দু’হাজার বছরেরও আগে ভুয়োদর্শী তামিল কবি তিরুভল্লুভর তাঁর এক কুরল-এ লিখেছিলেন, “নীরিন্রু অমৈয়াদু উলকনিন য়ারইয়ারক্কুম ভানিন্রু অমৈয়াদু ওড়ুক্কু।” অর্থাৎ, জল ব্যতীত কোনো ব্যক্তিই যেমন দৈনন্দিন কার্যনির্বাহ করতে পারেন না, তেমনই বৃষ্টি ব্যতীত জলধারা বইতেও পারে না।” তামিলনাড়ুর জন্য এ লেখা আজও কতো প্রাসঙ্গিক, এবং নিষ্ঠুরভাবে সত্য!
২০১৫ সালে চেন্নাইতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। অপুরণীয় ক্ষয়ক্ষতির মধ্যেও অনেকে ভেবেছিল, যাই হোক আগামী কয়েক বছর এই বৃষ্টিনির্ভর রাজ্যে জলসংকট থাকবে না। কিন্তু কে জানতো, তারপর থেকেই বরুণদেব মুখ ঘুরিয়ে নেবেন! গত তিন বছর বৃষ্টি হলো খুবই কম। বছরে গড়ে ১৩০০ মিমি থেকে ১৪০০ মিমি বৃষ্টিপাত হওয়া রাজ্য পেল মাত্র তার ৬১ শতাংশ। ফলে মাটির তলার জল চলে গেল আরো নীচে। বড় বড় অফিস এবং ফ্ল্যাটের শক্তিশালী মোটর টেনে নিতে লাগলো যেটুকু জল পাওয়া যাচ্ছিল, আর সাধারন মানুষের শুরু হলো আকাল। ২০১৭ সালেই সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড জানিয়েছিল, যে চেন্নাই ভুগর্ভস্থ জলের ১.৮৫ গুণ বেশী টেনে তুলছে! কিন্তু তাতেও থামেনি জল তোলা। ফলে এই ২০১৯-এর গ্রীষ্মে মাটির তলার জল চলে গেছে নয় মিটার নীচে, এবং চেন্নাই শহরে, মায় গোটা রাজ্যে জল নেই, একেবারেই। শোলাভরম এবং পুণ্ডি সহ চারটে বড় রিজার্ভারের জল একেবারে তলানিতে ঠেকেছে, যা কিনা গত ২৫ বছরে একবারও হয়নি। চেম্বারমবক্কম হ্রদের কাছে সিক্কারায়াপুরমের রিসার্ভার মার্চ মাসেই সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। বিশ্বকাপের মরশুমে পোরুর লেকের ‘মাঠ’-এ দিব্যি প্রতিদিন ক্রিকেট খেলছে ছেলেরা।
কডলুরের ভীরানাম হ্রদ, যেখান থেকে কাবেরীর জল তামিলনাড়ুতে ঢোকে, বর্তমানে খটখটে শুকনো। মেত্তুর বাঁধ বন্ধ পড়ে আছে, কর্ণাটক দিতে পারছে না কাবেরীর জলের ভাগ, কারণ তার নিজের রাজ্যের অবস্থাও করুণ। বর্তমানে কৃষ্ণা, কাবেরী এবং গোদাবরী, দক্ষিণ ভারতের জলপ্রদানকারী এই তিন প্রধান নদীই শুকিয়ে গেছে।
শহরে প্রতিদিন গড়ে ৮৩০ মিলিয়ন লিটার জল প্রয়োজন হয়। সরকারের দাবি, বর্তমানে ৫৩০ মিলিয়ন লিটার জল সরবরাহ করা হচ্ছে প্রতিদিন। বাকি জলেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, ১৮ বছর আগে যেমন রেলপথে তেলবহনকারী বগিতে ভরে জল আনা হতো, তেমনটি শুরু হবে শীঘ্রই। প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন লিটার অতিরিক্ত জল পাবে শহর। এই মর্মে জোলারপেটার কাছে কাজও চলছে পুরোদমে। অবশ্যই তাতে চেন্নাইয়ের সমস্যা কিছুটা কমবে, কিন্তু তামিলনাড়ুর বাকি এলাকায় কী হবে! সরকারি জলের গাড়ি এলাকা অনুযায়ী প্রতিদিন জল সাপ্লাই দিলেও, সারিসারি ঘড়া এবং বালতির লাইনে তা ফুরিয়ে যাচ্ছে শীঘ্রই! তাও তাদের আসবার নিশ্চয়তা নেই। কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যেয়। কাজকর্ম ছেড়ে জল ধরতে ছুটছে মানুষ, কারণ ঐ দু’ঘড়া জলই বরাদ্দ হয়ে পড়ছে পরিবার প্রতি। তাতেই রান্নাবান্না সমেত সারাদিনের যাবতীয় জলের প্রয়োজন মেটানো। রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাচ্ছে বন্ধ জলের কলের তলায় সারি দিয়ে বসানো ঘড়া বালতি, কখন জল আসবে তার অপেক্ষায় রয়েছেন সকলেই। চেন্নাইয়ের ‘ধোবিঘাট’ ওয়াশারম্যানপেট প্রায় কর্মহীন। ছোট এবং মাঝারি অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, স্কুলে দেওয়া হচ্ছে হাফ ছুটি নয়তো সকলকে বাধ্য করা হচ্ছে বাড়ি থেকে দুই বা তিন বোতল পানীয় জল নিয়ে আসতে, এমনকি বেশ কিছু অফিসে জোর করেই বাধ্য করা হচ্ছে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করতে। অফিসে এবং হোটেলের শৌচালয়ে জলের ব্যবহার সীমিত করবার জন্য নেওয়া হচ্ছে প্রযুক্তিগত সাহায্য। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বিল্ডিং কন্সট্রাক্টররা। কারণ একটাই, জল নেই! বৃষ্টির আশায় অনেকে পূজা পাঠ শুরু করেছেন, মন্ত্র প্রচার করছেন যা সমবেতভাবে উচ্চারণ করলে নাকি বৃষ্টি নামে। অনেক প্রাচীন রীতিনীতি, লোকাচারেরও হিড়িক পড়ে গেছে চতুর্দিকে, বুদ্ধিতে বা যুক্তিতে যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। ভবিতব্যর কাছে মাথা নোয়াবার এই অসহায়তাও বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই জলসংকটের শিকড় কতো গভীরে!
যদিও ফিরতি মৌসুমিবায়ুর কল্যাণে বছরে একবার আসা বৃষ্টিই চেন্নাইসহ তামিলনাড়ুর একমাত্র জলের উৎস, তবে সেইসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে সেই জলের সুষ্ঠু সংরক্ষণ এবং সমান বণ্টনের দায় মানুষেরই। আমরা সেটা ঠিকমতো করছি কি? নাকি শুধু বৃষ্টির দোহাই দিয়ে নিজেদের গাফিলতি ঢাকছি? বর্তমানের এই সংকটজনক পরিস্থিতি কিন্তু রাতারাতি আসেনি, কয়েক বছর ধরেই কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্য পরিষ্কার করা হয়নি শহরের প্রাণকেন্দ্র জলের রিসার্ভারগুলি। যথেচ্ছ জল টেনে নেওয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো কড়া ব্যবস্থা। এমনকি সাধারন মানুষদের সতর্ক করাও হয়নি জলের সম্ভাব্য অকুলান পরিস্থিতি সম্পর্কে। কিছুদিন আগেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন তামিলনাড়ুর এই জলের সমস্যা মোটেই ততটা গভীর নয় যতোটা সংবাদমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা রাজ্যবাসীরা বাস্তব চিত্রটি জানি, কারণ আমরা ভুক্তভোগী।
আশার কথা, অন্তত এখন মানুষের মনে সচেতনতা বাড়ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, তাই নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক অথবা বর্ণবৈষম্য ভুলে, হাত হাত ধরে এই জলসংকটের সমাধান খুঁজতে প্রস্তুত হচ্ছেন রাজ্যবাসীরা। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহুজন বানাচ্ছেন বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য কুয়ো। জয়ললিতার আমলে চেন্নাইতে প্রতি বাড়িতে এটি বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু গত কয়েক বছর সরকারি চাপ না থাকায় অনেকেই গা করতেন না। মাথা খাটিয়ে অনেকে বার করছেন জল পুণর্ব্যবহারের অভিনব পদ্ধতি। বাড়ির এসি এবং রিভার্স অসমোসিস ফিলটারের থেকে বেরোনো জল পুণর্বার ঘর পরিষ্কারের অথবা শৌচের কাজে লাগাবার নানাবিধ ব্যবস্থা করছেন অনেকেই। তাছাড়া, ভবিষ্যতের জন্য লাগানো হচ্ছে অনেক গাছ, যাতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। সরকারের তরফ থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জলসরবরাহের লরির সংখ্যা। শহরের বুক চিরে প্রতিঘন্টাতেই কোনো না কোনো এলাকায় ছুটে চলেছে জলের গাড়ি, সেই এলাকাবাসীদের মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করতে। যদিও, এই ব্যবস্থা তৎকালীন। সুদুরপ্রসারী তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
গ্রীষ্মের ছুটিতে অনেকেই বাধ্য হয়ে চলে গেছিলেন নিজেদের গ্রামে। দক্ষিণ তামিলনাডুতে তবু মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে, নদীনালা আছে, তাই তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কতদিনই বা আর নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে জলের অভাবে পালিয়ে বেড়ানো যায়! যাঁরা টাকা দিয়ে কিনতে পারছেন, আকাশছোঁয়া দামে জল কিনে সারাদিনে ঘন্টা খানেকের মতো জল পাচ্ছেন। আর বেশীরভাগ মানুষ যাঁরা কিনতে পারছেন না? আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন যদি বৃষ্টি নামে। দু’দিন অল্প বৃষ্টি হলো কিন্তু মাটিতে পড়েই সব জল মুহূর্তের মধ্যে শুষে গেল। হিসাবমতো বর্ষাকাল আসতে এখনো তিনমাস বাকি। অক্টোবরের আগে তো তেমন বৃষ্টির সম্ভাবনাই নেই!
ততদিন তামিলনাড়ুর ছোট বড় ধনী দরিদ্র পুরুষ মহিলা সকলের বরুণদেবের কাছে একটিই প্রার্থনা, জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো!