ভারতের নাগরিকত্ব এখন নয়া প্রমাণ সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে দুর্দশায় পড়ছেন মেয়েরা, তার কারণ যেসব নথি দাবি করা হচ্ছে, তার প্রায় সবগুলিই সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েদের অধরা। মনে রাখতে হবে এই মেয়েরা বেশিরভাগই দরিদ্র এবং শিক্ষাহীন। নাহলে আলোকপ্রাপ্ত এবং শহুরে মহিলাদের মধ্যে আমরা যারা এই দুর্দিনেও উচ্চমার্গের রন্ধনপ্রণালী এবং সেলফি নিয়ে ব্যস্ত থাকা শ্রেয় মনে করছি তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই লেখাটাকে স্রেফ বকোয়াস মনে হবে। তবে আসামের ক্ষেত্রে ১৯৭১ কে ভিত্তিবর্ষ ধরা হলেও গোটা দেশের ক্ষেত্রে তার দিন এখনও অঘোষিত। অর্থাৎ সবাইকে প্রমাণ করতে হবে তিনি নিজে অথবা তাঁর পূর্বপুরুষ ওই অঘোষিত সময়ের আগে থেকে এ দেশের বাসিন্দা।
ফলে জাল এবার অনেক বেশি বিস্তৃত এবং অনেক বেশি মাছ ধরা পড়বে এরকম ধরেই নেওয়া যায়। নিশ্চিন্ত থাকবার সুযোগ কিন্তু ক্রমশ কমে আসছে।
জামিয়া মিলিয়ার অশান্ত রাত, এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে
নাগরিকত্ব সংকট যে মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক দুর্দশা বহুগুণ বাড়ায় তার প্রমাণ আসাম। একজন বয়স্ক পঙ্গু চলচ্ছক্তিহীন মহিলাকে দুজন পুলিশ টেনেহিঁচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে এই ভিডিও আমরা দেখেছি। শুনেছি তাঁর মরণান্তিক আর্তনাদ। গরাদের ওপারে ফ্যাকাশে রোগা মুখের সারির ছবি আমরা দেখেছি। প্রচুর খেসারত দিয়ে ক্যাম্প থেকে ফেরার পর কেমন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সন্তানের জননীর মুখ, তারও প্রচুর ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্তর্জালে। প্রমাণ যাচাইয়ের জন্য যে অজস্র সেবাকেন্দ্র খোলা হয়েছিল সেগুলোর দুটির মধ্যে দূরত্ব হয়ত কয়েকশ কিলোমিটার। একটিতে ডাক পড়ল তাঁর স্বামীর, অন্যটিতে স্ত্রীর। যে মহিলা একা কখনো ঘরের বাইরে যাননি, তাঁকে সেবাকেন্দ্রে পৌঁছে হাজার লোকের লাইনে বাচ্চা কোলে দাঁড়াতে হবে, আবার অন্ধকার নামার আগে কাজ সেরে ঘরে ফিরতে হবে। তাঁকে সাহায্য করবার নেই। কে নেবে ওই মায়ের এবং এই মেয়েদের শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার দায়ভার ?
এটা মেনে নেওয়া ভালো, সরকার যে যে মথিপত্র চেয়েছে তার বেশিরভাগই উপমহাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের থাকে না। মেয়েদের নামে কি সম্পত্তি কেনা হয়? ছেলের বৌ বা বিবাহিত মেয়ের নামে শ্বশুর বা বাবা সম্পত্তি লিখে দিচ্ছেন, এঘটনা আজও শহরে ও গ্রামে ডুমুরের ফুল। অথচ স্বামীর পরিচয়ে এনআরসি-তে কিছু হবার নয়। পিতা এবং তাঁর দিক থেকে যোগাড় করা প্রমাণই প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হবে( patrilineal legacy)। কী আয়রনি! নারীমুক্তি যতোই পিতৃতান্ত্রিক ফাঁসের বাইরে মেয়েদের স্বতন্ত্র সমানাধিকারী মানুষ হিসেবে দেখবার কথা বলে, ততোই যেন তা এঁটে বসানোর ব্যবস্থা করা হয় তড়িঘড়ি।
ঠাকুরদার নাম সবার মনে থাকে। কিন্তু প্রপিতামহ বা অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহদের নাম জানে এমন ক'জন আছে? তাহলে বংশলতিকা (ফ্যামিলি ট্রি) চাইলে আমরা কী দেব? আর বংশলতিকা তো একার কোনো ব্যাপার নয়। পরিবারের কর্তার সঙ্গে সবাই সম্বন্ধযুক্ত এটা প্রমাণের জন্য সকলকে পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে একই রকম তথ্য সইসাবুদ ক'রে দিতে হবে, কিন্তু মেয়েদের জন্য সেখানেও গ্যাঁড়াকল। কোন বিবাহিত মেয়ে বংশলতিকায় নিজের নাম ঢোকাবার অনুরোধ করলে পিতা এবং ভ্রাতাদের সন্দেহ হচ্ছে যে মেয়েটি সম্পত্তির দাবিদার হয়ে উঠবে এরপরে। যদি বাবা স্বয়ং এই ভয়ে নাম না ঢোকায় তাহলে মেয়ের রাষ্ট্রহীন হওয়া আটকাবে কে? পিতৃ-মাতৃহীন মেয়েদের অবস্থা তাহলে কেমন হতে পারে? দূরের আত্মীয়রা তাকে স্বীকার করবে? অনেকদিন ধরে একা আছে এইরকম মেয়েরাও নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হাবুডুবু খাবে।
নয়া নাগরিকত্ব বনাম জুতা হ্যায় জাপানি, পাৎলুন ইংলিশস্তানি
বিয়ে হলেই বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের হক থাকেনা, যদি তার কোনও ভাই থাকে। আইনত থাকে, কিন্তু মা বাবা মৃত্যুর সময় ছেলেকেই সব দিয়ে যান, এইরকমই বেশি ঘটে। আবার বোনেরা ইচ্ছে করেও নিজের হক ছেড়ে দেয় এমন হামেশাই ঘটে। যেন লেখাপড়া শিখিয়ে বা নামমাত্র শিখিয়ে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করাই পৈত্রিক কর্তব্যের শেষ কথা। তারপর আবার সম্পত্তির দাবী খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, এমনই ভাবনা ভাবে বেশির ভাগ মেয়ে, কারণ পিতৃতন্ত্র তার মগজ ধোলাই ক'রেই রেখেছে। ভালোবাসার আবেগও মেয়েদের বেশি। কিন্তু এমনও ঘটনা আছে যে তার অতি আদরের সহোদর এনআরসি-তে বোনের নাম যাতে না আসে সেই বদ মতলবে প্রয়াত বাবার চাকরি বা জমির মালিকানাসংক্রান্ত কোন কাগজ দিতে অস্বীকার করেছে। যেন বাবার মেয়ে ব'লে তার সহোদরা কোনো প্রমাণ যোগাড় করতে না পারে। পারিবারিক কারণে ষড়যন্ত্র ক'রে নারীকে পরিচিতিহীন বানানোর এই খেলা কিন্তু এনার্সির আড়ালে চলছে। দরিদ্র, সহায়হীন নারীর ক্ষেত্রে তা খেটেও যাচ্ছে।
পুরনো প্রজন্মগুলিতে বার্থসার্টিফিকেট কারোরই ছিল না। রেওয়াজই ছিল না। স্কুলে ভর্তি হবার সময় কেউ চাইতোও না। ফলে গার্জিয়ানদের ইচ্ছে এবং সুবিধেমতো শিশুর বয়স বাড়তো কমতো। স্কুল কর্তৃপক্ষের দেওয়া অ্যাডমিট কার্ড আসামে বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে গ্রাহ্য হয়েছে কি হয়নি জানিনা, কিন্তু হলেও ক'টা মেয়ে স্কুলের শেষ ধাপের পরীক্ষা পেরোতে পারে যে তার এডমিট কার্ড থাকবে? স্কুলে যাবার সুযোগ পায় ক'জন? কন্যাশ্রী, রূপশ্রীতেও অভিভাবকদের গৌরীদানের ইচ্ছায় রাশ টানা যায় না। তাহলে নিজের জন্মসাল নারী প্রমাণ করবে কী দিয়ে?
এতোদিন ভারতীয় সমাজে বিবাহিত নারীর সামাজিক, আইনি পরিচয় ছিল পতিনির্ভর। এমনকি ব্যাঙ্কের পাসবইতে স্বামীর নাম থাকে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হোটেলে একা ঘর বুক করতে হলে সচিত্র পরিচয়পত্রের সঙ্গে সঙ্গে স্বামীর নামোল্লেখ বেশিরভাগ জায়গাতে জরুরি। এবার এনআরসি নারীকে করতে চাইলো পিতানির্ভর। আর সেই পিতার কন্যা বলে নিজেকে প্রমাণ করবার দায়িত্বও পুরোপুরি ঠেলে দিল নারীর কাঁধে। তার নিজস্ব পরিচয় যেন কখনো না হয় যে সে একজন শিক্ষিকা, বা সমাজকর্মী বা সিঙ্গল মাদার, অথবা শুধু একজন মানুষ, সে বন্দোবস্ত রাষ্ট্রের সবসময়ই পাকা।
মায়ের পরিচয় এনআরসি-তে গ্রাহ্য হয় না। নাগরিকত্ব প্রমাণে মায়ের কোনো ভূমিকা নেই। তাহলে বহুদিন আগে যে পিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বা যে পিতা সন্তানকে ছেড়ে স্রেফ চলে গেছে, তার পরিচয়ে পরিচিত হবার জন্য প্রায় অচেনা মানুষটিকে আবার জীবনের বৃত্তে নিয়ে আসতে হবে নাকি!
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন
আসামে যে মেয়েরা না জেনে শ্বশুরঘরের লিগ্যাসি দেখিয়েছিলেন তাঁদের একজনের নামও এনআরসি-তে ওঠেনি। এবং এই লিগ্যাসি ব্যাপারটি অপরিবর্তনীয়। এমনকি ভুল হয়েছে বলে সংশোধনও করা যাবেনা। এবার বোঝা যাচ্ছে কেন বিদেশি বলে ঘোষিতদের মধ্যে এতজন মহিলা? যদি কোন সরকারি অফিসারের ভুলে এক নামের অন্য কারো সঙ্গে কোনো মহিলাকে জুড়ে দেওয়া হয় তাহলে ফ্রোজেন লিগ্যাসি আর কখনোই পালটানো যাবে না। আসামের উদাহরণই দিই। ১৯৫৩ সালে জন্মানো এক মহিলার বাবার নাম রামিজুদ্দিন। বাবা সবার ক্ষেত্রেই লিগ্যাসি পার্সন। অথচ এই মহিলার ভাইবোনেদের সবার নাম লিস্টে উঠলেও এর নাম ওঠেনি, কারণ তার বাবার নাম লিগ্যাসি ডাটায় লিখতে একটু ভুল হয়েছিল। রামিজুদ্দিনের জায়গায় লেখা হয়েছিল রামিজনুদ্দিন। এখন ঐ গ্রামে সত্যি সত্যিই আর একজন রামিজনুদ্দিন বাস করে যার বৈধ কাগজপত্র নেই। অন্যের ভুলে এই নিরক্ষর মহিলা রামিজনুদ্দিনের মেয়ের পরিচয় নিয়ে বাদবাকি জীবন ডিটেনশন ক্যাম্পে বাঁচতে বাধ্য হবে, কারণ লিগ্যাসি ডেটা অপরিবর্তনীয়।
এইভাবে শিবঠাকুরের আপন দেশে সর্বনেশে আইনের পাল্লায় পড়ে কতো জীবন ছারখার হয়ে যাচ্ছে তার ঠিকঠিকানা নেই।
ট্রান্সজেন্ডারদের কথা আমরা ভেবে দেখেছি? নতুন নাম, নতুন পরিচয় নিয়ে পরিবারচ্যুত হতে হলেও তারা বাঁচবে ঠিক করেছিল। এনআরসি-তে তাদের হাল কী হবে? কিম্বা সেই মেয়েটির যে অন্যধর্মে বিয়ে করবার কারণে পরিজনদের দ্বারা পরিত্যক্ত? যাকে বলা হয়েছে, মনে করব তুই মরে গেছিস ! পরিচয়ের জন্য পুরোনো দরজায় কড়া নাড়লে সে কি নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে?
অনেকেই বুঝতে পারছেন না কী পিতৃতান্ত্রিক এই এনআরসি। কারণ রাষ্ট্র জানে কী ভাবে নজর ঘোরাতে হয়। আজ সুপ্রিম কোর্ট নির্ভয়ার অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড রদের আবেদন খারিজ করেছে। গুটিকয়েক পাপিষ্ঠকে এনকাউন্টারে খতম ক'রে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেকে নারীদরদী প্রমাণ করতে চাওয়া এই সরকারের তৈরি করা নাগপাশে হাঁসফাঁস করছে কতো মেয়ে! ডিটেনশন ক্যাম্পে তাকে লাগাতার লড়াই করতে হচ্ছে ক্ষুধা, একাকিত্ব, সামাজিক লজ্জা, নিজের জনদের হারাবার যন্ত্রণা এবং শ্লীলতাহানির ভয়ের বিরুদ্ধে। এই কালা কানুনের বিরুদ্ধে তাই মেয়েদেরই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত।