গত বৃহস্পতিবার থেকে গণভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। কলকাতার জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সগর্বে ঘোষণা করেছেন যে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং মানবাধিকার কমিশনের তত্ত্বাবধানে এ দেশে যদি গণভোট হয় তাহলে তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে রাজি। জবাবে মুকুল রায়ও এই বাংলায় গণভোটের দাবি জানিয়েছেন। এখন একটু বুঝে নেওয়া যাক কে কোন বিষয়ে গণভোট চাইছেন। তারপর আরও বিশদে গিয়ে বুঝতে হবে যে সত্যি যদি সে রকম গণভোট হয় তাহলে তার ফলাফলের ভিত্তিতে কী কী ঘটতে পারে।
আপাতত আমাদের দেশের সংবিধান মেনে কি হওয়া উচিৎ সেই বিশ্লেষণ থাক। তার কারণ সংবিধানের ব্যাখ্যা নিয়েই এখন যা গোলমাল তাতে বিভিন্ন মতের বৈপরীত্যে মোটা বইটার মাথামুণ্ডু ঘেঁটে মুড়িঘণ্ট রান্না হচ্ছে। অন্তর্জালে তার বৈদ্যুতিন অস্তিত্বেও সাড়া জেগেছে। যেখানেই যত সংবিধান সংক্রান্ত লিঙ্ক, তাতে ক্লিক পড়ছে লক্ষ কোটিতে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এতো পড়াশোনা করতে শুরু করেছেন সকলে যে নিজেদেরই মাঝে মাঝে আপন নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দিহান মনে হচ্ছে। শুধু দেশ নয়, ঘর-বাড়ি, ইস্কুল-সংসার, পাড়ার ক্লাব কিংবা রাজনৈতিক দল সবেতেই এখন নাগরিকত্ব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নাগরিকত্বের নথি ও মেয়েরা
বাজারে একটু বেশি আড্ডা মেরে দেরি করে ঘরে ফিরেছেন অমিতবাবু। বৌদি দরজা না খুলে তাকে বাইরে দাঁড় করয়ে রাখলেন। ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, “তরকারি কাটার লোক তোমার দেরি দেখে চলে গেছে। একেবারে কাল সকালে বাজার সেরে ঘরে এসো। আপাতত তোমার নাগরিকত্ব বাতিল”। হতাশ হয়ে অমিতবাবু আশেপাশের বাড়ির দিকে উঁকি মারছেন যদি স্ত্রীর রাগ কমা পর্যন্ত অন্য কোথাও শরণার্থী হিসেবে নাম লেখানো যায়।
রাজনৈতিক নেতাদের পোয়াবারো। শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী যাই বলা হোক না কেন সুবিধেমত একদল থেকে অন্যদলে নাগরিকত্ব বদল করতে দেশের মধ্যে কোন বাধা নেই। পাড়ার ক্লাবের সদস্য সংগ্রহের আবেদনপত্রে ‘সদস্য’ কেটে ‘নাগরিক’ বসানো হয়েছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন নাগরিক তো নগর থেকে এসেছে, তাই কলকাতা শহরের জন্যে আলাদা করে পাসপোর্ট বানাতে হবে কিনা। নগর এর সঙ্গে ’ষ্ণিক’ যোগ করেও প্রত্যয় মিলছে না একেবারে।
জামিয়া মিলিয়ার অশান্ত রাত, এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে
অমিত শাহ মহাশয় সদ্য এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে ভোটার কার্ড কিংবা আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। খুঁজে দেখলাম আধার কার্ডে পরিষ্কার লেখা আছে যে “আধার পরিচয়ের প্রমাণ, নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়”। আগে না অনুধাবন করলেও এখন হাড়ে হাড়ে বোঝা যাচ্ছে যে পাঁচবার লাইনে দাঁড়িয়ে (অর্থাৎ শুরুর চার বার ব্যর্থ) বারো অঙ্কের পূর্ণ সংখ্যার সঙ্গে নিজের ঝাপসা মুখের যে ছবি পাওয়া গেছে তা আসলে বিশ্বনাগরিক হিসেবে পরিচয়ের বৈদ্যুতিন তথ্যরাশি। অর্থাৎ পৃথিবীর কোন একটি বিশেষ অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ-য় দাঁড়িয়ে আপনি যে একটা আস্ত হোমো স্যাপিয়েন্স তার প্রমাণ এই আধার কার্ড।
আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে আত্মপরিচয়ের তর্ক-বিতর্ক অতিক্রম করে আবার নিজের দেশের গণভোটে ফেরা যাক। সহজে যা আত্মস্থ করা গেল তা হচ্ছে মমতা চাইছেন যে দেশে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন লাগু হওয়া উচিৎ কিনা তাই নিয়ে গণভোট হোক। শুক্রবার দুপুরের সাংবাদিক বৈঠকে তিনি অবশ্য এই গণভোটকে ওপিনিয়ন পোল বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ জনমত যাচাই। আর মুকুল রায় দাবি করছেন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার মানুষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রেখে দিতে চাইছেন কিনা তাই নিয়ে অন্য একটি গণভোট।
নাগরিকত্ব বিলের মূল্য দিতে পারবে তো ভারতবর্ষ?
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী আগেই বলেছিলেন কলকাতা লন্ডন হবে। সেই সময় দলের দুনম্বর হিসেবে মুকুল রায় তা সমর্থন করেছিলেন। ফলে ব্রিটেনে যদি বছর কয়েক আগে ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট হতে পারে, তাহলে ভারতের ইংল্যান্ড হওয়ার জন্যে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন। অকারণে শুধু মামুলি কয়েকটা গণভোটের জন্যে আমরা প্রথম বিশ্বের তুলনায় পিছিয়ে থাকব কেন? ফলে ওদের একটা গণভোট হলে আমাদের চাই দুটো গণভোট। বর্তমানে আমাদের রাজ্যের দুই দলের দুই নেতানেত্রী, যারা আগে একই দলের এক এবং দুই ছিলেন, তাঁদের এই অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে অনুধাবন করার মত উদারনৈতিক, প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ভাবনা আমাদের মননে গজগজ করছে। সুতরাং হোক গণভোট। বিষয়টাকে নতুন বানানে হ্যাশট্যাগ দিয়ে ”#হোজ্ঞণভোট” বলেও আকাশপাতায় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ গণভোট হচ্ছেই, একটা লোকসভার গণভোট আর একটা বিধানসভার। দুটো ভোটেরই নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং বুথফেরত সমীক্ষা হবে। দেশ এবং রাজ্যজুড়ে রাশিবিজ্ঞানের রমরমা। অনেকে এই সমীক্ষাগুলিকে এবার ওপিনিয়ন পোলের ওপিনিয়ন পোল (জনমত যাচাইয়ের জনমত যাচাই) বলেও নামকরণ করতে পারেন। এ হল দ্বিস্তরীয় জনমত যাচাই, যার বিস্তার এবং বিন্যাস আরও বাড়িয়ে বিষয়টিকে জটিল গবেষণার স্তরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ঠিক যেমনটি হচ্ছে আমাদের নাগরিকত্ব নিয়ে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন দেশের নিরপেক্ষ এবং বিজ্ঞ মানুষদের তত্ত্বাবধানে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। বিজ্ঞ বিষয়টা নিয়ে খুব তর্ক বিতর্কের জায়গা নেই। আমাদের দেশে তেমন মানুষ আছেন অনেক, এবং তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেই বিরাজমান। কিন্তু সংবিধানকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়া দেশের এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ মানুষ খুঁজে পাওয়া শক্ত। আর নিরপেক্ষ কিছু মানুষের অস্তিত্ব মেনে নিতে গেলে গণভোটে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ এর সঙ্গে “জানি না” কিংবা “বুঝি না” বলেও একটা টিক দেওয়ার ঘর রাখতে হবে। আপাতত নাগরিকত্ব নিয়ে সংবিধানকে চমকে দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার আর সেই ঘোষণাকে মানব না বলে রাজ্য সরকারের ঘোষণাও উপরোক্ত মননশীল জনগণের ঘিলু ঘেঁটে দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল। বুঝতে একেবারে অসুবিধে নেই যে মাঝখানে দাঁড়ানোর জায়গা কমছে দিন দিন।
এবার গণভোটের সবথেকে স্বাভাবিক ফলাফল দুটির দিকে নজর রাখা যাক। এখনও এক বছর হয় নি বিজেপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। সেই ধারা বজায় রেখে ধরা যাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরর দাবি করা গণভোটে জিতে গেল বিজেপি, অর্থাৎ দেশের মানুষ মতামত দিল যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন লাগু হওয়াই উচিৎ। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে ২০১৬ তে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এই রাজ্যে তৃণমূলের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু। লোকসভায় কিছুটা খারাপ করলেও সাম্প্রতিক রাজ্যের তিন বিধানসভা উপনির্বাচনে আবার দারুণ ফল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই হিসেবে অনুমান করা যাক যে মুকুল রায়ের প্রস্তাবিত গণভোটে বাংলার মানুষ রায় দিলেন যে মমতা ব্যানার্জীই থাকুন। তাহলে আপাতত সব সমস্যার সমাধান। বিজেপি কেন্দ্রে আর তৃণমূল রাজ্যে নিশ্চিন্তে রাজত্ব করতে পারবে।
তখন এক ধাক্কায় ভারতে রামরাষ্ট্র আর বঙ্গে রামরাজ্য। এই দুই গণভোটের পর ভারতের সংবিধান আলমারির কোন তাকে তোলা থাকবে সে নিয়ে আর একটি গণভোট করে ফেললেই প্রতিটি মননশীল নাগরিকের চিন্তাশক্তির নির্বিকল্প সমাধি।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)