সত্য যে কল্পনার থেকেও অনেক বেশি অবাক করে দেওয়ার মত ঘটনা আমাদের সামনে নিয়ে আসে তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। তিন সপ্তাহের পর আরও দুই। একটানা পাঁচ সপ্তাহ প্রতিদিনই যেন সর্বদলীয় ভারত বন্ধ। শুধু ভারত কেন, সারা বিশ্বের বিভিন্ন জনপদই এখন শুনসান। এই ঘটমান বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি তাই একেবারে অভূতপূর্ব। আমরা সকলেই খুব বিপদের মধ্যে সে নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। তবে জীবদ্দশায় যে এরকম একটা বিষয় প্রত্যক্ষ করা গেল, তাই বা কম কিসের? এই অদ্ভুত অবস্থায় মূল দ্বন্দ্ব জীবন ও জীবিকার। মানুষ কাছাকাছি এলে, ভিড়ে হুড়োহুড়ি করলে, একই বন্ধ ঘরে কাজ করলে, ভীষণ বিপদ। একজন কোভিড আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে সংক্রমিত হতে পারেন আরও বহু মানুষ। ফলে সমস্যা এখানে অসুখের প্রকোপ থেকে বাঁচার।
আর অন্যদিকে সমাজ নামক বিমূর্ত বিষয়টি আসলে ভীষণভাবে বাস্তব। সেখানে আমরা একসঙ্গে কাজ করি, আর তার থেকে সংগ্রহ করি আমাদের জীবিকার রসদ। অবশ্যই সারা বিশ্বে সাম্যবাদ চলে না, কেউ কম পাই কেউ বেশি। কেউ সুবিধাভোগী, আর কেউ অসুবিধায় থেকে অন্যকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যে জীবনপাত করেন। আর এইভাবেই জগৎ চলে। বিশ্বে বৈষম্য আছে চিরকালই। বরং আজকের দিনে বিষয়টা অন্যরকম। করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের কথা ভাবা হচ্ছে অনেক বেশি করে। কারণ নাহলে তাঁরা অভুক্ত অবস্থায় মারা যাবেন। বিশেষ করে আমাদের দেশে তো বটেই। তা সত্ত্বেও থালা বাজানো, প্রদীপ জ্বালানো, রাস্তায় এক মিটার দূরত্বে চক দিয়ে গোল আঁকা, লকডাউনের দিনক্ষণ, এলাকা পুরোপুরি সিল করে দেওয়া হবে কিনা, সত্যিকারের সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা, ইত্যাদি নিয়ে তর্ক বিতর্ক থাকবেই। রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নিজের এবং দলের ভবিষ্যতের দিকটা দেখতে হয়, ফলে কিছুটা কৃতিত্ব তাঁরা দাবি করবেনই। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার একটা দায় তাঁদের থাকে। ফলে থালা, প্রদীপ, চক, পরিসংখ্যান তাই বেশিরভাগটাই প্রতীকী।
একেবারে সোজা পথে লকডাউন চলবে, সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ পাবে আকাশপাতায় আর প্রতিটি মানুষের কাছে খাবার এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্যে শপথ নেবেন শাসক, অঙ্ক এতটা সহজ নয়। তাই বিশ্বজুড়ে যখন করোনা বা কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, তখন শিব ঠাকুরের আপন রাজ্যে সেই অঙ্ক মাঝে মধ্যে কমার দিকেও যাচ্ছে। মানুষ যখন মরে তখন কোন একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়েই মরে। সেই সময় সে কীভাবে মরল তার জন্যে যদি তেত্রিশ দফা তালিকায় টিক মেরে প্রখ্যাত চিকিৎসকদের মেশিন লার্নিং করতে হয় সেক্ষেত্রে মরার আগে রোগীর (স্বেচ্ছায়?) উইল করে যাওয়া ভালো যে আর যাতেই অন্তর্জলী যাত্রা হোক, করোনায় নয়।
আমরা সমাজ সচেতন। তাই আত্মীয়স্বজন, বা সার্বিক সমাজের স্বার্থে এটাও বলে যাওয়া উচিৎ যে মৃত্যুর কারণ নির্বিশেষে যেন সৎকার করা হয় প্লাস্টিক মুড়ে। শিব ঠাকুরের রাজ্য থাকলে দেশও থাকবে। এটা বুঝতে হবে যে দেশের অর্থনীতি বিপদে পড়লে তো আর ঋণখেলাপী শিল্পপতিদের কাছ থেকে লক্ষ কোটি টাকা ফেরত চাওয়া যায় না। তাই সাধারণ মানুষের টাকাপয়সার দিকেই নজর পড়ে। এই মুহূর্তে দেশজুড়ে নিম্নবিত্ত মানুষদের অবস্থা একেবারেই কেরোসিন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের জন্যে ভাত-রুটি বন্দোবস্তের দায় সরকারের ঘাড়ে চেপেছে। সেই জায়গায় শুরুতেই কোপ পড়েছে মধ্যবিত্তের ঘাড়ে।
করোনা নিয়ে ধর্মের রাজনীতি করলে লোকসান আমাদেরই
এ দেশে খুব কম করে চার পাঁচ কোটি মধ্যবিত্ত পরিবার আছেন, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি কোটি মানুষ। সেখানে ব্যাঙ্কের সুদ, বিভিন্ন ভবিষ্যনিধি প্রকল্প ইত্যাদিতে বিপুলভাবে সুদ কমালে যে সরকারের চাপ কমবে সেই অঙ্ক শক্ত নয়। সঙ্গে আছে বিশ্ববাজারে ক্রমাগত দাম কমতে থাকা জ্বালানি। ব্যাস্তানুপাতের অদ্ভুত নিয়মে দেশের বাজারে পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ দেশের এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতেও নীতি নির্ধারণ এমন হতে হবে যাতে বন্ধুত্বপূর্ণ পুঁজিবাদে বেসরকারি এবং বৃহৎ শিল্পপতিদের কোন ক্ষতি না হয়।
তবে সীমিত রাজনীতির মধ্যে বিরাজ করেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দখলে থাকা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলো ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে যে সময় বদলেছে। একেবারে শুরুতে এগিয়ে এসেছিল কেরালা। পরিস্থিতি সামলাতে বিশ হাজার কোটি টাকার একটা হিসেব তারা করেছিল। দেশের মধ্যে করোনা আক্রান্ত প্রথম মানুষটিকে কেরালাতেই খুঁজে পাওয়া যায়, আর আজ পর্যন্ত এই রোগ প্রতিরোধে তাঁদের লড়াইটাই সবথেকে উজ্জীবিত। এই পরিস্থিতিতে শুধু সমালোচনা করলেই তো চলবে না। কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার চেষ্টা করছে নিম্নবিত্ত মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। চটজলদি লকডাউনের পর পরিযায়ী শ্রমিকদের যে বিপুল সমস্যা হয়েছিল, কেন্দ্র-রাজ্য হাত মিলিয়ে মোটামুটি তা সামলেছে। তবে আর্থিক প্যাকেজ অনেক ক্ষেত্রেই এখনও অপ্রতুল। দিন পনেরো আগেই আমরা লিখেছিলাম যে কেন্দ্রীয় সরকার ২৬শে মার্চ যে এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা মোটেই যথেষ্ট নয়।
করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা
আমাদের দেশের জিডিপি ২২৫ লক্ষ কোটি টাকার মত এবং এর প্রায় কুড়ি শতাংশ খরচ করা উচিৎ দেশের নিম্নবিত্ত মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। আমাদের সরল বক্তব্য ছিল এর জন্যে দরকারে টাকা ছাপালে ক্ষতি নেই। পরবর্তীকালে সদ্য নোবেলজয়ী বাঙালি বিজ্ঞানীও বুঝিয়ে বলেছেন সে কথা। আমেরিকা, জার্মানি থেকে শুরু করে একেবারে কাছের সিঙ্গাপুর, সকলেই কিন্তু দেশের জিডিপির প্রায় দশ থেকে কুড়ি শতাংশ অর্থ ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেছে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইতে মানুষ এবং অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি যাচ্ছে প্রচুর। বেকারত্বের শতাংশ আগের সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে।
কিন্তু সে দেশের অধিকাংশ করদাতা নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি ডলার ঢুকে যাওয়ার ঘোষণা হয়ে গেছে এর মধ্যেই। গতকাল বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে অন্তর্জাল বৈঠকে জনগণের বেঁচে থাকার ওপর জোর দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রীও। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজের। একইসঙ্গে তিনিও দাবি জানিয়েছেন যে দেশের জিডিপির অন্তত ছয় শতাংশ দেশকে এই চরম বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে ধার্য করতে। অর্থাৎ আলোচনা এগোচ্ছে ঠিক দিশাতেই। এর সঙ্গে লকডাউনের সময় সঠিক রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসাব্যবস্থাকে আগামী দিনের জন্যে সাজিয়ে তোলা গেলে হয়ত ভাইরাসের চরম ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে বদলাবে অনেক কিছুই। বিশেষ করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট নিয়ে খুব সন্দেহ নেই। বরং এই বিপদের দিনে দেশের সব মানুষ খেতে পেলে সত্যিই সমতার দিকে অনেকটা এগিয়ে যাবে আমাদের দেশ। দেশের খাদ্যভান্ডারে যথেষ্ট শস্য মজুত আছে। আর যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে লকডাউন শিথিল করে যদি চাষের কাজ মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া যায় তাহলে আগামী বছরটাতেও খাদ্যসুরক্ষা নিয়ে বিশেষ ভাবতে হবে না। বুঝতে হবে যে দেশের সব অঞ্চলই করোনা হটস্পট নয় আর কৃষিকাজের বেশিরভাগটাতেই গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে হয় না। অবশ্যই এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে প্রতিটি মাইলে পণ্য পরিবহণের সঠিক পরিকল্পনা। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র এবং রাজ্যকুল সেই দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না। ফলে কেতাবি অর্থনীতির চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও ভারতবর্ষ যে কোনক্রমে লড়ে যাবে এই আশা করাই যেতে পারে। আর এই প্রসঙ্গে সাবেকি পুঁজিবাদের প্রখর মস্তিষ্ক যে খুব ভালো কাজ করছে না তার একটা উদাহরণ দিয়ে এই লেখা শেষ করি।
নিজে কী খেলেন তার ছবি দিন, তবে অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেও ক্ষতি কী?
একটু ভাবুন আইপিএলের কথা। ক্রিকেটে তো আর ফুটবলের মত খেলোয়াড়দের কাছাকাছি আসতে হয় না। বিশেষ করে তাঁদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা চটজলদি এক দু সপ্তাহের মধ্যে করে নেওয়া যেতেই পারত। খেলার সঙ্গে যুক্ত সংগঠকদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। সুযোগমত কয়েকটা গাড়ি, কয়েকটা উড়োজাহাজ, আর কয়েকটি হোটেল যোগাড় করে রাখলেই দর্শকশূন্য মাঠে নির্বিঘ্নে আইপিএলের কুড়িকুড়ি চালিয়ে নেওয়া যেত। কোন ফ্যাতাড়ু এসে সেই খেলায় গোলমাল পাকাতো না। বরং দেশের মধ্যবিত্ত মানুষ সারাদিন করোনার পরিসংখ্যান মুখস্ত না করে ঘরে বসে বেশ কিছুটা সময় হইচই করে কাটাতে পারতেন। লকডাউনের বাজারে টেলেভিশনের ভিউয়ারশিপ যে কোন উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছত তা কল্পনার অতীত। অর্থাৎ ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না মোটেই।
বিষয়টা লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশের ক্রিকেট ব্যবসায়ীরা একবার ভেবে দেখবেন নাকি? করোনা পরিস্থিতিতে জীবন উত্তীর্ণ জীবিকার সন্ধানে কাঁধে কাঁধ না মিলিয়ে, মিটার খানেক দূরত্ব বজায় রেখে, শুরু হোক কৃষিকাজ আর আইপিএল।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন