরে। অর্থাৎ এই উপনির্বাচনে জোট করে একেবারেই লাভ হয় নি। সঙ্গে একথাও সত্যি যে জোট না করলেও যে বিশেষ কোন লাভ হত এমনটা নয়। অর্থাৎ এই রাজ্যে দু-একটি জায়গায় (যেমন বহরমপুর) হয়ত বিশেষ বিশেষ নেতার প্রভাবে কংগ্রেসের বাতি টিমটিম করে জ্বলবে। সিপিএম থেকে যাবে শহরাঞ্চলের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মনে আর প্রেসিডেন্সি কিংবা যাদবপুরের ছাত্র সংসদে। বামপন্থীরা হয়ত বারবার যুক্তি দেবেন যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেছে নিচ্ছেন গরম চাটু বা আগুনের মধ্যে কোন একটা বিকল্প। কিন্তু একেবারে নতুন মুখ কিংবা নতুন পথ না দেখালে তাদের যে নির্বাচনী লড়াইতে জেতার সম্ভাবনা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে সে রাশিবিজ্ঞানে কোন ভুল নেই। কংগ্রেসের হাত ধরে বাম ভোটের যোগফল দু-চার শতাংশ বাড়া কমা করবে, তার বেশি কিছু নয়।
তাহলে আমরা নতুন কী পেলাম এই উপনির্বাচন থেকে? তা হল একটি পদাঘাত, যা বাংলার সংবাদমাধ্যমকে বেশ খানিকটা অক্সিজেন দিয়ে গেল। এমনিতে মাত্র তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচন। গম্ভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে মাথার চুল উসকোখুসকো পরিসংখ্যানবিদ, বহু চেষ্টা করেও এরকম একটা ছোটখাটো নির্বাচনে উত্তেজনার পারদ চড়াতে অসমর্থ। সেই সময় নির্বাচনের দিন সকাল গড়াতেই রাজনৈতিক নেতাকে পদাঘাত। তিনি সটান ঝোপে।
বাংলার অন্যতম বড় সাহিত্যিক লিখেছিলেন, “অনবধানবশত যদি হুঁচট খাইয়া থাক, চৌকাঠকে পদাঘাত করিবে। সেই জড়পদার্থের পক্ষে এই একমাত্র সুবিচার।” দেশের পরিস্থিতি যা, এবং রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রতি সাধারণ মানুষের যেমন মনোভাব, তাতে অবস্থা একেবারে কেরোসিন। জড়পদার্থের প্রতি যেটুকু সুবিচার মানুষ করে থাকে, রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষেত্রে সেই পরিমাণ অনেকগুণ বেশি নেতিবাচক। এই ধরনের একটি পদাঘাতের ঘটনার পর বাঙালি জনমানসের প্রতিক্রিয়া যে কথাটি বুঝিয়ে দিল তা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের প্রতি তাদের একফোঁটা সহানুভূতিও আর বেঁচে নেই।
আরও পড়ুন, ‘তৃণমূল না এনআরসি-র কাছে হেরে গেলাম’
কিন্তু বাস্তবে আমরা যদি নিজেরা একবার ভেবে দেখি যে ঐ লাথিটা মারা হল নিজেকে, তাহলে ঠিক কেমন লাগে সে কথা ভেবে দেখার দায় থাকে অনেকটাই। তাই সংস্কৃতিবান বুদ্ধিজীবীর ভাষায় “পদাঘাত”, কিংবা আম বাঙালির “লাথি” অন্যকে লাঞ্ছিত করলে উদ্বাহু নৃত্য করার কোন কারণ নেই। নিউটনের সূত্রের বাহির হইতে প্রযুক্ত বল নিজের পশ্চাদ্দেশে প্রযুক্ত হলে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী কী হতে পারে সেটা শুরুতেই ভেবে দেখা উচিৎ জনগণের।
অবশ্যই দেশ এবং রাজ্যের অনুন্নয়নে বিভিন্ন দিক থেকে আহত হচ্ছে এই বাংলার আপামর জনসাধারণ। তবে সে ইতিহাস আজকের নয়। স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রের বঞ্চনা এবং বিশেষভাবে আমাদের রাজ্যের নেতানেত্রীদের অবহেলায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা যে সুবিধের নয় সেকথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তার অনুসিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নেতার ওপর আক্রমণের ঘটনায় চারপাশে যে উল্লাসের ছবি তাতে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। এরকম চলতে থাকলে শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত মানুষদের রাজনীতিতে আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, এবং সেক্ষেত্রে কারা দেশ চালাবে তা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। দিনকে দিন এই কারণেই রাজনীতির অধোগতি, যার ফলে ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
সুতরাং বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর আক্রমণের ঘটনায় যেমন নিন্দার ভাষা নেই, তেমনই ধিক্কার আমাদের নিজেদের প্রতি, যারা কিনা এই ঘটনা দেখে রসবোধে টইটুম্বুর। অর্থাৎ আজকের দক্ষিণপন্থী আবহাওয়ায় নীতির কথা বলে বামপন্থী কিংবা মধ্যপন্থী জোটের ভোট যে বাড়বে না তা জানাই ছিল। তাতে আর একবার সিলমোহর দিল আজকের উপনির্বাচনের ফলাফল। সারমর্ম হল প্রশান্ত কিশোরের পেশাদারি সাফল্য বা উদ্ধব ঠাকরের মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে কোন বিশেষ বার্তা দেয় না।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)