কনকনে শীতে, রাতের অন্ধকারে, কোলে বাচ্চা নিয়ে, ওঁরা বসে ছিলেন। বাচ্চাগুলোর যাতে ঠাণ্ডা না লাগে, তাই বুকের কাছে ধরে বসে ছিলেন। কিন্তু চলে যান নি। প্রতিবাদ সমাবেশ শেষ করে, দিল্লির জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জনগণমন গেয়ে, তবেই ওখান থেকে নড়েছেন ওঁরা।
এই প্রথম নয় যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গান হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। এমনও নয় যে এই প্রথম ভরতের সংবিধান অথবা পতাকা ব্যবহৃত হয়েছে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহর এবার বোধহয় বোঝা উচিত, যে তাঁদের হাত থেকে জাতীয়তাবাদী প্রতীকচিহ্নগুলি ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলিকে আপন করে নিয়েছে প্রতিবাদীরা। এবং মুসলিম, বামপন্থী, বা লিবারেলদের গায়ে 'অ্যান্টি-ন্যাশনাল' বা রাষ্ট্র-বিরোধী তকমা সেঁটে দেওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া সৈন্যবাহিনীর পক্ষে। এই কৃতিত্ব প্রকৃত অর্থেই অসাধারণ।
আরও পড়ুন: এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনার সময়
মোদীর মন্ত্রীদের মধ্যে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, যা তাঁরা ঢাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন উচ্চগ্রামের ভাষণ বা ধিক্কারের মাধ্যমে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ভারী বুটের নিচে আন্দোলন থেঁতলে দেওয়ার যে কদাকার প্রচেষ্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন, তার পর থেকে তাঁকে এবং তাঁর সহযোদ্ধা যোগী আদিত্যনাথকে ফ্রন্টলাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে আরেকটু আপাত গ্রহণযোগ্য কিছু মুখকে সামনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যেমন ধরুন দীপিকা পাড়ুকোনের মোকাবিলা করতে এগিয়ে এসেছেন স্মৃতি ইরানি, বলেছেন, দীপিকা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন যারা 'ভারতকে ভাঙতে চায়', এবং যারা 'একজন করে সিআরপিএফ জওয়ান' নিহত হলে 'উৎসব পালন করে'।
এটা একটু লজ্জার কথাই বটে যে ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে একজন বলিউডি তারকার সঙ্গে টক্কর দিতে হচ্ছে, কিন্তু এখানেও কাজ করছে সেই অস্থিরতা। প্রকাশ জাভড়েকর অথবা নীতিন গড়করির মতো অপেক্ষাকৃত মৃদুকন্ঠিদের গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে ইদানিং, যাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি আরো একবার উজ্জ্বল হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত চিঁড়ে ভেজে নি।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ভারতের মুসলমানদের একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছেন যে তাঁদের নাগরিকত্ব হারানোর কোনো ভয় নেই, এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) খুব শিগগিরই লাগু হচ্ছে না। কিন্তু একটি সম্প্রদায় নীরবে, গত ছয় বছর ধরে, তাদের বিরুদ্ধে গোরক্ষা সমিতি এবং গণপ্রহার বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছে। আজ যখন তারা ভাষা খুঁজে পেয়েছে, তাদের মুখ বন্ধ করা অত সহজ হবে না।
মুসলমান প্রতিবাদ রুখতে যোগী আদিত্যনাথের সরকার যতটা হিংসা প্রয়োগ করেছে, ততটা কোনো রাজ্য সরকার করেনি। কিন্তু তাঁর পুলিশ দিয়ে প্রায় ৩০ জন মানুষকে সাবাড় করিয়ে দিয়েও তিনি ফেল।
আরও পড়ুন: দীপিকা পাড়ুকোনরা দেখিয়ে দিচ্ছেন বলিউডে মেয়েদের দমই বেশি
প্রতিবাদীরা আর স্রেফ মুসলমান নন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিজেপির হাল্লা বাহিনীর ভাষায় 'লিবটার্ড' এবং 'সিকুলারিস্ট'রা। এবং যোগ দেওয়ার কারণ এই নয় যে তাঁদের মনে ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার ভয় তৈরি হয়েছে। কারণ এই যে তাঁরা বুঝতে পারছেন, মোদী সরকার ভারতে যা করছে, তা কী ভীষণ অন্যায়। এতটাই অন্যায় যে কাউকে 'টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং' বলতে হলে তাদেরকেই বলতে হয়। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই একথা বলছি। রিপোর্টার হিসেবে দীর্ঘদিন পাকিস্তানে কাজ করার দৌলতে আমি সেদেশের সেনাবাহিনীর অজস্র শীর্ষকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকেই আমাকে বলেছেন, তাঁরা নিশ্চিত যে আরও একবার ভাঙবে ভারত, কারণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন এদেশের বিপুল সংখ্যক মুসলমান জনসাধারণ।
যদি সত্যিই তা হয়, তবে তার কারণ জেএনইউ-এর ছাত্রদের দেওয়া স্লোগান হবে না। কারণ হবে আমাদের নির্বাচিত, সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদের হাতে যে ব্যাপক ক্ষমতা, তার অপব্যবহার।
কাশ্মীর প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য শুনে খুশি হয়েছি। অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া, বা ১৪৪ ধারার মতো একটি ঔপনিবেশিক আইন বলবৎ রাখা যে 'ক্ষমতার অপব্যবহার', তা দ্বিধাহীন ভাষায় প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বাস্তবিকই তাই। এবং মোদী দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সীমা ছাড়িয়ে গেছে এই অপব্যবহার। আমাদের শহরে শহরে, পথেঘাটে, ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে যে একমাস ধরে প্রতিবাদ চলছে, এর কারণ হলো মানুষ বুঝতে পারছেন, ভারতের শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্তরে তাঁরা কতটা অসহায়।
আরও পড়ুন: দেশের ছাত্রছাত্রী বনাম দেশের সরকার
উত্তর প্রদেশে এতদূর গেছেন যোগী আদিত্যনাথ, যে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত সমাবেশে উপস্থিত আন্দোলনকারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেছে তাঁর সরকার। এই ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার সম্পর্কে এতই নিশ্চিত তিনি যে জেলে পুরে দিচ্ছেন লেখক, অভিনেতা, কবি, সাধারণ গৃহবধূদের। কিন্তু যে মানুষটার তিনি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক স্তরে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন মোদী। একজন আধুনিক কূটনীতিক তথা রাষ্ট্রনেতার। সেই ভাবমূর্তির যা দশা, তাতে মেরামতি একপ্রকার অসম্ভব। কিন্তু এবার বোধহয় দেশের মধ্যেও তাঁর ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। অপ্রকৃতিস্থ জাতীয়তাবাদীদের বৃত্ত ছেড়ে বেরিয়ে প্রতিবাদীদের সঙ্গে কথা বলার সময় এসেছে। উপলব্ধি করার সময় এসেছে, যে তাদের হাতেও পরিচিতি স্বরূপ রয়েছে ভারতের সংবিধান, ভারতের পতাকা।
(লেখিকা বর্ষীয়ান সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত)