বেশ কিছু বছর আগে, ইরাক যুদ্ধের সময়ে, শিয়ালদা ফ্লাইওভার থেকে বাসে বসে দেখতে পাওয়া যেত বি আর সিং হাসপাতালের গায়ের একটা দেওয়াল লিখন। ‘শিশুঘাতী-নারীঘাতী মার্কিন সেনা’ ইরাক থেকে যাতে হাত ওঠায় তার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া ছিল সে লিখনে। তার পর বেশ কিছু সময় অতিক্রান্ত। সাদ্দাম হুসেনের পরিণতি সকলেরই জানা। সে দেওয়ালই বদলে গেছে। লিখনটিও, স্বভাবতই।
নারী ও শিশুকে এক করে দেখার, এক প্রকার করে দেখার, অর্থাৎ কম পুরুষ তথা কম মানুষ করে দেখার প্রবণতাটি বাঙালি বা ভারতীয় নয়। সার্বজনীন।
ঠিক ততটাই সার্বজনীন হল এর এক বিপ্রতীপ বাস্তব - শিশু সৈনিকের হকিকৎ। শিশু সৈনিক শুনলে যে শিউরে ওঠার ধরন সাধারণে অভ্যস্ত, তা নেহাৎই পাতি মধ্যবিত্তসুলভ এবং ইতিহাসবঞ্চনার ফসল। বাস্তবতা এই যে, এ দেশের, এ উপমহাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন কালখণ্ডে শিশুদের যুদ্ধে শামিল হওয়া, এমনকি সশস্ত্র যুদ্ধেও, এক গরিমার ঘটনা হিসেবে শুধু নয়, এড়ানো-সক্ষম-নয় এমন পরিস্থিতি থেকেই উঠে এসেছে। বারংবার।
আশাকে আপনারা সকলে চেনেন না। আশা নেপালের মেয়ে। ১৩ বছর বয়সে মাওবাদীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাড়ি ছেড়েছিল। ১৪ বছর বয়সে সে পাকেচক্রে বাড়ি ফিরে আসে, পরিবারে শামিল হয়ে পড়ে ফের। তার নিজের জবানিতেই জানা যায়, মাওবাদীদের সঙ্গে থাকাকালীন সে শৈশবের পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ভিন্ন তো বটেই, উন্নততর জীবন অতিবাহন করেছে। সেখানেই সে জীবনে প্রথমবার নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা শুনেছে। এবং ১৪ বছর বয়সে বাড়ি ফেরার পর, প্রায় তাকে কোনও কিছু না জানিয়েই তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় যে ২২ বছরের পুরুষের সঙ্গে, বিবাহ পরবর্তী তাৎক্ষণিকতাতেই সেই পুরুষ তাকে অত্যাচার করতে থাকে। আশার ১৩ বছর বয়সে বাড়ি না ছাড়ার কোনও কারণ ছিল না, কারণ তারা ছিল হতদরিদ্র, যে দারিদ্রের কথা কল্পনাতীত। অত দারিদ্র এবং অত ক্ষুধা নিয়ে যুদ্ধে যোগদান বা যুদ্ধের পক্ষ নিয়ে নীতি বিচারের অবস্থা থাকে না সম্ভবত। সম্ভবত অপুষ্টি মস্তিষ্ককে ততটা বিশ্লেষণী হতে দেয় না। ফলে তেমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দেওয়া শিশু, নীতিমালার বহিরঙ্গে অবস্থান করে। Returned: Child Soldiers of Nepal's Maoist Army নামক তথ্যচিত্রে আশার কথা নিজের মুখেই শুনতে পাওয়া যায়। দেখতে নয়, কারণ তার মুখ আঁধারে ঢাকা থাকে। পরিস্থিতিজনিত কারণে।
কিংবা আপনাদের জাফনার নাম মনে পড়ে? শ্রীলঙ্কার জাফনার নাম? এল টি টি ই? প্রভাকরণ? তামিল ইলম? এসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল যারা, তারা শিশু সৈনিক। প্রভাকরণের বিরুদ্ধে পশ্চিমি দুনিয়ার অন্যতম সমালোচনার জায়গাই ছিল শিশু সৈনিকদের ব্যবহার। ব্যবহার শব্দটি যথার্থ সম্ভবত, কারণ যে নৈতিকতার জায়গা থেকে সমালোচনা, শত্রুপক্ষের সেই নৈতিকতার প্রতি প্রকাশ্য সম্মানপ্রদর্শনের দায়বদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে প্রভাকরণ নিজের বহু ঘাঁটি এলাকা ঘিরে রাখতেন শিশুদের দিয়ে। শিশুদের হাতে উঁচু জাতের রাইফেল তুলে দিতে কার্পণ্য করতেন না তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় তামিল উদ্বাস্তু এলটিটিই-র শিশু যোদ্ধা শোবাশক্তির একটি বই, নাম 'গেরিলা'। সে বইতে নিজের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে লিখেছেন অনেক সহযোদ্ধার কথা। লিখেছেন জেসুরাসন প্রিন্স নির্মলার কথা, যে ১৬ বছর বয়সে আইপিকেএফ (ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স)-এর ওপর আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে প্রাণ হারায়। এরকম চরিত্রের কথা পাওয়া যাবে আরেক তামিল শিশু যোদ্ধা নিরোমি ডি সয়জা-র আত্মজীবনীতেও, বইয়ের নাম 'তামিল টাইগ্রেস'। ডি সয়জা ১৭ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তামিল টাইগারদের সঙ্গে যোগ দেন, পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পান।
কিংবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১? বাংলানিউজ২৪ সাইটে ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত 'রণাঙ্গনের শিশু-কিশোর' শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এক চলচ্চিত্রগ্রাহকের কথা। "পেছনে আবছা দেখা যাচ্ছে আইয়ুব খানের গলায় জুতার মালা। কোত্থেকে সামনে ছেলেটা এসে স্লোগান দিতে শুরু করলো। ছবিটা তুলে উঠে দাঁড়াতে যাব, তখনই গুলি এসে লাগলো ছেলেটার গায়ে। ঘটনাটা এমন আকস্মিক ছিল, গুলিবিদ্ধ ছেলেটার ছবি তুলতেও ভুলে গিয়েছিলাম।" এরকম ঘটনা যে সে সময়ে আদৌ অপ্রতুল নয়, তা অল্পবিস্তর সকল বাঙালিরই জ্ঞাত।
১৩ বছর বয়সেই গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছিলেন যিনি, ১৮ বছর বয়সে যাঁর ফাঁসির সুবাদে সকল বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় যাঁর নাম, এবং বহু বছর পরেও যাঁকে নিয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলে, সেই ক্ষুদিরাম বসুও শিশু যোদ্ধাই ছিলেন বৈকি।
অতীত থেকে একটু বর্তমানে ফেরা যাক। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আল জাজিরা ইংলিশে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেওয়া হিসেব অনুসারে কঙ্গোয় শিশু যোদ্ধার সংখ্যা ৩,০০০। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই শিশু কন্যা বলে জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নাইজিরিয়াতে বোকো হারাম প্রায় শ'খানেক শিশুকে মানব বোমা হিসেবে ব্যবহার করেছে। ইয়েমেনে প্রতি বছর শিশু সৈনিক নিয়োগের সংখ্যা ২,০০০, এদের মধ্যে অনেকেরই বয়স ১০ বা তার কম। দক্ষিণ সুদানে সংখ্যাটা চোখ কপালে তোলার মতো। ১৯,০০০ শিশু সৈনিক সেখানে লড়ছে।
অত দূরে অবশ্য আমাদের না গেলেও চলবে। খাস ভারতে, এমনকি এ বাংলাতেও, মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় শিশু সৈনিক খুব অপরিচিত নয়। হয়ত সৈনিক শব্দটার সঙ্গে অপরিচয়ের বাতাবরণ থাকে, কিন্তু সে যে নেহাৎই মনকে চোখ ঠারা, সে কথা বোঝার জন্য তলিয়ে ভাবতে হয় না। আর একবার সে পরিচয় ঘটেই যদি যায়, এই শিশু সৈনিকের বাস্তবতা যে খুব দূরবর্তী নয়, এই পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয়টা মোটেও সুখকর হয় না। ফলে নিয়োগকর্তাদের উপর ক্ষোভ-ক্রোধের সঞ্চার হতে থাকে, সে সব বাড়তে বাড়তে কিছু ঘৃণাভর উচ্চারণও ঘটে ওঠে। কিন্তু যুদ্ধে তো পক্ষ থাকেই। এক পক্ষ, অন্য পক্ষকে অন্যায়কারী বলে দাবি করে, সেই ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধের সময় থেকেই। সে তো পক্ষাবলম্বন।
শিশুরাও পক্ষ নেয়। পরিস্থিতি অনুসারে। তাদের বোধ অনুসারে। সে বোধ কখনও খিদে দ্বারা পরিচালিত, কখনও নিয়োগকারীর জোরালো উপস্থিতির কারণে। যেমন পক্ষ নেয় তাদের অভিভাবকরা, জীবনভর।