Advertisment

বিজেপির হিন্দু উদ্বাস্তু প্রেম একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচার

এদেশে আজও দরিদ্র এবং ভূমিহীন কৃষকদের অধিকাংশই তফশিলি জাতির মানুষ। ভারতের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে আজকের দিনে এই উদ্বাস্তু মানুষদের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ বা তার বেশি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
CAA, Hindu Refugee

ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস আর্কাইভ

অমিত শাহের জুনিয়র মন্ত্রী জি কে রেড্ডি বলেছেন যে সারা দেশে এন আর সি করার কোনও পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় সরকার এখন করেনি। এদিকে ভারতবর্ষের সব বড় শহর গ্রাম গঞ্জের মানুষ রাস্তায় নেমেছেন এন আর সি এবং নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। পাবলিক বুঝি বা ভুল বুঝেছে, অথবা তাদের ভুল বোঝানো হচ্ছে, এমনটাই মত মোদী সরকারের মন্ত্রীদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হয়ত বা ভুল বুঝেই ঝাড়খণ্ডের একটি জনসভায় দাবি করেছেন যে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেই সারা দেশে এনআরসি-র বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। এহেন অবস্থায়, যেখানে সরকারের বড়, ছোট, মাঝারি নেতাদের কথায়ে বিচ্যুতি অথবা দ্বন্দ্ব প্রকট হয়, তখন জনগণের ভাবনাচিন্তা করা জরুরি হয়ে ওঠে। ভাবতে হলে একটু পিছিয়ে ভাবাই ভাল যে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের কোন পদে ভুলটা হয়েছিল।

Advertisment

এন আর সি র রাজনীতি এবং আনুষঙ্গিক দাবিদাওয়াগুলো ছিল অসমীয়া সাংস্কৃতিক রাজনীতির স্বতন্ত্র একটি অঙ্গ। সারা ভারতবর্ষে এনআরসি করার রাস্তাটি তৈরি করেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন পাশ করান। এই আইনের মাধ্যমে তিনটি নতুন বিষয় ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের অংশ হয়ে ওঠে। প্রথমত, “বেআইনি অভিবাসী” শব্দটি এই প্রথম আইনি স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয়ত, “বেআইনি অভিবাসী” দের সন্তানরা ভারতের মাটিতে জন্ম গ্রহণ করলেও তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তৃতীয়ত, ১৪ (এ) ২ নম্বর ধারার মাধ্যমে এনআরসি কে সারা ভারতবর্ষে কার্যকর করা হয়। আজকের বাঙালি উদ্বাস্তুদের মাথার উপর ঝুলে থাকা তলোয়ারটি এই আইনের মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছিল। কাজেই এনআরসি অদেশের যেখানে, যখনই হোক না কেন, তার ফলাফলের দায়িত্ব বি জে পি র বৈকি।

আরও পড়ুন, ঋত্বিকের ছবিতে উদ্বাস্তুরা কি কেবলই হিন্দু?

এই আইনের ফলে ক্ষতি কার হল? বি জে পির নেতারা দাবি করছেন, ক্ষতি শুধুমাত্র ‘বেআইনি অভিবাসীদের’। তাঁরা মুসলিম হতে পারেন, অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি অথবা, আসামের এনআরসি-র অভিজ্ঞতা থেকে বলা যেতে পারে যে এঁদের বেশির ভাগটাই তফশিলি জাতি ভুক্ত বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু। এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানুষদের ধর্ম এবং জাতির হিসেব সরকার না জানালেও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, বি জে পি নেতা এবং বাঙালি উদ্বাস্তু নেতাদের মতে, তালিকা থেকে বাদ পড়া ১৯ লক্ষের বেশি মানুষের মধ্যে  অনেকাংশই বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তু।  তিনসুকিয়ার খেরবারি গ্রামে নিহত পাঁচ বাঙালি শ্রমিকের নামগুলো মনে করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়ে যে এন আর সির ছায়া কাদের জীবনে অন্ধকার ডেকে এনেছে। শ্যামল বিশ্বাস, অনন্ত বিশ্বাস, অবিনাশ বিশ্বাস, সুবল দাস আর ধনঞ্জয় নমঃশূদ্ররা কীভাবে পৌঁছেছিলেন আসামে? পার্টিশন থেকে ভাষা আন্দোলন, যুদ্ধ আর দারিদ্রের বোঝা কাঁধে এই মানুষগুলো ভারতে এসেছিলেন নতুন ভবিষ্যৎ আর সাংবিধানিক অধিকারের আশায়। এই নামগুলোর প্রতি যদি কোনও মমতা বা আত্মীয়তাবোধ যদি থেকে থাকত, তাহলে আইন করে এঁদের এবং এঁদের সন্তানদের বেআইনি অভিবাসী বলে দাগিয়ে দেওয়া হিন্দু উদ্বাস্তু দরদীদের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী ১৯৪৭ থেকে মার্চ ১৯৫৮র মধ্যে ভারতে আসেন আনুমানিক ৪১ লক্ষ উদ্বাস্তু। এঁদের মধ্যে ৩৪ লক্ষ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল ১০ টি রাজ্যে। পয়লা জানুয়ারি, ১৯৬৪ থেকে ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ এর মধ্যে ভারতে এসেছিলেন ১১.১৪ লক্ষ উদ্বাস্তু। এঁদের মধ্যে আনুমানিক ৩,৭৭,১২৫ জন মানুষকে ভারত সরকার ১৭ টি রাজ্যে পুনর্বাসিত করে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়া প্রথম তরঙ্গের ৭ লক্ষ উদ্বাস্তু এবং দ্বিতীয় তরঙ্গের ৭.৪ লক্ষ উদ্বাস্তুর কোনও হদিশ সরকারি খাতায় মেলে না। কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রকাশিত পি এন লুথরার লেখা ‘পুনর্বাসন’ বইটির মতে উদ্বাস্তুদের মধ্যে দ্বিতীয় তরঙ্গের ৭০ শতাংশ ছিল কৃষক। এদেশে আজও দরিদ্র এবং ভূমিহীন কৃষকদের অধিকাংশই তফশিলি জাতির মানুষ। ভারতের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার অনুযায়ী অনুমান করা যায় যে আজকের দিনে এই উদ্বাস্তু মানুষদের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ বা তার বেশি। বিভিন্ন তরঙ্গের এবং বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের পেশাগত চরিত্র ভিন্ন। এঁদের মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র তফশিলি জাতি ভুক্ত ভূমিহীন কৃষক এবং মজুর। বেসরকারি সংখ্যা বাদ দিয়ে, রক্ষণশীল সরকারি হিসেব অনুযায়ী ভাবলেও উদ্বাস্তুদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

নতুন নাগরিকত্ব আইন কি এঁদের আদৌ কোনও সাহায্য করবে? ১৯৮৯ সালে তৎকালীন শ্রী আশুতোষ লাহার নেতৃত্বাধীন সংসদীয় এস্টিমেট কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে একটি রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টে স্পষ্ট বলা আছে যে এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে বেশির ভাগের কাছেই কোন নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। দেশ জুড়ে এনআরসি বলবৎ করা হলে এই মানুষগুলি যে চরম কষ্টের সম্মুখিন হবেন তা সরকারি রিপোর্টেই স্পষ্ট। ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব আইন সম্বন্ধীয় সংসদীয় যৌথ কমিটির রিপোর্টে দেওয়া গোয়েন্দা দফতরের বয়ান অনুযায়ী সারা ভারতবর্ষে মোট ৩১,৩১৩ জন উদ্বাস্তুকে নাগরিকত্ব দেবে এই নতুন আইন। বাকিদের নতুন করে আবেদন করতে হবে এবং তাদের অন্তর্ভুক্তি নির্ভর করবে র’এর গোয়েন্দাদের দেওয়া রিপোর্টের উপর। প্রধানত তফশিলি জাতি ভুক্ত এই হিন্দু উদ্বাস্তুদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা ধর্মীয় বিভেদের কারণে অত্যাচারিত হয়ে ঘর ছেড়েছিলেন।

আরও পড়ুন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন

আসামের বি জে পি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দাবি করেছেন যে নতুন এনআরসি-র ভিত্তিবর্ষ হতে হবে ১৯৫১ সাল। কাজেই প্রথম এবং দ্বিতীয়, দুই তরঙ্গের এবং বিভিন্ন রাজ্যের সমস্ত উদ্বাস্তুরাই একসঙ্গে বেনাগরিকত্বের জাঁতাকলে পড়বেন। নতুন নাগরিকত্ব আইন যে আদৌ এঁদের সাহায্য করবে না তা যৌথ কমিটির রিপোর্টেই স্পষ্ট। যদি এই দরিদ্র তফশিলি জাতির কৃষক আর মজুরদের হিন্দু সমাজের অথবা রাষ্ট্রের কল্পনার অংশ হিসেবে মেনে নেওয়া হত তাহলে নতুন আইন তাঁদের ফের আবেদন এবং গোয়েন্দা তদন্তের সাঁড়াশি প্যাঁচে না ফেলেই তাঁদের সরাসরি নাগরিকত্ব দেওয়ার চেষ্টা করত। আরেকবার রাষ্ট্রহীন হয়ে তফসিলি উদ্বাস্তুরা হয়ত প্রমাণ করবেন যে কল্পিত হিন্দু রাষ্ট্রে তাঁরা চিরকালই আশ্রয়হীন।

(হিমাদ্রি চট্টোপাধ্যায় কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Citizenship Amendment Act
Advertisment