ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা কখনোই স্থায়ী সত্য নয়। যে শক্তি উত্থিত হয়, সে শক্তির একদিন পতনও হয়। ফরাসী সম্রাট চতুর্দশ লুই ঘোষনা করেছিলেন, আমিই রাষ্ট্র। তিনিও ইতিহাসের কৃষ্ণগহ্বরে নিরুদিষ্ট। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস থেকে এসেছে সিপিএম। সে ছিল অভূতপূর্ব রূপান্তর। তারপর দীর্ঘ সিপিএম শাসনের মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে প্রবেশ করেছেন। কিছু যা উত্থিত হয়, তার অবরোহণও হয়। প্রকৃতি অবশ্য শূন্যস্থান পছন্দ করে না (nature abhors a vacuum)। অতএব মমতার দশ বছরের শাসনের পর কি সেই শূন্য পরিসর দখল করতে চলেছে বিজেপি?
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কোন রাজনৈতিক অস্তিত্বই ছিল না। বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বর পরিভাষায় একদা হিন্দি বলয়কে বলা হত ‘base area’ এবং পূর্ব দক্ষিণ এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় ভারতকে বলা হতো non base area। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপির আগ্রহের একটি বিশেষ পটভূমি ছিল। বঙ্গবাসী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই ১৯৫৮ সালে জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্বিতীয়, ভারতবাসীর ৪৭ সালের দেশ ভাগের ভ্যাকুয়াম, কিন্তু বাঙালি একটা নয়, দুটো দেশভাগের শিকার। ১৯০৫ সালের দেশভাগও বাংলার অর্থনীতিকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তৃতীয়ত, বাংলা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল, ইংরেজি শিক্ষা এবং উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নগরীও হল এই বাংলা। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রত্যাহার হয় বটে, কিন্তু বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সশস্ত্র হিংসাত্মক প্রকৃতি দেখে বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন শাসকদল দ্রুত কলকাতা থেকে শাহি দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তর করে। তাই পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপালের বাসভবন কিন্তু লাটসাহেব মানে ভাইসরয়ের বাড়ি।
বিধানসভা ছিল প্রাক ৪৭-এর সংসদ । তাই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ইতিহাস শাতধিক বছরের পুরনো। আর একটি কারণেও বাজপেয়ী-আডবানীর সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির খুব পছন্দের এক রাজনৈতিক ল্যাবরেটরি। সেটি হল পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ বাম শাসন। আর এস এস এবং কমিউনিস্ট পার্টি দুটি সংগঠনেরই জন্ম সাল ১৯২৫। ভারতের রাজনীতিতে সংঘ এবং কমিউনিস্ট, এই দুই শক্তি ছিল পরস্পর স্ববিরোধী। মতাদর্শগত ভাবে বিজেপি চিরকালই কংগ্রেসের চেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট-বিরোধী ছিল। বহুদিন ধরেই বিজেপি তাই দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু বাংলায় বিজেপি দীর্ঘ সময় একজন বিধায়ক পর্যন্ত পায়নি। সংসদ সদস্য তো দূরের কথা।
আর তাই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-বিরোধী শক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সামপাত করেই বিজেপি এগিয়েছে। মমতা এনডিএর শরিক হয়েছেন। কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়েছেন বাজপেয়ী সরকারে। অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আডবানী শুরু করেছিলেন প্রচেষ্টা, সফল হতে পারেন নি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ সফল হয়েছেন। ৪২ টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপি ১৮ টি দখল করেছে। শতকরা ভোটও বেড়েছে দারুনভাবে। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতই এখন বিজেপি আক্রমণাত্মক। অর্জুন যেমন শুধু পাখির চোখ দেখেছিলেন, ঠিক সেভাবেই মোদী এবং শাহ এখন দেখছেন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন।
কোন সন্দেহ নেই, মমতা আট বছর আগে যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তাঁর সরকারের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তা আজ নেই। এই জনপ্রিয়তা হারানোর কারণ কিন্তু নিছক ধর্মীয় মেরুকরণ নয়। শুধুমাত্র বিজেপির হিন্দুত্ব প্রচারের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে তা তো নয়। বরং সম্প্রতি বেশ কয়েকবার, ভোটের সময় এবং তারপরও, বেশ কয়েকটি জেলা সফর করে দেখেছি, রাজনৈতিক ভাবেও বাংলার মানুষ ভীষণভাবে শাসক দল বিরোধী হয়ে উঠেছেন। এর প্রধান কারণ আমার মনে হয় পশ্চিমবাংলার করুন আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি। সমগ্র বিশ্ব এবং গোটা দেশেই আর্থিক সঙ্কট, কিন্তু পশ্চিমবাংলার আর্থিক পরিস্থিতি উত্তর পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের চেয়েও খারাপ। রাজ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরাশার বেকারি, কর্মহীনতা, দারিদ্র্য। ভারি বড় শিল্পও যেমন আসছে না, ঠিক সেভাবে নবীন প্রজন্মের নতুন উদ্যোগও দেখছি কোথায়?
এজন্য এক তরফা মমতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আমি রাজি নই। ভবিষ্যতের পথ সন্ধানে অতীতের প্রাসঙ্গিকতা সব সময়েই গুরুত্বপূর্ণ। জর্জ হান্টারের লেখা Annals of Rural Bengal নামের অতিপরিচিত গ্রন্থটি থেকেই জানা যায়, ১৭৬৯ সনের শীতকালে কেমন বাংলার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। যার জের দুই পুরুষ ধরে চলেছিল। সে সময়ে দুর্ভিক্ষ কমিশন পর্যন্ত গঠিত হয়। ১৭৬৮ সনে ফলনের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। যার জন্য ১৭৬৯ সালে মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়ে যায়। বর্ণনা ছিল, ধানের খেত হয়ে যায় শুকনো খড়ের মাঠ। ঠগ ও ডাকাতের জন্মও এই কারণে। এই বাংলা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখেছে। ষাটের দশকেও খাদ্য সংকট হয়, এই বাংলায়। ক্ষুধার্ত বাংলার চিত্রটি যেন বদলানোর নয়। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস তান্ডবের সাক্ষী বঙ্গ সমাজ।
এরপর সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসন। জেলায় জেলায় রাজনৈতিক হিংসা বাংলার তথাকথিত রাবীন্দ্রিক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। মমতা মানবতাবাদী মুখ নিয়ে এলেও তাঁর সরকার সম্পর্কেও সাধারণ মানুষের ধারণা, এটি হলো 'extension of bad CPM-ism'. মমতার রাজনৈতিক আন্দোলন দেখে মনে হয়েছিল, হয়ত ক্ষুধার্ত বাংলা এবার উন্নয়নের নতুন রাস্তা খুঁজে পাবে। কিন্তু তা হলো কই? বরং এখন দশ বছর অতিবাহিত করার মুখে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে সিপিএমের পরিত্যক্ত পথ দিয়েই কি হাঁটতে চাইছে তৃণমূল? সেদিনের হার্মাদবাহিনী থেকে আজকের সিন্ডিকেট বাহিনী, সর্বত্রই তো পেশী শক্তির দলীয় আধিপত্যকামিতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এবার সেই বিকল্প পরিসরটি দখল করতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু জাতীয় স্তরে বিজেপির সর্বভারতীয় মূর্তি নরেন্দ্র মোদী হলেও পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যস্তরে মমতার বিকল্প ব্যক্তিত্ব কে? বিজেপির না আছে সংগঠন, না আছে ধারাবাহিক আন্দোলন অথবা একটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যার মুখ সামনে রেখে বিজেপি মমতারই মোকাবিলা করতে পারবে। বিজেপি অবশ্য মনে করছে, মমতার অত্যধিক মুসলিম তোষনের ফলে গোটা রাজ্যে বাঙ্গালি-হিন্দু মমতা সরকার বিরোধী হয়ে উঠেছেন। শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ মুসলমান আছেন পশ্চিমবঙ্গে। বিজেপির লক্ষ্য মমতাকে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার একক রক্ষাকবচ বলে প্রচার চালিয়ে বাকি প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটকে ধর্মাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে বিজেপির পক্ষে জাগ্রত করা।
অস্বীকার করা যায় না, বাঙালির সাংস্কৃতিক ধর্মীয় identity, এবং বাঙালির সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে এসেছে অনেক পরিবর্তন। বাঙালি এখন ধনতেরাস থেকে হনুমান জয়ন্তী, সবেতেই আছে। এমনকি বাঙালির বিয়েতে এখন পাঞ্জাবি কায়দায় ‘সঙ্গীত’ হয়। সঙ্গীত এমন একটি নাচগানের অনুষ্ঠান যা বঙ্গসংস্কৃতির সঙ্গে অতীতে কোনও দিনই মেশেনি। অনেক সমাজতাত্ত্বিক বলেন, ১৯৯১ সালের আর্থিক উদারবাদের পর থেকেই ভারতের রাজ্যে রাজ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক osmosis বা cultural fusion হয়েছে, এর ফলে বাঙালি আর আগের মত একটা structured identity নিয়ে চলছে না। তবে অতীতে তামিলরা যখন anti-Hindi movement করে, তখনও বাঙালি ষাটের দশকেও সেভাবে হিন্দি-বিরোধী আন্দোলন করেনি। ম্যাকলের শিক্ষানীতি থেকে বলিউড প্রেম, সব মিলিয়ে বাঙালি কিন্তু একটু বেশিই cosmopolitan.
বাংলায় তাই 'আমরা বাঙালি' নামের দল সফল হতে পারে নি। CPM বা TMC'র মত আঞ্চলিক দলই বাংলার আঞ্চলিকতাবাদের রক্ষাকর্তা হয়েছে। বিজেপি বাঙালির এই melting pot সাংস্কৃতিক আইডেনটিটির সুযোগ নিয়ে অখণ্ড ভারতের হিন্দুত্বকে এক নয়া রাষ্ট্রবাদের প্যাকেজে বাঙালিকে শেখাতে চাইছে। শুধু বাংলার pride দিয়ে বাংলার মন জয় করা নয়, উল্টে এক রাষ্ট্রীয় গর্ববোধকে জাগানোর চেষ্টা। এটাই বলা, নিছক বাঙালি হয়ে না থেকে এবার ভারতীয় মূলস্রোতে এসো হে বাঙালি। তা না হলে বিচ্ছিন্ন হবে বাংলাই। যদি উন্নতি চাও, চাও সোনার বাংলা, তবে এসো মোদীর মহারথে।
সর্বশেষ প্রশ্ন হল, শেষ পর্যন্ত বিজেপি সফল হবে কি? নাকি মমতা শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াবেন? মমতার জনপ্রিয়তা শূন্যে এসে পৌঁছয়নি। ভোটে তাঁর দলের শতকরা ভোট কিন্তু কমেনি, বরং বিগত লোকসভা ভোটের তুলনায় বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, লোকসভার ভোট ছিল মোদীকে রাখা বা না রাখার প্রশ্নে, কিন্তু বিধানসভা ভোটে মূল প্রশ্ন হবে, মমতাকে আপনারা কি আর একবার সুযোগ দিতে চান, না চান না? অনুপ্রবেশ, হিন্দি-মুসলিম, নাগরিকত্ব বিল, তৃণমূলের দুর্নীতি, মুকুল রায়ের নেতৃত্বে মমতার দল ভাঙার ইঞ্জিনিয়ারিং, এসব চলছে চলবে, কিন্তু ২০১৯ সালে রাজ্যে বিজেপির পক্ষে যে জয় শ্রীরাম হাওয়া দেখা দিয়েছে, যেভাবে মমতা-বিরোধী জনমত তীব্র হয়েছে, তা দুবছর পর বিধানসভা নির্বাচনের সময় থাকবে কি?
যেমন চলছে তেমন চলুক। বিজেপির যে দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, তা তো অনস্বীকার্য। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস এবং সিপিএম, দুটি রাজনৈতিক দলই এক গভীর সঙ্কটে। এই দুটি শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলেই বিজেপি আরও বেশি করে এই প্রতিপক্ষর পরিসরটি দখল করে নিচ্ছে। বিজেপি আক্রমণাত্মক, আবার মমতাও বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। এক কথায় বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ এখন কুরুক্ষেত্র। যুদ্ধের শেষ নয়, শুরু। বিজেপি বাড়ছে, তবে বিজেপি কী ঝড় না বাতাস? এই শ্রীবৃদ্ধি স্থায়ী না অস্থায়ী ?