Advertisment

আজ কা গুন্ডারাজ, আর আমাদের ভাগ্যে কাঁচকলা?

প্রতিবাদের নামে জোর করে ট্রেন বন্ধ, ভাঙচুর, বাস জ্বালানো, দোকানপাট ধ্বংস করার সময় একদল মানুষের মধ্যে যে জান্তব উল্লাস লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে আর যাই হোক, কোনও ইতিবাচক দিক থাকে না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
cab caa protests

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

গত কয়েকদিন যাবৎ শুধুই বিক্ষোভ, আগুন, আক্রমণ, ধ্বংস, ক্ষয়ক্ষতির খবর সংবাদ মাধ্যম জুড়ে । সারা দেশেই চলমান এই পরিস্থিতি। কোথাও কোথাও তো প্রাণহানির মতো চরম ঘটনাও ঘটেছে। ভয়াবহ এক অশান্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা। কী নিয়ে অশান্তি, তার যৌক্তিকতা কতটা, এসব ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছে সামগ্রিক এক গুণ্ডামির প্রবণতা। জনতা যখন পথে নামে, উপলক্ষ্য যাই হোক, সেই আন্দোলন সাধারণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যেটা ঘটছে, তার সবটাই কি আন্দোলন অভিমুখী? নাকি এর পিছনে রয়েছে কোনও সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্য অথবা পরিস্থিতি বুঝে নিজের স্বার্থ গুছিয়ে নেওয়ার প্রবণতা!

Advertisment

সাধারণভাবে আজকাল আমরা প্রায় সবাই কমবেশি স্বার্থপর। তবে স্বার্থপর আর স্বার্থান্বেষী তো এক নয়! স্বার্থান্বেষী লোকজন অশান্তির ঘোলা জলে মাছ ধরার অপেক্ষায় ছিপ ফেলে বসে থাকে। পুরোনো শত্রুতার ঝাল মেটানো থেকে শুরু করে নতুন কিছু হাতিয়ে নেওয়া, অশান্ত সময়কে কিছু মানুষ নিজেদের পৌষমাসে পরিণত করে। তারা কিন্তু আমার-আপনার মতোই দেখতে ছাপোষা। কিন্তু সেটা তাদের আসল চেহারা নয়। গোলমেলে সময়ে তাদের আসল চেহারাটা বেরিয়ে আসে।

অরাজকতা চলাকালীন প্রতিবাদের নামে জোর করে ট্রেন বন্ধ, ভাঙচুর, বাস জ্বালানো, দোকানপাট ধ্বংস করার সময় একদল মানুষের মধ্যে যে জান্তব উল্লাস লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে আর যাই হোক, কোনও ইতিবাচক দিক থাকে না। উল্টোদিকে পুলিশ যখন কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্র নিপীড়ন যজ্ঞে মাতে, সেখানেও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা নয়, গুণ্ডামিই চোখে পড়ে।

সম্প্রতি এনআরসি/সিএএ-র প্রতিবাদে আন্দোলন চলাকালীন এই রাজ্যেরই এক অঞ্চলে একটি দোকান জ্বালানোর সময় তার মালিক দোকানের ভিতরেই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। এটা প্রতিবাদের কোন ভাষা? পরিষ্কার বোঝা যায়, অবস্থার সুযোগ নিয়ে লোকটিকে ধনেপ্রাণে মারাই ছিল মুষ্টিমেয় প্রতিবাদী জনতার(?)  উদ্দেশ্য। আসলে ওই ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্যোগ।

এই তালিকার এক লম্বা ইতিহাস আছে। বহু যুগের এই ইতিহাস বারবার কলঙ্কিত হয়েছে এক শ্রেণীর নিকৃষ্ট স্বার্থান্বেষীর জন্য। হিটলারের নাৎজিতন্ত্র থেকে রাশিয়ার বিপ্লব, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার পরবর্তী দেশভাগ, পাঞ্জাবের উগ্রপন্থা বা বাংলার নকশাল আন্দোলন। সব ক্ষেত্রেই আন্দোলনকে গুলিয়ে দেওয়া, ভুল পথে চালানোর প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র যেমন আছে, তেমনই এই প্রত্যেকটি সময়েই কিছু ধান্দাবাজ স্বার্থান্বেষী চতুরভাবে পরিস্থিতির অজুহাতে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করেছে। তারা বিক্ষুব্ধ মানুষের আবেগকে হাতিয়ার করে লুকোনো নখ-দাঁত বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লুটপাট, খুন, জখম, রাহাজানিতে।

আসল কথা হলো 'আমার' চাই। আমার সব চাই। গাড়ি-বাড়ি, প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে অমুকের জমি, তমুকের বাড়ির মেয়ে-বউ, ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন সব কিছু তছনছ, সব দিক অন্ধকার, মানুষ বিপর্যস্ত, সংশয়াচ্ছন্ন, তখন সেই সুযোগে নিজের যাবতীয় চাহিদা মিটিয়ে নাও। এদেশে, ওদেশে, সব দেশে, সব কালে এরা ছিল, আছে, থাকবে। এদের অনেক মুখ। এরা কখনও আত্মীয়, কখনও প্রতিবেশী, কখনও সহকর্মী, কখনও বা পথচলতি চেনা মুখ। এক লহমায় এই চেনা মুখের মানুষটি বিশৃঙ্খলার সুযোগে বিশ্বাস, ভরসা, আস্থার যাবতীয় নিশ্চিন্তে থাকার ব্যাকরণ ভুলিয়ে দিয়ে আপনার সামনে অচেনা এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সে বড় ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা।

আর যখন রাষ্ট্র এই চেনা-অচেনার আলোছায়াটা তৈরি করে, তখন? তখন যে বুকের ভিতর কেবলই শূন্যতা। প্রতি মুহূর্তে যেন সীতার অগ্নিপরীক্ষা। প্রতি দিন অস্তিত্বের সংকট। অতল সমুদ্রে ভেসে যেতে যেতে বিশ্বাস হারিয়ে খড়কুটো আঁকড়ে ধরা। দুর্ভাগ্য, এদেশের অসহায় মানুষের সঙ্গে এই খড়কুটোও প্রায়ই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। তারা পিংপং বলের মতো, এ মাঠ, সে মাঠ জুড়ে ছুটোছুটি করেও দিশা খুঁজে পায় না। তারপর কোনও একদিন তাদের মস্তিষ্ককে সম্পূর্ণ ধোয়ামোছা করে প্রভাবশালী লোকজন নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে শুরু করে। ধর্ম, জাতি, ভাষা, কত না ইস্যু। মানুষ বোঝার আগেই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নানা ভিত্তিতে শত্রুতা বাড়ে।

এদেশের মানুষ এই মুহূর্তে কী পরিমান বিচ্ছিন্ন, তা শুধু সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ করলেই বুঝতে পারা যায়। সেখানেও একদিকে চরম অসহিষ্ণুতা। লোকজন আইনকানুন, সংবিধান ইত্যাদি না বুঝেই কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে পোস্ট করছে, মতামত দিচ্ছে। অন্যদিকে মতলববাজরা এখানেও হাজির। তারা তাদের সমীকরণে মানুষকে তাতাচ্ছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, ভুল নীতির জনমত গঠন করছে। প্রয়োজনে ধমক দিচ্ছে। কারোর কথা অপছন্দ হলে সমবেতভাবে তাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে প্রায় একঘরে করে ফেলছে। মোদ্দা কথা, গুন্ডা-সংস্কৃতিতে ভার্চুয়াল দুনিয়াও কম যাচ্ছে না।

ইদানীং দুটো দিকেই গুন্ডারাজ খুব প্রকট। একটাকে প্রশাসনিক গুন্ডামি বলব। সরকারের কোনও একটি সিদ্ধান্ত বা আইন প্রণয়নের সঙ্গে দেশের সমস্ত নাগরিক সহমত পোষণ না করতেই পারেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে সে ব্যাপারে প্রতিবাদ করার পূর্ণ অধিকারও আছে তাঁর। কিন্তু এই প্রতিবাদ পছন্দ না হলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেটা করা হচ্ছে, সেটা গুণ্ডামিরই নামান্তর।

আবার প্রতিবাদীরাও প্রায়ই গুণ্ডামির পথে হাঁটছে। পুলিশকে ইটপাটকেল মেরে, প্রতিষ্ঠানের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে, কী প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তারা? কোথাও যেন সব কাজেরই খেই হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের আন্দোলন একটি সংগঠিত প্রতিবাদ। এর শক্তি স্বয়ং রাষ্ট্রও অস্বীকার করতে পারে না। বিশেষত, ছাত্রদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন সমাজের পক্ষে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। তারা আগামীদিনের প্রতিভূ। তারা চারপাশের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করার অর্থ হলো, সমাজের কথা বলার মুখটাই বন্ধ হয়ে যাওয়া। সেটা তো প্রবল নেতিবাচক এক অবস্থা। রাষ্ট্র যদি এই অবস্থার দিকে তাদের ঠেলে দেয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনোদিন সচেতন নাগরিক তৈরি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে চলমান সমাজের বা বৃহত্তর পটভূমিতে রাষ্ট্র চালনার ব্যাটন ধরবে কারা? কিছু পরগাছা, পেটোয়া, অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা?

পাশাপাশি আন্দোলনে নামছে যারা, তাদের তো একটা মতাদর্শ থাকে। এক বা একাধিক নির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকে। আন্দোলন প্রতিরোধ করার চেষ্টা হলে, কীভাবে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তারও নিশ্চয়ই একটা রূপরেখা থাকে। সেখানে গুন্ডামি করে, আগুন জ্বালিয়ে বা ভাঙচুর করে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি করার স্থান কোথায়? বাসের টায়ার জ্বালানো আর একটা গোটা বাস জ্বালানো কি এক হলো? ট্রেন বা বাস আচমকা বন্ধ হলে কী কী হতে পারে, আমরা অর্থাৎ আন্দোলনকারীরা কি জানি না? সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত হয়রানি , অসুস্থ মানুষের হাসপাতালে পৌঁছতে না পেরে রাস্তাতেই মৃত্যু, পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে না পেরে চরম ক্ষতি। এমন আরও কত না সমস্যা। এই মানুষগুলোর কি এসব প্রাপ্য?

রাজনৈতিক মাথা, থুড়ি, তথাকথিত আন্দোলনপন্থীরা বলতেই পারে, বড় কিছু পেতে গেলে কিছু ছোট ছোট স্বার্থত্যাগ করতেই হয়। প্রশ্ন হলো, এ যাবৎকাল এ পোড়া দেশের মানুষ 'বড়' কী পেল, বলতে পারবেন কেউ? স্বাধীনতাটুকুও তো ঠিক করে পেল না আপামর মানুষ। তারা তো আজও শুধু হারিয়ে আর হেরেই চলেছে।

Citizenship Amendment Act Citizens Bill
Advertisment