Advertisment

সিএএ সম্পর্কে বাংলাদেশের আশঙ্কা বাড়িয়ে ভুল করছে ভারত

বিজেপির অন্দরমহলে নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য প্রকাশ্যে না বললেও ভিতরে ভিতরে মনে করছেন, এই বিলটি আনার আগে আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
caa nrc bjp

কলকাতায় সিএএ-র সমর্থনে বিজেপির মিছিল। ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

দুটি ছোট্ট খবর। কিন্তু দুটিই আমাকে সম্প্রতি খুব পীড়া দিয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের এক সহকারী হাইকমিশনারের গাড়ির উপর গুয়াহাটিতে উন্মত্ত জনতার আক্রমণ। এ ঘটনার প্রতিবাদে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক ঢাকায় কর্মরত ভারতের হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠায়। ভারতে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সুষ্ঠু নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে ঢাকা। আমার মনে পড়ে না এর আগে কবে এভাবে ভারতের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের হাইকমিশনারকে ঢাকা ডেকে পাঠিয়েছে বা বলা ভালো, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে।

Advertisment

দ্বিতীয় খবরটি দেখে মন আরও খারাপ হয়ে গেল। বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত, এক হিন্দু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ সরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকায় গিয়ে সে সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় 'mole' বা গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিল। বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ভারতের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, কেন এমন ঘটনা ঘটেছে।

ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক। ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে নিশ্চিন্ত, নিরাপদ সম্পর্ক ছিল এটি। সেই সম্পর্কের পটভূমিতে এনআরসি অর্থাৎ আসামের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি এবং সংসদের নাগরিকত্ব আইন, এই দু'টি ঘটনায় দেশের ভিতরেও আগুন জ্বলছে। শুধু আসাম নয়, রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা, বেঙ্গালুরু থেকে মুম্বই, সর্বত্র শুরু হয়ে গেছে নাগরিক সমাজের আন্দোলন। বিক্ষোভ। বাস পুড়ছে। ট্রেনে ভাঙচুর। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ছাত্রদের লাইব্রেরির মধ্যে ঢুকে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস চালিয়েছে।

আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব বিলের মূল্য দিতে পারবে তো ভারতবর্ষ?

এই সব ঘটনায় বিজেপির ভোট বাড়বে না তৃণমূলের লাভ হবে জানি না, জানতে আপাতত চাইছিও না। হিন্দু-মুসলমান ভোটার বিভাজন, যাকে বলে মেরুকরণের রাজনীতি, তা সত্য সত্য কার্যকর হবে কি না তা নিয়ে রাজনেতারা বিশ্লেষণ করুন। আমার শুধু মনে হচ্ছে, এই সন্ত্রাস বন্ধ হোক। এই সাম্প্রদায়িক হানাহানি এখনই বন্ধ হোক।

বিজেপির অন্দরমহলে নেতৃত্বের একাংশ অবশ্য প্রকাশ্যে না বললেও ভিতরে ভিতরে মনে করছেন, এই বিলটি আনার আগে আরও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর গুয়াহাটি এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে যে বৈঠক করার কথা ছিল, তা বাতিল করতে হয়েছে। তাহলে কি এ ধরনের হাঙ্গামা যে আসামে হতে পারে, তার কোনও আগাম তথ্য গোয়েঙ্গাদের কাছেও ছিল না? নাকি গোয়েন্দারা তাঁদের প্রভুদের কেবল 'ফিল গুড' রিপোর্ট দিতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে বাংলাদেশের বিদায়ী হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলিকে এই বিল সংসদে পাস হওয়ার পরে নিজের বাসভবনে ডেকে পাঠান। দীর্ঘ বৈঠকে মোদী আশ্বাস দেন যে কোনও ভুল বোঝাবুঝি হবে না। একজন ব্যক্তিকেও ঢাকায় ফেরত পাঠানো হবে না। কোনও অনুপ্রবেশকারীকে 'পুশ ব্যাক' করা, ডিটেনশন ক্যাম্প, এসব কিছুই হবে না।

এ তো ভারতের ভিতরকার রাজনীতি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তার জন্য বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করার কোনও প্রশ্নই উঠছে না। বাংলাদেশও ভারতকে জানিয়েছে, বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু তাদেরও তো অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আছে। আজ যদি ভারতের এই সিএএ-র পরেও হাসিনা সরকার চুপ করে থাকে, তবে সেদেশের উগ্রবাদীদের সোনায় সোহাগা। খালেদা জিয়ার বিএনপি ও তার সঙ্গী জামাতের তো প্রধান অভিযোগই হলো যে হাসিনা নাকি ভারতের 'এজেন্ট'। এই উগ্রপন্থা যদি বাংলাদেশে বাড়ে, তবে তাতে ভারতের লাভটা কোথায়?

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন ও তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়ন করেন। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্যের হাতে নিহত হন।

আরও পড়ুন: নয়া নাগরিকত্ব বনাম জুতা হ্যায় জাপানি, পাৎলুন ইংলিশস্তানি

সেই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত বাংলাদেশে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে এক নতুন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গোটা পৃথিবীর সমস্ত আর্থিক রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ভালো। ভারতের আর্থিক অগ্রগতির হারের চেয়েও ভালো। বাংলাদেশ এক বিরল ইসলামিক রাষ্ট্র যেখানে হাসিনা সরকার পাক সন্ত্রাস দমন করছে। জঙ্গিদের ধরছে এবং ভারতের দাবি মেনে বহু জঙ্গি চাঁইকে ভারতে প্রত্যর্পণও করা হচ্ছে। এত কিছুর পর সেই বাংলাদেশকেই চাপের মধ্যে ফেলা কি ভারতের দিক থেকে উচিত কাজ হলো?

যখন বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় দিবস পালন করছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের নৈতিক ও বস্তুগত সমর্থনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেই পালন করছেন, তখন ১৯৭১ সালের সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি ভারতের সমর্থনের কথা ভুলে গিয়ে অনুপ্রবেশ-বিরোধিতাকেই প্রধান আলোচ্যসূচি করা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা সমস্ত ভারত-বিরোধী নাশকতামূলক কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। গত পাঁচ-ছ বছরে মোদি হাসিনা বৈঠকও তো কম হলো না। এত বৈঠক! ধাপে ধাপে সম্পর্ক মধুরতর হলো। তিস্তা না হলেও স্থলসীমান্ত চুক্তি হলো। আর্থিক চুক্তি হলো। ত্রিপুরা থেকে রেললাইন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উন্নততর ব্যবসা-বাণিজ্য, ইত্যাদি। ক'দিন আগে যখন হাসিনা দিল্লি এলেন, সেদিনও হায়দারাবাদ হাউজে মোদী-হাসিনার মধ্যাহ্নভোজনের অনুষ্ঠানে ছিলাম। দেখেছিলাম, কী মধুর সম্পর্ক।

modi hasina meeting দিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

আর আজ? জানি না লোকসভায় ভোটের দিন কেন মোদী ভোট দিলেন না, দলের হুইপ থাকা সত্ত্বেও। মোদী-শাহর মধ্যে কোনও ভেদ না থাকলে এও কি ছিল মোদীর ভিন্ন রণকৌশল? জানিনা। এটুকু তাই বলব, বাংলাদেশের মতো দেশকে এভাবে বিব্রত করা সঠিক কূটনৈতিক রণকৌশল নয়। মোদী নিজে এটা বুঝছেন না, বা বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর যে বুঝতে পারছেন না, তা নয়। বুঝছেন বলেই তো জয়শঙ্কর বিজয় দিবসে দিল্লিতে হাইকমিশনারের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন সটান।

তবে কলকাতায় ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচের সময় প্রধানমন্ত্রী বা অমিত শাহ বা ক্রীড়ামন্ত্রী, এমনকি ভারতের কোনও মন্ত্রীর বদলে রাজ্যের মন্ত্রীকে প্রোটোকল মন্ত্রী করে শেখ হাসিনার আগমনের সময় বিমানবন্দরে পাঠানো আমার ভালো লাগেনি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যুক্তি দিয়ে চলে না। তার চেয়ে বড় হল দু'দেশের সম্পর্কের আবেগ। মোদী তা বোঝেন না তা তো নয়। তবে কেন এমন হচ্ছে? কেন এমন হলো?

তবে ন্যায়-নীতি নিয়ে আলোচনা শুধুই সম্পাদকীয় স্তম্ভের একচেটিয়া অধিকার। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি কে, কীভাবে ন্যায়-নীতিকে দূরে সরিয়ে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি করেছে এবং করে চলেছে, তা তো আমরা রোজ দেখছি। মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। সংখ্যালঘু মুসলিমদের উন্নয়ন না করে যেভাবে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ভোট-রাজনীতি হয়েছে, প্রগতিশীলতার সঙ্গে তাকে যুক্ত করা হয়েছে সুকৌশলে, তার অ্যান্টি-থিসিস হিসাবেই বিজেপির এত বাড়-বাড়ন্ত। একে বলা হয় 'কার্য-কারণ সম্পর্ক'।

আরও পড়ুন: জামিয়া মিলিয়ার অশান্ত রাত, এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে

আর বিজেপি যখন হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির তাস খেলে ভোট জিততে মরিয়া, তখন প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস কোথায়? রাহুল গান্ধীকে তো দেখাই যাচ্ছে না। যদিও তিনি নাকি ফিরছেন। সোনিয়া গান্ধী বিবৃতি দিচ্ছেন, অসুস্থ শরীরেও তিনি সচেষ্ট, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী একবার ইন্ডিয়া গেটে বসলেন। কিন্তু রাজ্যে-রাজ্যে শতাধিক বছরের প্রাচীন কংগ্রেস কোথায়? বরং বলব, পশ্চিমবঙ্গে যেখানে শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ ভোট মুসলমানদের, যেখানে আমার-আপনার মত বহু হিন্দু, জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও মুসলিম-বিরোধী নন, যেখানে প্রধান সংবাদমাধ্যম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আজও কঠিন-কঠোর, সে রাজ্যে বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দেখা যাচ্ছে রাজপথ থেকে জনপথে। তিনি আবার আন্দোলনে ফিরে এসেছেন। মোদীর বিরুদ্ধে ফের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছেন। কংগ্রেস নয়, মমতা।

আবার মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র আলিগড় বা জামিয়া বা যাদবপুরে বিক্ষোভ হয়নি। কেন একাধিক ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটেও বিক্ষোভ চলছে? কেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভে সামিল হয়েছে? বিষয়টি মুলায়ম বা মায়াবতীর রাজনৈতিক দলের আন্দোলন নয়, বরং রাজ্যওয়াড়ি ছাত্র আন্দোলনে ২০-২৫ বছর বয়সের ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে।

Citizenship Amendment Act nrc caa
Advertisment