২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী সর্বাধিক প্রশাসন, ন্যূনতম সরকার (ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স, মিনিমাম গভর্নমেন্ট)-এর শ্লোগান দিয়েছিলেন। সে শ্লোগান বহু ভোটারের মনে অনুরণন তুলেছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন ভারতের সরকার তাঁদের জীবনযাপনে বড় ছায়া হয়ে উঠছে, সে তুলনায় সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্তির ভাঁড়ার ফাঁকাই থেকে যাচ্ছে। সর্বাধিক প্রশাসন ও ন্যূনতম সরকার মধ্যেকার দ্বন্দ্বের সমাধান করার জন্য একটা বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া দরকার। সেটা হল, রাষ্ট্র খুব বেশি ভারী না হয়ে উঠেও কীভাবে কার্যকর হতে পারে।
সাম্প্রতিক সিএএ ও এনআরসি বিতর্ককে এই আলোকে দেখা যেতে পারে। আমরা যারা সার্ভের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দিলাম, তারা জানি যে উত্তরদাতাদের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া কত কঠিন হতে পারে। আমাদের মনে আছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক বছর কুড়ির মহিলার কথা। তিনি সেখানেই জন্মেছিলেন। "এ গ্রামে নয়", দক্ষিণ বা পূর্ব দিতে হাত দেখিয়ে "ওই দিকে, দু-এক ঘণ্টা দূরে।" আপনি এখানে এলেন কী করে? "আমার মা ছিল পাশের গ্রামের, মায়ের বিয়ে হয়েছিল যে গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, সেইখানে। কিন্তু আমার বাবা আবার বিয়ে করে, আমাদের বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেয়। আমার বয়স তখন ছয় কিংবা আট। আমরা আমাদের গ্রামে ফেরত যাই, কিন্তু আমাদের মামারা আমাদের নিতে চায়নি। শেষে এ গ্রামের এক মহিলা আমাদের একটা ঠাঁই দিয়েছিলেন।" গ্রামের নামটা বলতে পারবেন? "মা জানত, কিন্তু মা তো মরে গেছে!" আমরা জন্মস্থানের জায়গায় অজ্ঞাত কোড বসিয়েছিলাম (যদ্দূর মনে পড়ে ৯৯৯৯)। প্রত্যাশা করা হচ্ছে এনআরসির সময়ে নিজের নাগরিকত্বের মর্যাদা স্থির করবার জন্য এই মহিলা তাঁর সম্পর্কে সমস্ত তথ্য দিতে পারবেন। আর যদি তিনি না সেসব তথ্য না দিতে পারেন, তাহলে তো হাতে রইল সিএএ- অভিবাসী, হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈনদের জন্য। মুসলিমদের জন্য নয়।
নাগরিকত্ব যদি স্থির না করা যায়, তাহলে তাঁরা অপরাধী গণ্য হবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিদেশি বলে অপরাধী। এবং রাষ্ট্রহীন। এথবা কিছু আধিকারিদের সদিচ্ছার উপর নির্ভরশীল কোনও মর্যাদা। আমাদের ফিল্ড ওয়ার্ক থেকে আমরা যা শিখেছি, তাতে এ এক ভয়াবহ জুয়া।
এর মধ্যে কোনও ন্যূনতম সরকরা বা সর্বোচ্চ প্রশাসনের ব্যাপার নেই। এ হল মানুষের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার প্রশ্নে অবাঞ্ছিত সরকারি হস্তক্ষেপ। যদি তুমি দেশের নাগরিক না হও, তাহলে এতদিন তুমি কোথায় বাঁচলে? কেউ যদি তোমাকে না চায়, তাহলে তুমি কে? এ প্রশ্নটাই বহু তরুণতরুণীকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।
কিন্তু সরকারের আরও একটা বিষয় আছে, উদ্বেগের। নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্ত আলোচনাতেই ধরে নেওয়া হচ্ছে অভিবাসীরা যেন একটা সমস্যা। আসামে, এই ধারণার একটা সমাধানও হয়েছে- অভিবাসী মাত্রেই সমস্যা, তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। সে কারণেই এখানে সিএএ এখানে অভিশপ্ত বলে গণ্য এবং যথেষ্ট সংখ্যক বিদেশি পাকড়াও করতে না পারায় এনআরসি-র কোনও জনপ্রিয়তা নেই। আমাদের নতুন বই গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস-এ আমরা দেখিয়েছি যে কম দক্ষতার আর্থিক অভিবাসীদের জন্য আর্থিক পরিস্থিতির বদল ঘটে না। সমস্ত তথ্য প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে কম দক্ষতাসম্পন্নদের ব্যাপক পরিমাণ অভিবাসনের পরও অন্য কম দক্ষতার অভিবাসীদের আয়ের তারতম্য ঘটেনি। তার একটা কারণ হল আর্থিক অভিবাসীরা সুযোগের জন্য মুখিয়ে থাকেন এবং সামনে যা আসে তাই গ্রহণ করেন। স্থানীয় অধিবাসীরা যে সব কাজ করতে চান না, এই অভিবাসীরা সেসব কাজও করেন। আরেকটা কারণ হল, এই অভিবাসীরা যে শুধু শ্রম বিক্রি করেন, তাই নয়, তাঁরা নয়ার্জিত উপার্জন দিয়ে খাবার কেনেন, চুল কাটেন, বা আরও নানা উপায়ে অর্থ খরচ করে থাকেন।
মধ্যবিত্তদের আসল আর্থিক চ্যালেঞ্জ হল, তাদের আশঙ্কা এতদিন ধরে তারা যে প্রাপ্তির জন্য হাঁ করে তাকিয়ে থাকত, এই নতুন গোষ্ঠী এবার তাতে ভাগ বসাবে। তাদের কাছে অন্তিম প্রাপ্তি বা প্রাইজ হল সরকারি চাকরি। কিন্তু বেহাল প্রশাসনের নমুনা হল সরকারি চাকরির অপ্রতুলতা- ২০১৯ সালে রেলওয়ের নিচুতলার ৬৩হাজার চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন এক কোটি নব্বই লক্ষ ভারতীয়। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে আমরা যা পাচ্ছি তার মধ্যে কোথাও গলদ রয়েছে।
কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, স্থানীয় জনতার জন্য আর্থিক ন্যায়ের প্রশ্ন। এখনও যদি এ প্রশ্নের মুখোমুখি না হওয়া যায়, তাহলে সারা দেশেই এ প্রশ্ন আরও বিচ্ছিন্নতা সহকারে উঠতে থাকবে, উঠতে শুরুও করেছে। চেন্নাইয়ে বাঙালি হিন্দু অভিবাসীর তামিলভাষী সন্তান কি সে রাজ্যের সরকারি চাকরি পাবে? বিহার থেকে আসা মারাঠিভাষী সন্তানেরা, যারা মহারাষ্ট্রে বেড়ে উঠেছে তারা? এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হতেই ভাবুন, বেসরকারি ক্ষেত্রের ভাল ভাল চাকরির কথা! আর শুধু রাজ্যের সীমার মধ্যেই বা আটকে পড়ে থাকবেন কেন? মুম্বই শহরের চাকরি কি মুম্বইকরদের জন্য? অভিবাসন নিয়ে এই যে প্যারানোইয়া, তা হল এমন এক জিন, যাকে পত্রপাঠ বোতলে ভরে ফেলা উচিত।
আর তার সেরা উপায় হল ভারতের সেই দর্শনকে আলিঙ্গন করা, যেখানে ভারত বহু সভ্যতার জননী। যাঁরা গণতান্ত্রিক, খোলামেলা, সহিষ্ণু, সকলকে গ্রহণ করতে সক্ষম হিসেবে যাঁরা জাতীয় উদ্যোগে যোগ দিয়েছেন, তেমন সকলের জন্য আমরা দরজা খুলে দেব না কেন! কেন দরজা খুলে দেব না পাকিস্তানের নিপীড়িত আহমেদি ও শ্রীলঙ্কার হিন্দুদের জন্য! আমরা ১.৩ বিলিয়ন মানুষ, আর কয়েক মিলিয়ন নিমেষে মিশে যাবে। আমরা সত্যিই সারা বিশ্বের ধ্রুবতারা হয়ে উঠব।
(অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার ডাফলো এমআইটি-র প্রফেসর এবং ভিনদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক, ২০১৯ সালে অর্থনীতির জন্য নোবেল পুরস্কার খেতাব পেয়েছেন)