“জনগণমন অধিনায়ক জয় হে” – ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত, যেখানে মানুষের জয়গান উচ্চারিত হয়, মানুষের অধিনায়কত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মানুষকে ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের তথা ঐক্যের অঙ্গীকার করেছে ভারতীয় সংবিধান। এমন এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক কালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ ২০১৯ সোচ্চারে ঘোষণা করছে ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বিরোধী এক ভয়ঙ্কর বৈধ নাগরিকত্বের কথা।
গত এক যুগ ধরে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের পথবাসী ও ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ-মানুষীদের সান্নিধ্য যাপনের অভিজ্ঞতার নিরিখে আমার এই লেখা। আমি খুব সচেতনভাবেই কোনও পরিসংখ্যান এড়িয়েই লিখছি। যে সমস্ত পথবাসী মানুষ এই কলকাতার বুকে প্রায় তিনপুরুষ ধরে বসবাস করছেন, যাঁরা তাঁদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত হয়েও দিন গুজরান করেন, যাঁদের রাজনৈতিক দলের সংগঠিত মিছিলের গুনতিতে দেখা যায়, যাঁদের সস্তার শ্রমে পুঁজিপতিদের লক্ষী ঘরে আসেন, সেই মানুষগুলি কি আদৌ নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন? তাঁরা কি এই পাহাড় প্রমাণ নথি দেখাতে সক্ষম হবেন?
আরও পড়ুন, জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব
২০০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত ভারতবর্ষ, তার রচিত সংবিধান প্রস্তাবনায় একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পরিচয়-এ ভুষিত হল। তার আরও দুটি ভূষণ খুবই প্রাসঙ্গিক – সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ। এই কল্যাণকামী, সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা আধারিত হল ন্যায়, সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শে।
এ হেন সাংবিধানিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে গত ৯০এর দশক থেকে বিশ্বায়নের প্রভাবে, নগরোন্নয়ন ও শিল্পায়নের আগ্রাসনে ও অর্থনৈতিক উদারনীতির উদারতায় গোটা নগরবাসীর মধ্যে প্রতি এক চতুর্থাংশ উছেদের শিকার হন এবং স্থায়ী বাসস্থান, স্বাস্থ্যবিধান, খাদ্য, পরিশ্রুত পানীয় জল ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন/হয়ে চলেছেন। ২০২১ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে শতকরা চল্লিশ শতাংশ (Batra-2007, P-57)। এই প্রগতির আগ্রাসনে, উন্নয়নের জোয়ারে কৃষিজমিগুলি হাতছাড়া, কৃষিনির্ভর রুজি রোজগারের নিশ্চয়তা কেড়ে নেওয়া হল, ফলত গ্রাম থেকে মানুষ কর্মসংস্থান ও বেঁচে থাকার তাগিদে শহরে স্থানান্তরিত হল ও বাসযোগ্য জায়গার অভাবে নিজেদের ঠাঁই করে নিল ব্রিজের নীচে, পাইপের ভিতর, প্লাসটিকের ছাউনিতে, প্ল্যাটফর্মে, ফুটপাতে। ঠিক অন্যদিকে গড়ে উঠল মাল্টিপ্লেক্স ও শপিংমল সঙ্গে রমরমিয়ে চলতে লাগল প্রোমোটর রাজ আর সিন্ডিকেটের বাড়বাড়ন্ত। তখন এই বিপুল উচ্ছিষ্ট মানুষ পরিগণিত হল সীমালঙ্ঘনকারী উদ্বাস্তু গোষ্ঠীতে।
রাষ্ট্রীয় হিংসার শিকার এই উদ্বাস্তুরাই তাঁদের শ্রম দিয়ে টিকিয়ে রেখে চলেছেন নাগরিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কল্যাণকামী রাষ্ট্র এই উচ্ছিষ্টদের কোনও পরিকল্পিত পুর্নবাসন দিতে পারেননি বরং ক্রমাগত শোষণ করে চলেছেন কখনও সস্তার শ্রমে কখনও বা তাদের বিভিন্ন অপরাধের হাতিয়ার করে। এই পথবাসী মানুষেরা হন অমানবিক হিংসার শিকার; প্রতি মুহূর্তে পুনরায় উচ্ছেদের আতংকে তাঁরা দিন গোনেন। তাঁদের ন্যূনতম অধিকারের সুরক্ষা রাষ্ট্র দিতে পারে না, মন্ত্রী আমলাদের চলার পথ মসৃণ করার জন্য তাঁদের পিটিয়ে তুলে দেওয়া হয়, জমি দখলের লড়াইয়ে, বুলডোজারের এক ধাক্কায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তাঁদের টিকে থাকার শেষ সম্বল ওই ছাউনিটুকু। বিনা অপরাধে যাঁদের সইতে হয় অসহনীয় অত্যাচার, যাঁদের শেষ সহায়টুকু কেড়ে নিয়ে শহরের সৌন্দার্যয়ন প্রকল্প চলে – সেই উচ্ছেদ হওয়া, সহায় সম্বলহীন পথবাসীরা কি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নন?
আরও পড়ুন, নাগরিকত্ব নিয়ে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডাফলোর লেখা
সার্বভৌমত্বের প্রস্তাবনায় এঁরা কি তাহলে ভূমিচ্যুত – ভূমি বহিষ্কৃত এক গোষ্ঠী? এই পথবাসীদের আরও একটি নিষ্ঠ অংশীদার হলেন ভবঘুরে – মানসিক অস্থিত মানুষ। এই অস্থিতির কারণ কী? কেন এঁরা ঘরছাড়া, পরিচয়হীন অস্থিত্বে টিকে আছেন? এঁরাও কি তাহলে একপ্রকার ‘সামাজিক আবর্জনা’? এঁরাও কি একভাবে রাষ্ট্র সমাজ পরিবারের বর্জিত অংশ? কেন এই বর্জন? দেখা গেছে এর পিছনে দায়ী দারিদ্র, বিনা চিকিৎসা, গার্হস্থ্য হিংসা। আর সরকারি অনীহা। এঁদের হারিয়ে যাওয়া, ভুলে যাওয়া পরিচয় যদি নতুন করে পাওয়ার চেষ্টা চলে তবে দফতরে আওয়াজ ওঠে ‘বাংলাদেশী নয় তো? কি প্রমান আছে যে ও বাংলাদেশী নয়? প্রমান দিতে হবে নইলে আইনি জটিলতায় ফেঁসে যাব।‘
তাত্বিকভাবে আমরা জানি রাষ্ট্র হল রাজনৈতিক ভাবে সীমায়িত এক ভূখণ্ড। আর রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য তার নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করা। কিন্তু আমরা কি দেখতে পাই?... ভারতবর্ষের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ সার্বভৌম, কল্যানকামী রাষ্ট্রে বাস্তবিক ভাবে এই ভবঘুরেদের কোন জায়গা নেই। কোন মাপকাঠিতেই এঁদের যেন দেশের নাগরিক বলে চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের কাছে এক বিড়ম্বনার বিষয়। এঁদের প্রাপ্য হয় লাঠির বাড়ি, নয় যৌন হিংসায় রক্তাক্ত শরীর অথবা কখনও বা তারা হয়ে যায় মর্গের অসনাক্ত লাশ। এঁদের পরিচয়পত্র দেওয়া যাবেনা – তার জন্য ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক নথি অত্যন্ত জরুরি।
আমার প্রশ্ন এই মানুষগুলো যখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন, ফিরে পাচ্ছেন তাঁদের সক্ষমতা, ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন ও দাবি জানাচ্ছেন নাগরিক পরিচয়পত্রের, মর্যাদার, নিজের দক্ষতায় খুঁজে নিচ্ছেন শ্রমের সুযোগ, রোজগার করছেন স্বনির্ভরতার পথে পা রাখছেন তখন তাদের সমাজের মুলস্রতে অন্তর্ভুক্ত করতে এই নাগরিক সংশোধনী আইনে তাদের জায়গা কোথায়? এই পথবাসী ও ভবঘুরে মানুষদের সক্ষমায়ন কি আসলে শুধুই প্রকল্প সীমিত? আদতে এঁরা কী সততই স্বনির্ভর নাগরিক হয়ে উঠতে পারবেন?
আর যেই গর-ঠিকানী, ভবঘুরে, আত্মবিস্মৃত মানুষেরা, যাঁদের দেখতে পাওয়া যায় ফুটপাতে, বাসগুমটিতে, রেল প্ল্যাটফর্মে, ব্রিজের নীচে – শহরের আনাচে কানাচে, নিজেদের পরিচয়ও যাঁরা মনে করতে পারেন না, কোনো ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক সীমান্ত উওরিত গোটা শহর, গ্রাম, রাজ্য, দেশ, এই সমস্তই যখন তাঁদের ঠিকানা; এই টিকে থাকার লড়াইয়ে যখন পথবাসী মানুষটি হয় আর এক ভবঘুরের সহকারী বন্ধু তথা “কেয়ার গিভার” ও গড়ে তোলে এক বিকল্প পরিবারের কাঠামো, তখন কোন পরিবার পরিচয়ের ভিত্তিতে তৈরী হবে এঁদের নাগরিকপঞ্জি?
আরও পড়ুন, আজাদি শ্লোগান: উত্তর-আধুনিক রামধনু স্বর
আমার প্রশ্ন – এই অসাংবিধানিক মানববিরোধী আইনে এই পথবাসী মানুষেরা, এই ভবঘুরে মানুষেরা কোন অপরাধে দন্ডিত হবেন? তবে কি এই বিপুল মানবসম্পদ তাঁদের পরিচয় বিস্মৃতির ও অপারগতায় হারিয়ে যাবেন বৈধ সভ্যতার অন্ধকারে?
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যেখানে যৌথতা অন্তর্ভুক্তি হল মানবাধিকারের মূলমন্ত্র, তেমন একটি সময়ে ভারতবর্ষের এই নয়া আইন যে বর্জনের-বহিষ্কারের নীতি অবলম্বনে তৈরী হল – তা কি একভাবে এই ‘সামাজিক আবর্জনা’ সাফাইয়ের ষড়যন্ত্র? পথবাসী, ভবঘুরে মানুষদের সসম্মানে বেঁচে থাকার অধিকার যদি কেড়ে নেওয়া হয়, যদি তাঁরা অবৈধ নাগরিক হন – তবে বলব নগরবাসীশূন্য নগরে “নাগরিকত্ব” কথাটাই একটা প্রহসন মাত্র – তাহলে কি সংশোধনী আইন না-নাগরিকত্বের সুরক্ষা দেবে?
(লাবণি রায় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ঈশ্বর সংকল্প-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। এই সংস্থা ভবঘুরে, ঠিকানাহীন মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করে। মতামত ব্যক্তিগত।)