'ওয়ার্ডস' শীর্ষক তাঁর সংক্ষিপ্ত স্মৃতিকথায় সার্ত্র লিখেছিলেন, "একটি ঘটে যাওয়া ঘটনাকে অভিযানে পরিণত করতে গেলে সেটির সবিস্তার বর্ণনা প্রয়োজন এবং যথেষ্ট।" আমার মতে, 'প্রয়োজন এবং যথেষ্ট' অর্থে সার্ত্র বলতে চান, অ্যাডভেঞ্চার বা অভিযান সত্যিই তাই কিনা, তা নির্ধারিত হয় তার পরবর্তী সময়ে, যখন কোনও অপরিণত ঘটনার ওপর পশ্চাৎদৃষ্টির দৌলতে আরোপিত হয় একটি আখ্যানের সম্পূর্ণতা। সিদ্ধান্ত নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা যায় না, অ্যাডভেঞ্চারের কেন্দ্রে থাকলেও সবসময় তা টের পাওয়া যায় না।
সার্ত্র অ্যাডভেঞ্চার সম্পর্কে যা বলেছিলেন, আমার প্রায়শই মনে হয়েছে তা ইতিহাসের ক্ষেত্রেও সত্য: খুব কম মানুষই সচেতন ভাবে ইতিহাসের, বা ঐতিহাসিক কোনও মুহূর্তের, অংশ হতে পারেন। বর্তমান অধিকাংশ সময়েই বিক্ষিপ্ত, অনিশ্চিত, এলোমেলো এবং কিছুটা একঘেয়েও বটে: ইতিহাসের যে পালিশ করা, সযত্নে গোছানো রূপ আমরা দেখতে পাই বইয়ের পাতায়, সে বৈদগ্ধ্যপূর্ণ গ্রন্থই হোক বা উপন্যাস, বা সিনেমায়, সেই রূপ বর্তমানের নেই। ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সময় পার করে আসা যেসব মানুষকে আমি দেখেছি, তাঁদের বেশিরভাগই স্বীকার করেছেন যে তাঁদের অভিজ্ঞতার মুহূর্তে তাঁরা বোঝেন নি তার ঐতিহাসিকতা, অথবা গুরুত্ব।
ভারতে গত দেড়মাসের ঘটনা আমাকে মত পাল্টাতে বাধ্য করেছে। আমার স্মরণকালে এই প্রথমবার মনে হচ্ছে, আমি ইতিহাসের মাঝে সচেতনভাবে বেঁচে আছি। বর্তমানের বিক্ষিপ্ত, অনিশ্চিত চরিত্র মুছে যায়নি; কিন্তু তার অভিনবত্ব আমাদের অবাক করেছে। এই বর্তমানকে চিনতে শেখানো হয় নি আমাদের, এর কোনও প্রত্যাশা আমাদের ছিল না; কিন্তু ঘটে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি, এটাই ইতিহাস।
আরও পড়ুন: গণতন্ত্রের উৎসব পালন করি, কিন্তু নিজের দেশেই আমি বিদেশি
অবশ্যই আমি বলছি সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল থেকে আইন হওয়ার পর সেই গভীর বিষণ্ণতার কথা, যে বিষণ্ণতাই আজ দেশজোড়া প্রতিবাদের উৎস। প্রথম প্রতিবাদ হয় আসামে, নির্দিষ্ট কিছু কারণে; তারপর - ভারতীয়ত্বের অর্থ এবং তার সংজ্ঞা সংক্রান্ত তাৎপর্যময় প্রশ্নের পথ ধরে - ছড়িয়ে পড়ে জামিয়া মিলিয়া, আলিগড় মুসলিম, এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবং সেখান থেকে পথেঘাটে, রাস্তার মোড়ে, দ্বিতীয় বিজেপি সরকারের প্রথম সাত মাসের ভয়ানক 'স্বাভাবিকতাকে' চুরমার করে। সিএএ-পরবর্তী বিষাদের পরিবর্তে সৃষ্টি হয়েছে উদ্দীপনার গনগনে আগুন।
এতদিনে একটা কথা স্পষ্ট - কোনও একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, বা প্রতিবাদ, অন্য আরেকটির মতো নয়। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীতেও এমনটা আগে ঘটেনি। আমাদের চোখের সামনে রূপ নিচ্ছে যে ভাবনা, তা হলো, ভারতীয় হওয়ার অর্থ স্রেফ ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া নয়: মানুষ হওয়া। এই অগ্নিকাণ্ড এবং পুনর্মূল্যায়নের মূলে ধর্ম ছিল ঠিকই, কিন্তু এখানে বিষয় ঈশ্বর নয়।
'আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া', এই শব্দবন্ধটি খুব সহজে উচ্চারণ করি আমরা, কিন্তু 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার অর্থটা ঠিক কী? 'ইন্ডিয়ান' শব্দটা ঠিক কবে থেকে ব্যবহার করতে শুরু করে ইংরেজরা, এবং কখন ঔপনিবেশিকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শব্দটিকে পরিণত করা হয় 'নেটিভ'দের মূলমন্ত্রে, এক শক্তিশালী ধারণায়? 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু আমার মতে এর একটা দিক হলো মানবতার স্বত্বকে ঔপনিবেশিকের আওতার বাইরে নিয়ে আসা। উনিশ শতকের শেষের দিকে যখন কোনও ইংরেজ 'হিউম্যান', অর্থাৎ 'মানব' শব্দটি প্রয়োগ করছেন, তিনি অধিকাংশ সময়েই বোঝাচ্ছেন 'ইংরেজ', খুব বেশি হলে 'ইউরোপীয়'।
আরও পড়ুন: নাগরিক সরকার নির্বাচন করে, না সরকার নাগরিক?
ওই উনিশ শতকের শেষেই যখন নিজেদের দেশে ক্রমশ ক্ষমতাবিহীন হতে থাকা ভারতীয়রা নিজেদের সম্পর্কে 'ইন্ডিয়ান' শব্দটি ব্যবহার করছেন, তাঁরা নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন মানবতার ইতিহাসে, যা তাঁদের দিচ্ছে এমন কিছু কর্ম সম্পন্ন করার স্বাধীনতা, যা আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী হলেও চরিত্রগত বটে।
এই 'ইন্ডিয়ান' মুসলিম হন বা উচ্চ অথবা নিম্নবর্গের হিন্দু, বা খ্রিষ্টান বা পুরুষ বা মহিলা, তাঁরা একইভাবে পড়তে পারছেন 'গীতা', 'বাইবেল', বা ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শুনছেন কাওয়ালি বা ভজন, প্রায়শই সদ্য আবিষ্কৃত, ধর্মনিরপেক্ষ প্রেক্ষিতে। এছাড়াও 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার অর্থ ছিল রাজনৈতিক ভাবে ইংরেজ ঔপনিবেশিকের বিরোধিতা করলেও ইংরেজি কবিতা পড়া, পড়ে মুগ্ধ হওয়া। এভাবেই নতুন করে আত্মপ্রকাশ ঘটে 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার চেতনা এবং অভিজ্ঞতার, এবং এই ভাব ছিল অভিনব: ভারতীয়ত্ব স্রেফ কোনও রাজনৈতিক পরিচিতি নয়। প্রাচীন সভ্যতার গৌরব ছাড়াও মানবতার প্রতি এই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী ভারতীয়দের মধ্যে আনে সাম্যবোধ, তাঁদের রাজনৈতিক প্রভুদের নিরিখে সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা থেকে অব্যাহতি।
বিগত অর্ধ-শতাব্দী ধরে শুধু যে উদারনীতিকেই, অথবা ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতাকেই, প্রতারণাপূর্ণ আখ্যা দেওয়া হয়েছে এমন নয়, যে মানবতাবাদের দর্শন এই দুই ধারার উৎস, তাকেই শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে। এর কারণ তর্কাতীত: এর মূলে রয়েছে ক্ষমতাশালীদের দ্বারা ইউরোপীয়, বা পুরুষ, বা অভিজাতদের ক্ষেত্রে 'মানব' শব্দের প্রয়োগ - তাঁরা ইউরোপীয় হন, বা পুরুষ, বা অভিজাত, বা একাধারে এই সবকিছু - বাকি দুনিয়াকে এই শব্দের আওতার বাইরে রেখে।
আরও পড়ুন: সরকার বা দেশ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়
এই ভিত্তিতে মানবতাকে অবৈধ ঘোষণা করে বাম এবং দক্ষিণ উভয়েই, কারণ এই দর্শন অন্তর্ভুক্তির পথে চলে না, বরং বর্জন করে। এই একটি দর্শন ভেঙে সৃষ্টি হয় অসংখ্য রাজনৈতিক পরিচিতি, যাদের মূলে ছিল শ্রেণী, জাতি, লিঙ্গ, এবং পোস্টকলোনিয়াল (পোশাকি ভাষায় উত্তর-উপনিবেশবাদী) ভিন্নতা, অর্থাৎ সেইসব আঙ্গিক, যা একদা ঢাকা পড়েছিল 'মানব' শব্দের আড়ালে। নিতান্তই অতীতের স্মৃতি-আক্রান্ত না হলে কেউ মানবতাবাদের আবাহন করতেন না। তার দিন ফুরিয়েছিল।
অন্তত গতমাস পর্যন্ত তাই মনে হতো। মধ্য-ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া প্রতিবাদ - যাতে অংশ নিয়েছেন সব ধর্মের, সব শ্রেণীর, মহিলা, পুরুষ, এবং শিশু, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ এবং কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয় - পৃথিবীতে প্রথমবার পুনরুজ্জীবন ঘটাচ্ছে এমন এক মতবাদের, যাকে আমরা ভাবছিলাম মহাকালের বর্জিত দলিল মাত্র: মানবতাবাদের উত্তরাধিকার। এই পুনরুজ্জীবনের ফলে নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সংবিধান, যা একটি মানবতাবাদী দলিল, জাতীয়তাবাদী নয়। বিজেপি আমাদের উদ্দেশ্যে ফরমান জারি করেছে যে, 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার অর্থ হিন্দু হওয়া, এবং এই ফরমান ছিন্নভিন্ন করেছে দুই জাতিকেই। প্রতিবাদীরা উত্তর দিয়েছেন: 'ইন্ডিয়ান' হওয়ার অর্থ 'মানব' হওয়া।
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য প্রতিবাদের সিংহভাগ যুক্তিসঙ্গত ভাবেই প্রোথিত হয়ে এসেছে বিভিন্ন ধরনের বিপন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার আশু প্রয়োজনে। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, মানবতার পক্ষ নিয়ে লড়াইয়ের অর্থ, কারণ চিন্তাধারা বা মতাদর্শ হিসেবে মানবতাবাদ হয়ে গিয়েছিল ধোঁয়াটে। বস্তুত, মতাদর্শের জন্য লড়াই ব্যাপারটাই আমরা ফেলে এসেছিলাম এক অন্য যুগে, অন্য নীতিবোধের কাছে। নিজের স্বার্থের চেয়েও যে গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি হতে পারে কোনও আদর্শ, তা আজ কে মনে রেখেছে?
পৃথিবীও এ সম্পর্কে কিছুদিন আগে পর্যন্তও নিশ্চিত ছিল না। অথচ যে হিন্দু অথবা মুসলিম ধর্মাবলম্বী পথে নেমে বিরোধিতা করছেন সিএএ-র, তাঁকে পরিচালনা করছে সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং এমন এক আদর্শের জন্য লড়াই, যে আদর্শের জন্ম আমাদের সংবিধানে নথিবদ্ধ হওয়ার বহু দশক আগে। শাহিন বাগ এবং অন্যান্য স্থানে প্রেক্ষিত নির্ধারণ করছে মানবতাবাদ, জাতীয়তাবাদ নয়। সেই প্রকাশ্যে এনে দিচ্ছে জাতীয় পতাকা, আম্বেদকর-গান্ধীর ছবি, সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ, অথচ গান্ধী বা আম্বেদকর, বা কোনও ইউরোপীয় মানবতাবাদীও, স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে মানবতাবাদ এমন মৌলিক একটি হাতিয়ার হতে পারে, যা খণ্ডিত করতে পারে ধর্ম, শ্রেণী, জাতি, লিঙ্গের সব বিভেদ।
আরও পড়ুন: ভারতীয় গণতন্ত্রের সেকাল, একাল, পরকাল?
শাহিন বাগ অথবা পার্ক সার্কাসকে আবিষ্কার না করলে কীভাবে বোঝা যাবে মানবতাবাদ ও ধার্মিক পরিচিতির মধ্যেকার গভীর একাত্মতা, অথবা ধর্মীয় পরিচিতির সঙ্গে যৌক্তিকতার আত্মীয়তা? ভারতের পথে পথে সাক্ষাৎকার, মন্তব্য, পোস্টার থেকে যদি কিছুমাত্র স্পষ্ট হয়ে থাকে, তা হলো এই উপলব্ধি যে 'সাধারণ মানুষকে' শুধু তাঁর সাধারণত্বের জন্য সম্মান করা উচিত নয়, উচিত নয় কোনও বোরখা-পরিহিতাকে তাঁর ভিন্নতা অথবা জাতিগত পরিচয়ের নিরিখে দেখা। বরং বোঝা উচিত, আমাদের রাজনীতিকদের চেয়ে কতটা বেশি স্বচ্ছতা, গভীর সাধারণ জ্ঞান, এবং যৌক্তিকতা রয়েছে এঁদের কথায়।
মনে রাখবেন, পশ্চিমী বিজ্ঞানের হাতে রয়েছে যুক্তিবাদের একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশ; সিংহভাগের মূলেই আছে সেইসব আধ্যাত্মিক আন্দোলন, যেগুলি ধ্বংস করেছে ভুয়ো ধার্মিকতাকে, যেগুলির মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধধর্ম সমেত আরও অজস্র আন্দোলন। এদের সকলের সাংস্কৃতিক শক্তি মিলে সৃষ্টি করেছে এই নতুন মানবতাবাদ, যার জন্ম হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, আমাদের পথেঘাটে।
একেবারে নতুনভাবে উপলব্ধি করেছি যে 'অ্যাডভেঞ্চারের' মতো সবিস্তারে আখ্যান বলার অর্থ ইতিহাস নয়, বরং আমরা যেখানে রয়েছি এখন, তাই ইতিহাস। আমি নিজে তার পরিচয় পেয়েছি রাস্তায়, পার্কে।
(অমিত চৌধুরী প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, ও গায়ক। মতামত ব্যক্তিগত)