Advertisment

দুষ্টু ছেলে এবং গরম ভোটের গল্প

এই ভোটের ফলের পর, পশ্চিমবঙ্গে তাদের অনেকেই নাকি ‘আম এবং ছালা’, দুই নিয়েই সংকটে পড়তে পারেন, এমন আশংকায় ভুগছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
By Election Result, CPM-Congress Alliance

আসন্ন নির্বাচনে নতুন ফ্যাক্টর হতে পারে বাম-কংগ্রেস

এক মাস্টারমশাইয়ের কাছে গল্পটা শোনা। মাস্টারমশাই ক্লাসে প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে  পড়া ধরছেন। আর একটি দুষ্টু ছেলে বার বার হাত তুলে সবার আগে উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। উত্তরগুলো ছিল সবই প্রায় একরকম। যেমন- ‘আরে এ যে দেখি আঙুল ফুলে কলাগাছ’, ‘আরে এ যে দেখি উলুবনে মুক্তো ছড়ানো’, ‘আরে এ যে দেখি গড্ডলিকা প্রবাহ’ ইত্যাদি। সে আসলে পড়া করে আসেনি। ‘আরে এ যে দেখি’ এই কথা দিয়ে সব মেরে দিচ্ছে।

Advertisment

হিন্দুত্ববাদী নেতা এবং সমর্থকদের মধ্যে এখন এই জিনিসটা খুব দেখা যায়। আপনি হয়তো বললেন, শুনেছেন পেঁয়াজের দাম ৬০ টাকা কেজি! অমনি উত্তর, আরে মশাই পাকিস্তানকে আমরা যে ভাবে শায়েস্তা করেছি, এর আগে এমনটি কেউ করেনি। আপনি হয়তো বললেন, গাড়ি শিল্পে প্রায় দু’লাখ মানুষের চাকরি গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জবাব, এবার আমাদের লড়াই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর দখলের। আপনি হয়তো বললেন, দলিত, মুসলিমদের পিটিয়ে খুন করা হচ্ছে দেশ জুড়ে। উত্তর পাবেন, তেমন কিছুই হয়নি, যারা এসব বলছে তাদের  পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিন। সেই স্কুল ছাত্রের ‘আরে এ যে দেখি’-র জায়গায় এঁরা ‘পাকিস্তান’ বসিয়ে দিচ্ছেন সব প্রশ্নের উত্তরে। তাতে কাজ হচ্ছিল না এমনও নয়। বছরে দু’কোটি চাকরি, আচ্ছে দিন, কালো টাকা, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্মার্ট সিটি এমন অসংখ্য প্রতিশ্রুতি পালনে ডাঁহা ফেল করেও বিজেপি একাই লোকসভায় ৩০০ পার করে দিয়েছে আসন সংখ্যায়। ওং পাকিস্তানায় নমো বলে চাট্টি জল ছিটিয়ে দিলেই যদি ভোটে জেতা যায়, তাহলে আর অন্য কাজ করে আরামের শরীর ব্যস্ত করা কেন!

আরও পড়ুন, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রে কিন্তু হিসেবে ভুল করেনি বিজেপি

এই যখন অবস্থা তখনই দেখা গেল ২৪ অক্টোবর সকাল বেলা হযবরল-এর সেই কাক্কেশ্বর কুচকুচেটা চিৎকার করে বলছে, হয়নি হয়নি ফেল। হঠাৎ মিইয়ে যাওয়া ভোটে গরম ধোঁয়া। মহারাষ্ট্র আর হরিয়ানার ফল বিজেপিকে যে বার্তা দিচ্ছে তা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে তাদের কানের গোড়ার কালশিটে দাগ সহজে যাবে না। এই অবস্থায় সেই ছেলেটি হয়তো বলে উঠত, ‘আরে এ যে দেখি গরুর চোখে জল...’।

এই ভোটের ফলে অনেকগুলো বার্তা রয়েছে। এক তো, ৩৭০ বা ধর্মের শাক দিয়ে খিদে চেপে রাখা যায় না। দুটি রাজ্যের বিধানসভা এবং সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৫০-এর বেশি বিধানসভা এবং দু’টি লোকসভার ভোটের ফল বলছে সারা দেশেই বিজেপির ভোটের রেখাচিত্র নিম্নগামী। আর যে সব সুখের পায়রা নেতারা দেশজুড়ে ভাগ্য ফেরাতে পুরোনো দল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে বার কয়েক ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিয়ে ঠান্ডা মাথায়, নিশ্চিন্ত মনে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভূতচতুর্দশীর ৪৮ ঘণ্টা আগে জানতে পারলেন, তাঁরাও হেরে ভূত। পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনসভায় বলে গিয়েছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৪০ জন বিধায়ক তাঁদের দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ইঙ্গিত ছিল, ভোটের পরেই তারা সব গোরুর গুণগান গাইতে গাইতে পদ্মাসনে বসে পড়বেন। এমন সবটা না হলেও, কিছুটা তো হয়েইছে। এখন এই ভোটের ফলের পর, পশ্চিমবঙ্গে তাদের অনেকেই নাকি ‘আম এবং ছালা’, দুই নিয়েই সংকটে পড়তে পারেন, এমন আশংকায় ভুগছেন। গত শনিবার বৈশাখীর পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বিজয়া-অভিযানের ঘটনাটা অনেক সাংবাদিকই এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখছেন।

সামনে ডিসেম্বরে ঝাড়খণ্ডের ভোট। তার পর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির ভোট। সামনের বছর নভেম্বরে বিহারের ভোট। মহারাষ্ট্র-হরিয়ানার কোনও ছাপ ওই তিন রাজ্যের ভোটে পড়ে কি না, বা কতটা পড়ে তা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, ২০১৪-র লোকসভা ভোটের বিরাট সাফল্যের পর, দিল্লি, বিহারে বিজেপি বিপুল ব্যবধানে হেরে গিয়েছিল। বা, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রেকর্ড জয়ের কয়েক মাস আগে ছত্তিশগড়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশে বিজেপি পরাজিত হয়েছিল। এমন আরও নজির আছে। ফলে, এখনই এরকম ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, বিজেপির উল্টো রথের যাত্রা শুরু হয়েছে। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না, গান্ধী এবং গডসেকে সমান ভাবে পুজো করা, বা ইংরেজের কাছে মুচলেকা দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পাওয়া সাভারকারকে ভারতরত্ন  ঘোষণা করেও, মহারাষ্ট্রে একক সংখ্যগরিষ্ঠ দল হয়েও, মুখ্যমন্ত্রীর কুরসি টানা পাঁচ বছর জুটবে কি না, তা নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছে দুই ‘বন্ধু’তে।

এই পরিস্থতিতির মধ্যেই এসে বড়েছে পশ্চিমবঙ্গের তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন। মহারাষ্ট্র-হরিয়ানার সঙ্গেই হওয়ার কথা ছিল এই উপনির্বাচন, কিন্তু দুর্গা পুজো কালীপুজোর মাস বলে নির্বাচন কমিশন এক সঙ্গে ভোট করেনি। ২৫ নভেম্বর এই ভোট হতে চলেছে। আসন তিনটি হল, খড়গপুর সদর, করিমপুর এবং কালিয়াগঞ্জ। ফল ঘোষণা ২৮ নভেম্বর। খড়গপুর সদরের বিধায়ক দিলীপ ঘোষ, করিমপুরের তৃণমূল বিধায়ক মহুয়া মৈত্র লোকসভায় ভোটে জিতে সাংসদ হওয়ায়, এবং কালিয়াগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক প্রমথনাথ রায়ের মৃত্যুতে এই তিনটি আসন খালি হয়েছে।

আরও পড়ুন, সিপিএমের ১০০ বছর, সংকট যতটা মার্ক্সবাদীদের ততটা বামপন্থীদের নয়

তিনটি বিধানসভায় যে-ই জিতুক, তাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কোনও অদল-বদল হবে না। তবু এই তিনটি নির্বাচন রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দুটি কারণে। প্রথম কারণ, অতীতে একদা ‘বাঘ’ থেকে গণ-অভিশাপে মূষিকে পরিণত হওয়া দুই শক্তি, বাম-কংগ্রেসের যৌথ তাকতের একটা আভাস এই এই মিনিস্য মিনি ভোটে মনে হয় আমরা দেখতে পাব। নতুন মাত্রা নিয়ে এই যৌথ শক্তির ২০২০তে মাথা চাড়া দেওয়ার সামান্য সম্ভাবনাও নেই, এমন কথা জোর দিয়ে কিন্তু এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগেই কংগ্রেসের বিধান ভবনে সোমেন মিত্রদের সঙ্গে চা খেয়ে এসেছেন বিমানবাবু, সূর্যবাবুরা। দিল্লিতে হর কিষান সিং সুরজিৎ ভবনের উদ্বোধনে সীতারাম ইয়েচুরি যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন দেখা যাচ্ছে মঞ্চে পেছনে বড় মাপের দুটো ছবি, একদিকে সুরজিৎ আরেক দিকে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

আসুবিধে একটা অবশ্য আছে। সিপিএমের সব থেকে বড় সমস্যা হল, এক সময়ে যারা রাশিয়ায় শীত পড়লে এখানে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোতে যেতেন, তারা এখনও বিদ্যাসগর থেকে বিবেকান্দ, রামকৃষ্ণ থেকে রবীন্দ্রনাথ সবাইকেই চেনার চেষ্টা করেন মার্ক্সের কোট পরিয়ে। সেই কারণেই সুভাষ বোস হয়ে যান তোজোর কুকুর, আজাদি হয়ে যায় ঝুটা। এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, দেশপ্রেম, মানুষের জন্য আত্মত্যাগ, এইসবের নিরিখে, শত সঠিক সমালোচনা সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা অন্য অনেক দলের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। গত প্রায় ১০০ বছরে তাদের ইতিহাস ঘাঁটলে এর পক্ষে অসংখ্য প্রমাণ দাখিল করা সম্ভব। কিন্তু পা দেশের মাটিতে না থাকার ফলে এরাই দলের কর্মসূচি ঠিক না ভুল জানতে স্তালিনের অনুমতি নেন বা কখনও স্লোগান ওঠে চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।

আজকের যে সিপিএম, তা মূলত তাদেরই, মানে কট্টরপন্থীদেরই হাতে। যারা একদা জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি।  এই যে বিভিন্ন অজুহাতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সম্প্রতি রাজ্য সিপিএমের  সম্পাদকমণ্ডলী থেকে মানব মুখার্জি এবং গৌতম দেবকে সরিয়ে দেওয়া হল, এঁরা দু’জনেই কিন্তু ছিলেন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী করার পক্ষে। বিমান বসু-সূর্যকান্তরা নয়। মানব রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে এসেছিলেন বছর দেড়েক আগে। গৌতম দেব অসুস্থ, কিন্তু তাঁর মাথা অকেজো হয়ে যায়নি।  এখন যে বিমানবাবুরা কংগ্রেসের সঙ্গে ভাব করছেন, তা একেবারেই ঠেলায় পড়ে। যে অবস্থাকে বাংলায় বলে ‘বাবাজি’, যে অবস্থায় পড়লে ‘চাচা’ চিন্তিত হয়ে পড়েন প্রাণ নিয়ে। আন্তরিক ভাবে মোটেই নয়। ২০১৬-এর বিধানসভা ভোটেও এই দুই দলে জোট হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম, সিঙ্গুরে অধীর চৌধুরী বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর দু’কিলোমিটার দূরে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সিপিএমের নেতা পরের বক্তা। অধীরবাবু নেমে চলে গেলেন, (জানি না তার পর ভোলগা বা ইয়াংসির জল ছেটানো হয়েছিল কি না মঞ্চে) তার পর হাসি মুখে মঞ্চে উঠলেন সিপিএমের নেতা, পাছে অধীর ছুঁয়ে দিয়ে অপবিত্র করে দেন মার্ক্সবাদী তনু।

মনে হচ্ছে বাংলার মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে (ভোট এখন ৭ শতাংশ) এবারের জোটটা একটু পাকা-পোক্ত হবে। কংগ্রেস থেকে বলা হয়েছে যৌথ ভাবে প্রার্থী ঘোষণার। সিপিএমও মনে হচ্ছে তাতে রাজি। স্থির হয়েছে কালিয়াগঞ্জ এবং খড়গপুরে লড়বে কংগ্রেস (কংগ্রেসের ভোট এখন ৫ শতাংসের একটু উপরে) আর করিমপুরে সিপিএম। ভোটে এই জোট যে ফল করবে তাতে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যাবে এই দুই শক্তি এই রাজ্যের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে না তারা কোনও নতুন মাত্রা যোগ করলেও করতে পারে ভবিষ্যতে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তুলনায়, এই দুই দলের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার রেকর্ড, অন্য অনেক দলের থেকে ভালো। হ্যাঁ, জরুরি অবস্থা, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম মনে রেখেই বলছি। কেউ বলতেই পারেন, কানার মধ্যে ঝাপসা। আপত্তি করার কোনও জায়গা নেই। তবুও তো তুলনা একটা করতেই হয়। ফলে এই দুই শক্তির মুছে যাওয়াটা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়। আর দ্বিতীয় যে দিকে নজর থাকবে সবার এই এক চিলতে উপনির্বাচনে, সেটা হল, তৃণমূল এবং বিজেপির ভোট কার কতটা কমল বা বাড়ল? তা থেকেও একটা ইঙ্গিত পাওয়ার চেষ্টা করবে সব পক্ষই। এই ভোটকে লিটমাস টেস্ট নিশ্চই বলা যাবে না, কিন্তু ‘ক্লাস টেস্ট’ তো বটেই। দেখা যাক কোন ছাত্র কেমন ফল করে!

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

bjp CONGRESS Cpm
Advertisment