নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) সংক্রান্ত দেশব্যাপী প্রতিবাদের যে দিকটা সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ছে, তা হলো আন্দোলনের অগ্রভাগে অল্পবয়সী, রণং দেহী যুবতীদের আবির্ভাব। এঁরাই আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন। শুধুমাত্র কিছু অবিস্মরণীয় ফটোতে যাঁদের দেখা যাচ্ছে তাঁরা নন, মিডিয়ার সামনে এসে নিজেদের মনের কথা দ্ব্যর্থহীন, তেজস্বী ভাষায় ব্যক্ত করছেন আরও অসংখ্য মহিলা।
অন্য যে দিকটা নজর কেড়েছে, এবং যা কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা হলো প্রায় প্রতিটি প্রতিবাদেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে যুবসমাজ, প্রধানত ছাত্রছাত্রীরা। মুসলমানদের মধ্যেও এটা লক্ষণীয়, যে সমাজের পরম্পরাগত নেতাদের হাতে আর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব নেই। দিচ্ছেন অল্পবয়সী, প্রগতিশীল পুরুষ ও মহিলারা।
স্পষ্টতই বদলাচ্ছে সময়, এবং আমরা দেখছি এক নতুন ভারতের জন্মলগ্ন, যার উৎস হচ্ছে বর্তমানের মৃতপ্রায়, অসুস্থ রাজনৈতিক আবহ, যা একসময় হয়ে গিয়েছিল আমাদের গণতন্ত্র। পথেঘাটে বেরোলে আঁচ পাওয়া যাচ্ছে রাগের গনগনে আগুনের।
এবারটা হিসেবে ভুল হয়ে গেছে বড্ড। অমিত শাহকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে দ্বিতীয় মোদী সরকারের সম্ভবত সবচেয়ে বড় বাজি ছিল কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা কায়েম করা, এবং সমস্ত রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে রাতারাতি কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা। এই পদক্ষেপের স্পর্ধা ছিল স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো, ভারতের সংবিধানে কাশ্মীরবাসীর প্রতি যে অঙ্গীকার করা হয়, তার ছিটেফোঁটাও না মেনে। এছাড়াও ছিল এই পদক্ষেপের বিপুল 'হিউম্যান কস্ট', অর্থাৎ মানবীয় ক্ষতি।
কাশ্মীর এবং ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন করে দেওয়া, পাশাপাশি সমালোচক পেলেই 'দেশদ্রোহীতার' অভিযোগ দায়ের করার হুমকি, এই দুইয়ে মিলে মোটামুটি নিশ্চিত করা গিয়েছিল যে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বড়সড় আওয়াজ উঠবে না - খোদ কাশ্মীরে অবশ্য তা করা যায়নি। এই 'সাফল্যের' নেশায় বুঁদ হয়ে, এবং সরকারের ইশারাতেই অনন্ত বিভাজনমূলক প্রচার তথা বিদ্বেষ-ছড়ানো অভিযানের কল্যাণে দেশে মেরুকরণের আবহ যথেষ্ট পোক্ত হওয়ায়, এই সরকার ভেবেছিল, সিএএ-র ব্যাপারেও কার্যত 'ওয়াক ওভার' পাওয়া গেল।
হতবুদ্ধি হয়ে দেশ দেখল, কী অনায়াসে, নামমাত্র বিরোধিতা কাটিয়ে, সংসদের উভয় ভবনেই পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব আইন। শাসকদলের মনে হয়েছিল, এই বাজিও জেতা হয়ে গেছে, এখন স্রেফ এখানে সেখানে কিছু মুসলমানদের প্রতিবাদের ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই হবে। পাশাপাশি, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া এবং আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে যদি শুধুমাত্র গায়ের জোর খাটিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে সরকার, তাহলেই কেল্লা ফতে। সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ যে এই আকার ধারণ করবে, তা তাদের দূরতম কল্পনাতেও আসে নি। হিন্দি দৈনিক 'জনসত্তা'য় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে কিছু অজ্ঞাত বিজেপি নেতা এমনটা স্বীকারও করে নিয়েছেন। প্রায় এক মাস হয়ে গেল, নিরন্তর চলছে অভূতপূর্ব আয়তনের এই আন্দোলন।
কী হলো তবে? মানুষের রাগের এই বিরাট লাভাস্রোত কোথা থেকে এল?
এটা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক চরম অসহায়তার মনোভাব দানা বাঁধছে বেশ কিছুকাল যাবত। এর পাশাপাশি শিকড় গেড়েছে এই উপলব্ধি, কোনও রাজনৈতিক দলকেই বিশ্বাস করা যায় না, যা করার শেষমেশ নিজেদেরই করতে হবে। যদিও এই মনোভাব ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে সেই ২০১১ সালের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই, বা ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লির গণধর্ষণ এবং হত্যার প্রতিবাদে বিশাল আন্দোলন থেকে, মোদী জমানাতেও আমরা দেখেছি ক্রমশ বাড়তে থাকা গণপ্রহারের ঘটনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মিছিল।
সবকিছু যে হিসেবমত চলছে না, তা 'Not in My Name' আন্দোলনের সময়ও বোঝা গিয়েছিল, যদিও তার ব্যাখ্যা করা গিয়েছিল এই বলে যে এই আন্দোলন অল্পসংখ্যক 'সেকুলার', ইংলিশ-বলা টাইপের জনতার মধ্যেই সীমিত। সরকারের স্থির ধারণা ছিল, বিগত কয়েক বছর ধরে চালাতে থাকা উচ্চগ্রামের মুসলমান-বিরোধী এবং পাকিস্তান-বিরোধী প্রচারের ফলে এতটাই বিভাজিত হয়ে পড়েছে দেশের জনসংখ্যা, যে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রতিরোধ আসবে না।
এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার, যা কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবরকম প্রতিবাদকে দমিয়ে রাখলে, এবং নিজের অপরাজেয়তার গল্পকথায় নিজেই বিশ্বাস করতে শুরু করলে, নিজেরই সৃষ্ট 'ইকো চেম্বার' বা 'প্রতিধ্বনির প্রাসাদে' বাস করতে শুরু করবেন আপনি। যেখানে কোনও আন্দাজ পাওয়া যায় না, আপনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ঠিক কতটা তীব্র হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে এরকমটাই হয়েছে।
অনেক দিনের, অনেক রকমের পুঞ্জীভূত সংগ্রাম এবং অসন্তোষ থেকেই জন্ম নেয় গণআন্দোলন। আচমকাই সেই আন্দোলন জমাট বাঁধে একটি স্পষ্ট, সার্বজনীন বক্তব্যকে ঘিরে, এক্ষেত্রে যা ছিল সিএএ। কতকটা একই ধরনের প্রকাশ ঘটেছিল এপ্রিল ২০১১-র দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের সময়, যখন অনেকেই ভুলবশত ভেবেছিলেন যে আন্দোলন হচ্ছে শুধুমাত্র 'দুর্নীতি' নামক এক কুয়াশাচ্ছন্ন দুশমনের বিরুদ্ধে। বাস্তবে, 'দুর্নীতি' নামক সার্বজনীন ইস্যুকে ঘিরে দানা বেঁধেছিল তৎকালীন নানারকমের দ্বন্দ্ব তথা অসন্তোষ। এবার যে জায়গাটা নিয়েছে সিএএ এবং ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি।
কিন্তু সরকারকে যে ব্যাপারটা ধন্দে ফেলে দিয়েছে তা হলো, যে সিএএ-র উদ্দেশ্য ছিল খুব বুদ্ধি করে মুসলমানদের একঘরে করে দেওয়া, কীভাবে তা এমন সার্বজনীন ইস্যু হয়ে উঠল? যে মেরুকরণের ওপর এত ভরসা ছিল, তা আদৌ ঘটল না। জামিয়া বা আলিগড়ের পড়ুয়াদের ওপর পুলিশ-গুন্ডা বাহিনীর নির্মম যৌথ হামলার ফলে প্রত্যাশা মতো স্রেফ কিছু বিক্ষিপ্ত মুসলমান প্রতিবাদও হলো না। প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি মন্তব্য করে ফেললেন যে, কারা হিংসা ছড়াচ্ছে, তা তাদের পোশাক দেখেই বোঝা যায়। যার থেকে এটা স্পষ্ট যে তিনি কী আশা করছিলেন। কিন্তু অচিরেই সাধারণ মানুষও বুঝতে শুরু করলেন যে এই হিংসা রাষ্ট্র-সমর্থিত, এবং শুধুমাত্র বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই বিদ্যমান।
বর্তমান সময়ের সংজ্ঞা ঠিক কী, তা আমরা তখনই বুঝব যখন আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারব যে এটা এমন একটা সময়, যখন অনেক রকম অসন্তোষ একসঙ্গে দানা বাঁধছে। তিন বছর আগের নোট বাতিলের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত রাগ, যা কখনও প্রকাশ পায় নি, আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তখন বলা হয়েছিল, প্রায় ১৫০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এই পদক্ষেপের ফলে, সর্বস্বান্ত হয়েছেন কয়েক লক্ষ, কিন্তু কোনোরকম প্রশ্ন তুললেই জুটছিল রাষ্ট্র-বিরোধী তকমা। এটি কিন্তু 'মুসলিম ইস্যু' ছিল না।
আরও আছে। রাগ জমেছে ধর্ষণের প্রশ্নে এই সরকার এবং তার সহযোগীদের নীতিকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে দেশের অল্পবয়সী মহিলাদের মধ্যে, কিন্তু বৃহত্তর জনসমাজেও। উন্নাওয়ের প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার থেকে শুরু করে তথাকথিত আধ্যাত্মিক গুরু আসারাম বাপু এবং চিন্ময়ানন্দের মতো ধর্ষকদের লালন করা, অথবা ধর্ষিতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা, এই সরকারের আমলে যতটা ক্ষমতার অপব্যবহার দেখেছি আমরা, ততটা আর কখনও দেখি নি আমাদের ইতিহাসে।
আমাদের দেখা অন্যতম নারীবিরোধী সরকারের চরিত্র এখন এতটাই স্পষ্ট যে আন্দোলনের অগ্রভাগে বহুসংখ্যক মহিলার উপস্থিতিতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাও মনে রাখা জরুরি যে দলিতদেরও এক বড় অংশ মনে করছেন যে এই সরকারের শাসনে ক্রমশ বেড়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণের মাত্রা, এবং এখন 'আম্বেদকরের সংবিধান' ভেঙে পড়ার মুখে।
পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে লালিত পালিত হয় বিতর্ক, এবং সমালোচনা ভিত্তিক চিন্তাধারা, এই পরিসরগুলি প্রথম থেকেই বর্তমান সরকারের আক্রমণের লক্ষ্য থেকেছে। এই মনোভাব যে সাদরে গৃহীত হয় নি, তার প্রমাণ, আন্দোলনের সম্মুখভাগে এইসব প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি।
গান, কবিতা, অভিনব এবং মজাদার স্লোগানের যে বিস্ফোরণ আমরা এই আন্দোলন চলাকালীন দেখেছি, তাও নজর কেড়েছে বৈকি। এই প্রতিবাদ যে কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, তারই নিশ্চিত চিহ্ন এই সৃষ্টিশীলতা।
(লেখক দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিজ এর সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)