দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের রাজ্যসভায় উপস্থিতি যে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাঁর অভিজ্ঞতা ও বীক্ষা এবং উচ্চ বিচারবিভাগের যেখান থেকে তিনি এসেছেন, তাতে তাঁর কাজকর্ম চমৎকার হয়ে উঠতে পারে। তা সত্ত্বেও এটা সর্বৈব সত্য যে বিচারপতি গগৈ একদিন ধরে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এসেছেন, তাতে অন্ধকার ছায়াও পড়ল। এবং কোনওরকম ভাবেই এ বাস্তবতা এড়ানো যাবে না। হ্যাঁ, এটা ঘটনা যে বিচারপতি গগৈ এই প্রথম সরকারের কাছ থেকে অবসরের পর এ সুবিধা পাচ্ছেন না, যা সন্দেহজনক, এবং তিনি প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ সুবিধে পাচ্ছেন, এমনটাও নয়। ১৯৯১ সালে বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্র অবসর গ্রহণের কয়েক বছর পর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, কংগ্রেসের টিকিটে রাজ্যসভাতেও গিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে বম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন এবং নেহরুর আমলে ব্রিটেনে ভারতের হাই কমিশনার হয়েছিলেন।
প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময়ে মোদী সরকার আরেক প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি শতশিবমকে কেরালার রাজ্যপাল করেছিল। আরও উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু বিচারপতি মদন বি লোকুর যখন প্রশ্ন তোলেন আজ শেষ দুর্গটিরও পতন হল কিনা, তা বিশেষ অনুরণন তোলে বৈকি। নিজের প্রাথমিক মন্তব্যে বিচারপতি গগৈ বলেছেন কোনও কোনও সময় আসে যখন বিচারবিভাগ ও আইনসভাকে দেশ গঠনের জন্য একযোগে কাজ করতে হয়। যিনি অনেকের চেয়ে বেশি বোঝেন, এমন কারও কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য এলে তা অধিকতর সমস্যাজনক হয়ে ওঠে। তার কারণ সময়কাল। বিচারপতি গগৈ মাত্র চারমাস হল অবসর নিয়েছেন এবং তিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন বিচারবিভাগের স্বাধীনতা বিপজ্জনক বাঁক নিয়েছে। এমন একটা সময়ে, যখন বিশাল জনসমর্থনকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক কাজ চলছে, সে সময়ে সরকারের অফার ও বিচারপতি গগৈয়ের তা স্বীকার করে নেওয়া একটা ধাক্কা এবং একটা কলঙ্কও বটে।
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের আদালত পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে চারজন বরিষ্ঠ বিচারপত সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন, বিচারপতি গগৈ তাঁদের অন্যতম। বিচারবিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম উপজীব্য যে বিচার প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে রক্ষা করা ও তাকে শক্তিশালী করা, সে নিয়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তৃতীয় রামনাথ গোয়েঙ্কা স্মারক ভাষণে তিনি ক্ষমতার কাছে সত্যকথনের স্বাধীনতা নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন বিচারবিভাগের কলঙ্কহীন, স্বাধীন, প্রচণ্ড হয়ে উঠবার কথাও। তিনি বলেছিলেন প্রয়োজন হল স্বাধীন সাংবাদিক ও কখনও কখনও শোরগোল তোলা বিচারপতিদের প্রয়োজনীয়তার কথাও।
সরকার যেখানে পক্ষ ছিল, সেই আসাম এনআরসি, শবরীমালা, অযোধ্যা, রাফাল, সিবিআই, এতগুলি মামলা তাঁর নেতৃ্ত্বে মীমাংসিত হবার পর, এত দ্রুত তিনি রাজ্যসভার মনোনয়ন গ্রহণ করায় গুরুতর প্রশ্ন উঠে এল। সে প্রশ্ন শুধু তাঁকে নিয়েই নয়, ক্ষমতা থেকে প্রতিষ্ঠানের কাজকর্মকে পৃথক করা নিয়েও। বিচারবিভাগের বিশ্বাসযোগ্যতা কেবল ন্যায়বিচার দেওয়ার উপরেই নির্ভর করে না, তাকে কেমন দেখতে লাগছে, তার উপরেও নির্ভর করে। অবশ্যই সুপ্রিম কোর্ট একজন বিচারপতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু সরকারকে সম্মতি দিয়ে বিচারপতি গগৈ প্রতিষ্ঠান ও তার ভাবমূর্তিকে আহত করার ব্যাপারে দোষের ভাগী হলেন।