Advertisment

গণতন্ত্রের স্বার্থে এবার দ্রুত ঘর গোছাক কংগ্রেস

শাসক গণতন্ত্রী থেকে একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠে যদি বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর দুর্বল হয়ে যায়। এই যে ট্রাম্প থেকে পুটিন, অধুনা লন্ডনেও এক নতুন ধরনের দক্ষিণপন্থী পপুলিজম গড়ে উঠেছে, অনেকেই বলছেন এর পিছনেও এক মস্ত বড় কারণ হল দুর্বল বিরোধী শিবির।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Rahul gandhi, Priyanka Gandhi, রাহুল গান্ধী

রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা। এক্সপ্রেস ফাইল ফটো: রেণুকা পুরি।

গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা সবসময়ই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শাসক এবং বিরোধী এই ডায়ালেটিকস - এক ধরনের ভারসাম্য। শাসক গণতন্ত্রী থেকে একনায়কতন্ত্রী হয়ে ওঠে যদি বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর দুর্বল হয়ে যায়। এই যে ট্রাম্প থেকে পুটিন, অধুনা লন্ডনেও এক নতুন ধরনের দক্ষিণপন্থী পপুলিজম গড়ে উঠেছে, অনেকেই বলছেন এর পিছনেও এক মস্ত বড় কারণ হল দুর্বল বিরোধী শিবির।

Advertisment

ভারতে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর এই বিপুল জয়ের পর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কান্ডারী রাহুল গান্ধীর কী খবর? কংগ্রেসের অবস্থা কী? গান্ধী পরিবারের কী হাল? মনে হচ্ছে অতিসক্রিয় নরেন্দ্র মোদীর কার্যকলাপ নিয়মিত ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি প্রয়োজন রাহুল গান্ধীরও খবর নেওয়া। তুঘলক লেনে তাঁর নিবাসে ফোন করে কিছুদিন আগে শুনলাম, তিনি বিদেশে। খুব শীঘ্রই ফিরবেন। দিল্লির এই ভয়াবহ গ্রীষ্মে বহু নেতাই বেশ কিছুদিনের জন্য বিদেশে যান। এ তো নতুন কিছু নয়। তবে যেহেতু এই গ্রীষ্মেই বাজেট অধিবেশন চলে, এবার ২৪ জুলাই পর্যন্ত চলবে। তাই রাজনেতাদের এই প্রবল দাবদাহেও অনেকটা সময় দিল্লিতে থাকতেও হচ্ছে। রাহুলও থাকছেন।

আরও পড়ুন- এই বাজেটে মোদীর লক্ষ্য আমজনতা, সংস্কার নয়

কিন্তু রাহুল ইস্তফা দিয়েছেন। পরাজয়ের দায়িত্ব নিয়ে তিনি পদ ছেড়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, কথার কথা নয়। নিছক নাটক নয়। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। লোকসভার প্রেস গ্যালারি থেকে আজকাল কংগ্রেস বেঞ্চের দিকে তাকালেই আপনার মনে হবে, সত্যি কী করুণ অবস্থা এই শতাব্দী-প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির। অ্যালান অকটেভিয়ান হিউম থেকে সুরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে গড়া ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস - আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

প্রথম থেকেই রাহুল গান্ধী সম্পর্কে আমার ধারণা হয়েছে, যে তিনি মানুষটি বড় ভাল; একান্ত আড্ডাতেও ব্যক্তি রাহুল বেশ মজার; কিন্তু ভারতের মত জটিল এবং বিশাল দেশের রাজনীতির পরিচালক হওয়ার কাজটি সম্ভবত তাঁর নয়। জয়পুরে কংগ্রেসের অধিবেশনে যেভাবে তাঁর নাম উপ-সভাপতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তাও দেখেছিলাম আমি। সেদিন আমি নিজে ছিলাম জয়পুরে। এই ঘোষণার সময়ও মনে হয়েছিল, রাহুল নিজে এই দায়িত্ব পেয়ে খুব উত্তেজিত, যাকে ইংরাজিতে বলে 'এক্সসাইটেড', এমন নয়। বরাবরই রাহুল যেন এক 'রিলাকট্যান্ট' রাজনীতিবিদ।

আরও পড়ুন- মোদী বনাম ট্রাম্প, না মোদীর পাশে ট্রাম্প?

রাহুল ইস্তফা দেওয়ার পর সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসের অবস্থা আরও শোচনীয়। কার্যত কংগ্রেস এখন অভিভাবকহীন। রাজ্যনেতারা এবং সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অন্য সাংগঠনিক নেতারা ইস্তফা দিলেও তাঁদের ইস্তফাপত্র গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ এই ইস্তফাপত্র গ্রহণ করবে কে? দলের সর্বভারতীয় সভাপতি নিজেই তো ইস্তফা দিয়ে বসে আছেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সেই ইস্তফা গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু রাহুল নিজে টুইট করে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি এখন আর সভাপতি নেই।

মোদী এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব ভোটের সময় এবং তারপরেও বারবার বলে চলেছেন, কংগ্রেস পরিবারবাদে আক্রান্ত। তাই নেহরু থেকে রাহুল, এই নামজাদারাই দেশ চালাচ্ছেন, কিন্তু ভারতের মানুষ এই পরিবারবাদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন- নেহরুবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন রণকৌশল মোদীর

এবার বিষয়টা কংগ্রেসের সাংগঠনিক দিক থেকে দেখুন। যতই গাল দিন পরিবারবাদকে, কংগ্রেস আবার এই পরিবারবাদকে বাদ দিলে টিকে থাকতে পারবে কিনা জানি না। রাজস্থানে অশোক গেহলট ও শচীন পাইলটের বিবাদ, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস নেতা মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথের সঙ্গে জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার বিবাদ। প্রবীণ বনাম নবীন বিবাদ। কত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কিন্তু রাহুল গান্ধী বা গান্ধী পরিবারের কোনও প্রতিনিধি যদি শেষ কথাটা বলে দেন, তবে সেটাই মেনে নেবেন সব নেতারা। কাজেই দল চালনার জন্য গান্ধী পরিবার এক অসাধারণ 'সিমেন্টিং ফ্যাক্টর'।

আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম, যখন রাজীব গান্ধীর হত্যা হলো, তখন বহু নেতাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যান। অর্জুন সিংহ, শরদ পাওয়ার, করুণাকরণ, নরসিংহ রাও প্রমুখ আরও অনেক নেতা। কিন্তু কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তড়িঘড়ি বসে প্রথম কোন কাজটা করে দিল? সোনিয়া গান্ধীকেই পরবর্তী নেতা হওয়ার জন্য সর্বসম্মতভাবে অনুরোধ করা।

আরও পড়ুন- চিকিৎসার চেয়েও বড় সমস্যা যখন রাজনীতি

সোনিয়া কিন্তু সবিনয়ে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর 'না' বলার মধ্যেও কোনো ধূসরতা ছিল না। যাকে বলা যায় 'positive no'. আবার সোনিয়ার পর কে হবেন? রাও যে প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার পিছনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের তুখোড় বুদ্ধি এবং কামরাজ প্ল্যানের মত একজোট হয়ে তাঁর নাম সামনে নিয়ে আসা যেমন একটা বড় ব্যাপার ছিল, ঠিক তেমনই বড় বিষয় হলো, সোনিয়া গান্ধীর কাছে গিয়ে যখন শীর্ষ কংগ্রেস নেতা রাওয়ের নামটা বললেন, তিনি রাজি হলেন। সেদিন যদি শুরুতেই সোনিয়া 'ভিটো' দিতেন, রাও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না।

আবার সেই নরসিংহ রাও যখন সোনিয়ার বিরুদ্ধেই বোফর্স তদন্তকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন বলে অভিযোগ উঠল, বা রাজীব হত্যার তদন্তে ঢিলেমি হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠল, তখন সেই সোনিয়াই আমেঠীতে গিয়ে জনসভা করে রাও-বিরোধী রাজনীতি শুরু করলেন। সেদিনও আমি আমেঠীতে ছিলাম। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সেই বিকেলে। বৃষ্টিভেজা রোদ্দুরে প্রিয়াঙ্কাকে পাশে নিয়ে সোনিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেন। সীতারাম কেশরী কংগ্রেস সভাপতি হন, কিন্তু তাঁকে সরিয়ে সোনিয়া গান্ধী কত সহজে সাংগঠনিক ক্ষমতা দখল করলেন, তাও তো আমরা দেখেছি। সেটাও তো সম্ভব হয়েছিল গান্ধী নামক ব্র্যান্ডের জন্য।

আরও পড়ুন- বাঙালির ‘বিজেপি প্রীতি’ কতদূর যাবে?

প্রয়াত বিজেপি নেতা প্রমোদ মহাজন একদা আমাকে বলেছিলেন, "কংগ্রেসের একটা মস্ত বড় সুবিধে হলো , ওখানে একজন নেতা তথা একটি পরিবারই সব সিদ্ধান্ত নেয়। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণটা সহজ হয় ওদের। আমাদের দলে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় চার-পাঁচজন মিলে। আডবাণী, যশবন্ত সিংহ, যশোবন্ত সিনহা, মুরলি মনোহর যোশী, আরও কেউ কেউ। আরএসএস অথবা ব্রজেশ মিশ্রর মত চরিত্রের কথা তো ছেড়েই দিলাম। কাজেই কংগ্রেসে এটা স্বৈরতন্ত্র বলতে পারেন, কিন্তু কাজের জন্য সুবিধে।" বিজেপিতে এটা হল অলিগার্কি (oligarchy), বাংলায় বলা যেতে পারে 'অভিজাততন্ত্র'।

আজ এতদিন পর কংগ্রেসের এই পরিস্থিতি দেখে আবার প্রমোদ মহাজনের কথা মনে পড়ছে। কী অবস্থা এই দলটির। রাজ্যে রাজ্যে শতছিন্ন। ঝাড়খন্ড, হরিয়ানা, দিল্লি, মহারাষ্ট্রর বিধানসভা আসন্ন। এসব রাজ্যগুলিতেও কংগ্রেস ভালো ফল করবে তার সম্ভাবনা কম। উল্টে রাহুল যদি কংগ্রেস সভাপতি হন, তবে আবার তাঁকে পরাজয়ের দায়িত্ব নিতে হবে।

কাজেই এক চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে আজ কংগ্রেস। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী এই পরিস্থিতিতে হাল ধরবেন, নাকি প্রবীণ কোনও নেতা আপাতত ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট হবেন? নাকি কোনও নবীন নেতাকে পুরোপুরি সভাপতি করে দেওয়া হবে? নাকি শেষ পর্যন্ত রাহুল গান্ধীরই প্রত্যাবর্তন হবে? ২৪ আকবর রোডই হোক বা সংসদের সেন্ট্রাল হল, আপাতত কংগ্রেসের সভাপতি নিয়েই চলছে গবেষণা। আমি মনে করি, গণতন্ত্রের স্বার্থে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত রাহুল গান্ধীর।

rahul gandhi sonia gandhi Priyanka Gandhi
Advertisment