খবরে পড়লাম পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-র যুব মোর্চা "সংশোধিত নাগরিক আইনের উপযোগিতা বোঝাতে" ঋত্বিক ঘটকের ছবি উদ্ধৃত করে ছয় মিনিটের প্রোপাগান্ডা ভিডিও বানাবেন। ছবি তো হাটে বাজারে থাকে, ডিজিটাল উদ্ধৃতি করার প্রযুক্তিও সহজলভ্য - তাই উদ্ধৃতি জুড়ে জুড়ে যে কোনো ভিডিও-কূটতর্কই করা যায়। অনেকেই এবার ঋত্বিকের জীবন ও জীবনী উল্লেখ করে বলবেন যে তিনি বামপন্থী ছিলেন, তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে সংশোধিত নাগরিক আইন বেসুরে বাজে। সেরকম তর্ক যে পেশ করা হবে, তা এই প্রস্তাবিত ভিডিওর মেকাররা জানেন। সেই প্রতিযুক্তি তাই দেবো না, তা দেওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরা আছেন। শুধু প্রতিতর্ক দিচ্ছি ঋত্বিকের ছবির উদ্ধৃতি দিয়েই; একদম সিনেমার ছাত্ররা যেভাবে ছবি আলোচনা করবে সেভাবে।
ঋত্বিকের ছবিতে উদ্বাস্তুরা শুধুই হিন্দু কি?
প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করি - ঋত্বিকের ছবিতে উদ্বাস্তুর একমাত্র পরিচয় কি ধর্মীয়? আপাতদৃষ্টিতে তাই'ই মনে হবে, দেখাই তো যাচ্ছে পূর্ববঙ্গীয় বাঙাল চরিত্র, শোনাও তো যাচ্ছে তাদের উপভাষা, নামও হিন্দুদের। কিন্তু 'মেঘে ঢাকা তারা' আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক (নীতার ক্লাইম্যাক্টিক চিৎকার নিশ্চয়ই ভিডিওতে থাকবে হিন্দু উদ্বাস্তুর আর্তনাদ হিসেবে)। এই ছবিতেই ঋত্বিকের বিখ্যাত 'মাদার আর্কেটাইপ' স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হতে থাকে। হিন্দুত্ববাদীরা নিশ্চয়ই এই আর্কেটাইপের 'ধর্মীয়' সূত্র নিয়ে উৎসাহিত থাকবেন। অতএব শুধু সেটা নিয়েই দুকথা বলে শুরু করা যাক।
নাগরিকত্ব বিতর্ক ও রামরাজ্যে গণভোট
উদ্বাস্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী 'ভালো মেয়ে' নীতার জন্ম হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজার দিনে। জগতের ধাত্রী - এই পরিবারের জগতেও সে ধাত্রীসমা হয়ে থাকে। এবং একটি নিয়মিত ছন্দে ঋত্বিকের ক্যামেরা তাকে ধরেন প্রতিকৃতির মত। সুপ্রিয়া চৌধুরীর দীর্ঘ গ্রীবা, দৃঢ় শিঁরদাড়া দেখে মনে হয় যেন প্রতিমা। অনেক সময়েই ক্যামেরা লো-অ্যাঙ্গেলে, অর্থাৎ নিচ থেকে ওপরের দিকে তাকিয়ে তাকে দ্যাখে; ঠিক যেভাবে আমরা প্যান্ডেলে মাতৃমূর্তি দেখি। নীতা আমাদের আধুনিক কালের জগদ্ধাত্রী।
অনেকের সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য মনে আছে - সিঁড়ি দিয়ে নামছে নীতা; ঠিক আগে যেভাবে বর্ণনা দিলাম সেভাবে কম্পোজড। সে সবে বুঝেছে যে সে তার প্রেমিক এবং বোন, দুজনের দ্বারাই প্রতারিত। সাউন্ডট্র্যাকে শোনা যায় চাবুকের পরপর আঘাত। এবার নীতা গলার কাছটা আঁকড়ে ধরে। এই ইমেজ খুবই বাঙ্ময়, যেন ছবির ক্লাইম্যাক্টিক চিৎকার আর তার যক্ষ্মার রক্ত একইসাথে গলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সত্যি বলতে কি, এই ইমেজ ছবির একধরণের পর্বান্তর ঘোষণা করে। কোন পর্ব থেকে কোন পর্বে?
শব্দ। ইমেজ থেকে শব্দের দিকে সরবে ছবির নজর। কারণ একটু পরে নীতার গলা থেকে বেরিয়ে আসবে কাশির সঙ্গে রক্ত, আর সাউন্ডট্র্যাকে ভেসে ভেসে উঠবে "আয় লো উমা কোলে লই" - গৌরীদানের গান। "স্মার্ত প্রভাবপুষ্ট বাঙালি সমাজ গৌরীদানেতে পাগল হয়ে উঠেছিল" - ঋত্বিক লিখেছিলেন।
নাগরিকত্বের নথি ও মেয়েরা
কুলীন ব্রাহ্মণদের বহুবিবাহের বর্বর প্রথা, সেই বর্বরতাকেই তো শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে বলা হত 'গৌরী'-কে দান করা হচ্ছে বালিকার বলপূর্বক বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সময়ে। এই যে আমরা জানি ঋত্বিক ঘটক তার ছবিতে 'মিথ' ব্যবহার করেন; সেই 'মিথিফিকেশন'-এর প্রক্রিয়াতেই চাবুক হানছেন ঋত্বিক। প্রতিবার 'দেবীত্ব আরোপ' করা মানে ধর্মীয় শয়তানি, যারা দেবীত্ব আরোপ করে, তারাই সেই শয়তানিকে ধারণ, পুষ্ট করে, বজায় রাখে - তিনি বলছেন। এই যে বাচ্চা মেয়েটা, সবে বাপের বাড়ির জমি-উঠোন-বাগান-পুকুর চিনছে, গাছের নাম দিচ্ছে, নাম দিচ্ছে হাঁস আর মুরগির - তাকে হঠাৎ "ওঠ ছুড়ি" বলে এক মাঝবয়সি ব্রাহ্মণ লম্পটের শয্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সে বুঝতে পারছেনা কিছু, ভয় সিঁটিয়ে আছে, মা অসহায় ভাবে বলছেন - ভয় কিসের, আমি আছি না? এই জেনেও যে তিনি কন্যার জীবনে আর নেই সেভাবে - এই মেয়েকেই বলা হল গৌরী, এই পিতৃতান্ত্রিক বর্বরতার নামই হল গৌরীদান, এই গৌরীই ঋত্বিকের আদি রিফিউজি।
ঋত্বিক বলছেন - কী দর্শক, এতক্ষণ বলছিলে না - যে নীতা লক্ষ্মী মেয়ে, জগদ্ধাত্রী? যখন মেয়েটা চোখের সামনে হাড়-মাস কালি করে তিলে তিলে শেষ হচ্ছিল তোমাদের দৃষ্টিতে 'ভালো' হবে বলে? তোমরাও দেবীত্ব আরোপ করছিলে না একই ভাবে? ঋত্বিক ছবির প্রথমার্ধে এই 'দর্শন'-এর ফাঁদে ফেলেন আমাদের, দ্বিতীয় অর্ধে সেই ইমেজের 'অর্থনির্মাণ' করার জন্য আমাদের চাবকান। ঋত্বিক বলছেন যে উদ্বাস্তুকরণ ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্ত্বে শুধু হয়নি, হয়ে চলেছে ইতিহাস জুড়ে; হাজার হাজার মেয়েদের এভাবে উদ্বাস্তু করেছে হিন্দুধর্ম। এভাবেই হিন্দুধর্মের পিতৃতন্ত্র জিইয়ে রাখবে উদ্বাস্তুকরণ, প্রতারণা, ভায়োলেন্স।
তাহলে এভাবেও উদ্বাস্তু হিন্দু, কারণ সে হিন্দুধর্মের শিকার বহু নারীর একটি নারী। পিতৃতন্ত্রের ধ্বজাধারী সমস্ত ধর্মের মতই, বাল্যবিবাহ বহুবিবাহের রীতির নির্মাতা কুলীন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুধর্ম। নীতাও উদ্বাস্তু কারণ তাকে তার পরিবার বিসর্জিত করে দেবীত্ব আরোপ করে শুষে ছিবড়ে করে দেওয়ার পর, হিন্দুধর্মীয়রা যেভাবে করে। যেভাবে করেছে 'মেঘে ঢাকা তারা'-র প্রথম অর্ধের দর্শক, নীতাকে বেচারি ভালো মেয়ে ভেবে।
জামিয়া মিলিয়ার অশান্ত রাত, এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে
উদ্বাস্তু শুধুই কি হিন্দু? শরণার্থী শুধুই কি হিন্দু?
ঋত্বিকের নাগালে থাকা বাস্তবতায় শুধুই তো হিন্দু; আর কোন ধর্মের উদ্বাস্তু তার হাতের কাছে ছিল? এবার প্রশ্ন হল উনি কি তার জন্য অন্য কোন জাতিকে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন? সেই যে বিজন ভট্টাচার্য দর্শকের দিকে আঙুল তুলে বললেন 'আই অ্যাকিউজ!’ (তারপরে অবশ্য - "কারেও না")। দায়ী তো তিনি করেইছেন। কিন্তু অন্য ধর্মকে নয়। দেখা যাক 'সূবর্ণরেখা'-য় দায়ী করছেন কাদের।
বিজেপির ভিডিওনির্মাতাদের মনে করিয়ে দেবো, 'সুবর্ণরেখা' শুরু হয় চন্দ্রবিন্দুর ভাষায় ব্রেনে ঝিলমিল লেগে যাওয়া একটি তারিখে - "সন ১৯৪৭ ইং, ২৬শে জানুয়ারি, জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস"। এই বিচিত্র তারিখের অর্থ বিস্তারিত করলাম না, ঋত্বিক তাহলে আদিতম 'অ্যান্টিন্যাশনাল' বলে চিহ্নিত হতে পারেন। সামান্য উল্লেখ করবো পর্দায় লিখিত পরবর্তী লাইনটির - "কলিকাতার উপকণ্ঠে ছিন্নমূল মানুষ তখন জোর করিয়া মাথা গুঁজার জন্য জমি দখল করিতেছে"। এই "জোর করিয়া"-র পেছনে অকথিত ইতিহাস আছে কি? আমি আজ যেখানে বসে লিখছি? এই জমি কি শুধু জমিদারদের ছিল? মুসলমান কৃষকদেরও ছিল। তাঁরা কোথায় গেলেন? তাঁরাও কি নতুন উদ্বাস্তু হলেন না আমাদের হাতে? ঋত্বিক কি নবজীবন কলোনির রিফিউজিদের অপাপবিদ্ধ মনে করতেন? বিস্তারিত হবার অবকাশ নেই, তাই প্রশ্নটা রেখে দিলাম।
কিছুক্ষণ পরেই নিম্নজাতির এক মহিলা ঠাই পেলেন না নবজীবন কলোনিতে, কারণ "জেলায় জেলায় বিভেদ, একেও যদি আমরা টিকিয়ে না রাখতে পারি, তাহলে আমাদের রইলোটা কি?” অতএব সেই বাগদি বউ ঋত্বিকের নবরামায়ণে হলেন কৌশল্যা, কারণ শুধুই কি তিনি পাবনার নন বলে? ছবির মধ্যপর্বে ইতিহাসের ভূমি ফুঁড়ে আবার উদয় হন সেই মা রেলস্টেশনে। এই ছবির 'রাম'-এর শরীরে লেগে যায় তকমা, সে 'নিচু জাতের সন্তান'। তার আধুনিকায়নের স্বপ্ন নষ্ট করা হয়, করে এক উচ্চবর্ণের ক্ষমতালোভী হিন্দু রিফিউজি - ঈশ্বর। অভিরামের মাকে দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু করা হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে। দণ্ডকারণ্য থেকে অন্ত্যজ মা যখন ফেরেন, তখন ফেরেন ইতিহাসের আঘাতে মৃতপ্রায় দেহ হিসেবে - ঋত্বিক মরিচঝাঁপির প্রফেসি করছেন ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিতে।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন ও ইসলাম ধর্ম
শরণার্থী কি শুধুই হিন্দু? সে নারী, সে অন্ত্যজ - হিন্দুত্বের ভিক্টিম। রামায়ণে মর্যাদা পুরুষোত্তমের আখ্যানের তলায় চাপা পড়ে থাকা নারীর প্রতি অন্যায়ের গাথা ফের তুলে আনা ছবি 'সুবর্ণরেখা'। এই ছবিতে তারিখ খুব জরুরি উপাদান; তার মধ্যে একটি তারিখ হল ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮, হিন্দুত্ববাদীদের খুব প্রিয় তারিখ, নাথুরাম গডসে যেদিন হত্যা করলেন মহাত্মা গান্ধীকে। সেই দিন এবং গান্ধীর শেষ উক্তি উল্লেখ করার পরই ঋত্বিক উদ্ধৃত করেন মহাভারতের মুষলপর্ব। তিনি মৃত্যুমুহূর্তে বলেছিলেন - "হে রাম"।
২০১৯-এ যতবার "জয় শ্রীরাম" বলা হবে জেএনইউ, আলিগড়, জামিয়া, যাদবপুরের ছাত্ররা ততবার যদি "হে রাম" বলে - কেমন লাগবে? "জয় শ্রীরাম"-এর কাউন্টার-স্লোগান বলা যায়, এই "হে রাম" ছবিতে দুবার উচ্চারিত হয়। গান্ধী হত্যার পর, অভিরামের বিধবা স্ত্রী সীতার আত্মহত্যার পর। সীতা কেন আত্মহত্যা করেছিল? কারণ তার ঘরে ঈশ্বরের প্রবেশ তার আত্মপরিচয়কে অস্বীকার করছিল বলে, বা নতুন পরিচয়ের অপমান আরোপ করবে বলে। যেভাবে আজ দেশের বহু মানুষের করা হচ্ছে, হবে।
ঋত্বিক ঘটক হিন্দু উদ্বাস্তুদের বাবা-বাছা করেননি, অভিযুক্ত করেছেন। অভিযুক্ত করেছেন বিস্মৃতির অভ্যেসের, মিথ্যে আখ্যান গড়ে তোলার, মিথ্যে জাতীয়তাবাদে শরণ নেওয়ার, বিভেদের রাজনীতির প্রতি উদাসীন থাকার, পুনরায় নীতা, বাগদি বউ, অভিরাম, সীতাদের নতুন বাড়ির স্বপ্ন থেকে চ্যুত করার, ক্ষমতাবান এবং সংখ্যাগুরুর মতে-মতাদর্শে মজে থাকার অভিযোগে। পার্টিশন কেন হয়েছিল তা নিয়ে উনি বলেছেন কম, বলেছেন পার্টিশনের পর অন্যায়ের ইতিহাসে আমাদের ভূমিকা কী তাই নিয়ে। সেখানে ছাড় পাননি হিন্দু শরণার্থীরাও। সেই হিন্দুরা যদি নাগরিকত্ব হরণ করে দেশের ভিতরেই নতুন উদ্বাস্তু তৈরির খেলায় আবার মজেন - ছাড় পাবেন না তাঁরাও।
ডিজিটাল প্রযুক্তি সহজলভ্য; মন্তাজ করা যায় নানাবিধ। আমি একটি ক্ষুদ্র, দুটি শটের ছবির চিত্রনাট্য দিয়ে শেষ করছি এই লেখা -
দৃশ্য ১ -
ঋত্বিক ঘটকের 'কোমল গান্ধার'-এর একটি শট। ঋষি (অনিল চট্টোপাধ্যায়) বলছে - "এই হয়! লিডারস অফ মেন - প্রায় সবসময়ে রুক্ষ আর দাম্ভিক হয়, নিজেদের সম্বন্ধে বেশি রোয়াবি নেয়, ওদের শ্রদ্ধা করা উচিত এবং ফ্রম টাইম টু টাইম লাথি মারা উচিত!”
কাট টু
গত ২৫শে নভেম্বর করিমপুরে এক বিজেপি নেতা পদাঘাত প্রাপ্ত হয়ে ঝোপে পড়ে যাচ্ছেন।
ঋত্বিকীয় সিনেমা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু বদ উদ্দেশ্যের ভিডিও এরকমও হতে পারে।
(অনিন্দ্য সেনগুপ্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)