করোনা প্যান্ডেমিক মোকাবিলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিন সপ্তাহ সময় চলে গেল। আমরা বেশ শঙ্কিত, কারণ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্থার (ICMR, JFU, BCG) ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। বি বি সি নিউজে অন্যদের মতই ভেলোরের সিএমসি-র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডক্টর টি জেকব জন বলছেন আগামী দু’মাসের মধ্যে এই সংকট এক ব্যাপক আকার নেবে,পরিস্থিতি খারাপ হবে।
তাঁর মতে করোনা মহামারী রোধে ভারতের পদক্ষেপ মূলত তথ্য ভিত্তিক এবং প্রতিক্রিয়াজাত, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল প্রজেকশন বা সুদূরপ্রসারী নীতি এবং আগে থেকে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
দু’একটা বিষয়ের ওপর আলোকপাত -
* তীব্র প্রচার চলছে ‘করোনা মোকাবিলার একমাত্র উপায় ঘরে থাকা’, ‘আপনি বাড়ি থাকলে দেশ করোনামুক্ত হবে’ ইত্যাদি, যা মানুষকে এক ছদ্মনিরাপত্তা দিচ্ছে। বস্তুত সেই কারণে ‘জীবন না জীবিকা’ এই চরম সন্ধিক্ষণে থেকেও ভারতবাসী সরকারকে মান্যতা দিচ্ছেন দাঁত চেপে লক ডাউনকে একবার নয় দুবার মেনে নিতে চলেছেন।
* ভারতে, লকডাউননামক আইনি প্রয়োগে কতটা কড়াকড়ি-বাড়াবাড়ি হল তার বিচারের ভার ইতিহাসের, তবে কাজটার মধ্যে যে তৎপরতা দেখা গেল তা উল্লেখ করতেই হবে। অন্যদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ‘চিহ্নিত করে আলাদা করো, পরীক্ষা করে চিকিৎসা করো’ কার্যকরী করার মেডিক্যাল মডেল নিয়ে চলছে অনন্ত গড়িমসি।
লক ডাউনের উপযোগিতা কি কাজে লাগছে?
প্রসংগত বলে রাখি লক ডাউন করোনা সমস্যার সমাধান নয়, এটা সমাধান খুঁজে বার করার খুব গুরুত্বপূর্ণ এক পদ্ধতি যার উদ্দেশ্য দুটো। ১) সংক্রমণের তীব্রতা (mitigation) কমানো, ২)ভাইরাস যাতে ধীরে ছড়ায় (flattening the viral curve) মানে এক সময়ে বহু মানুষের চিকিৎসার দরকার হবে না, ফলত স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা এড়ানো যাবে। অন্য সুবিধা হল লকডাউনের সময়টাতে সামাজিক – শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজটুকু করতে পারলে সংক্রমণ সংখ্যা ৫০% নামানো যায় এবং সংক্রমণকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে বেঁধে ফেলাও সম্ভব।
কোভিড ১৯ কীভাবে হামের টীকাকরণ কর্মসূচি ব্যাহত করছে?
বিশেষজ্ঞরা এই সময়টাকে বলছেন “Buying time”। এই স্বল্প সময়টুকুতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায় স্তরে অতিমারী প্রতিহত করতে খুব সঠিক এবং স্পষ্ট করে যে কাজগুলো করতে হয় তাহলো সন্দিগ্ধ আক্রান্তদের টেস্ট করে আলাদা করা ও চিকিৎসায় নিয়ে আসা এবং আশু সংকট মেটানোর মত স্বাস্থ্য পরিষেবার কাঠামো গড়ে তোলা।
প্রশ্ন হল, লোকজন তো ঘরবন্দি কিন্তু সংক্রামিত ব্যক্তি? যিনি প্রথমে পরিবার এবং পরে নিজের অজান্তে অন্যদের অসুখটা ছড়াবেন তাঁকে যদি টেস্ট করে আইসোলেট করা ও চিকিৎসা করা না হয়, তবে লাভ কি!
আর সেই কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যত বেশি সম্ভব টেস্ট করা যায় তার ওপর বারবার জোর দিয়েছে, তবুও ১৩০ কোটির ভারতবর্ষে এ পর্যন্ত মোট টেস্ট হয়েছে ২.৩১ লক্ষ (আ.বা.প ১৫.৪.২০২০)।
পাশাপাশি জানতে পারছি ৬.৫ কোটি মানুষের দেশ ব্রিটেন প্রতিদিন এক লক্ষ টেস্ট করছে এবং কেন সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষ হবে না তা নিয়ে চলছে বিতর্ক, ইতালি তার দেশের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে প্রতিজনের টেস্টের উদ্যোগ নিতে কোন ঢিলেমি দেখাচ্ছে না।
টেস্ট না করে সংক্রমণ সংখ্যা কম বলাটা যে যুক্তিগ্রাহ্য নয় তা ভারতবাসী ক্রমশ বুঝতে পারছেন এবং এই মুহূর্তে নিশ্চিন্ত নন। বিভ্রান্ত হয়ে মানুষ নিজের এলাকার গণ করোনা টেস্টিংয়ের দাবি তুলছেন। একটাই প্রশ্ন টেস্ট কবে হবে, কীভাবে হবে?
আমরা দেখছি সামনের সারিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা সংক্রামিত হচ্ছেন, এবং সংক্রামিতের সংস্পর্শে আসার দরুন তাঁদের দল বেঁধে পৃথকীকরণ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে।অবাক হচ্ছি এইকারণে যে আমরা আমেরিকা, ইউরোপে ওষুধ ও চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জাম পাঠাচ্ছি আর নিজের মানুষ গুলো বিপদের মুখোমুখি।
কোভিড ১৯ ও বায়ুদূষণের সম্পর্ক
কিন্তু কেন? প্রয়োজন অনুযায়ী টেস্টিং কিট, sanitiser, PPE, other medical / telemedicine equipments তৈরি করার মেধা ও প্রতিষ্ঠান কি আমাদের নেই? আমরা সবাই আজ জানতে চাই ISRO, IIT, NIIT, Phama house গুলোর বৈজ্ঞানিকদের বিশে।জ্ঞদের এই কাজে ডাক দেওয়া হয়েছে কিনা! মানুষের কল্যাণে এটাও তো এক অংশীদারিত্ব, আর সেই তাগিদকে বাড়াতে ঘোষণা করা হোক না স্বীকৃতি ও পুরস্কার! চলতে থাকুক তীব্র কিন্তু সুস্থ প্রতিযোগিতা যা কোটি কোটি ভারতবাসী দুহাত তুলে সমর্থন করবে। বৈজ্ঞানিকদের হাত ধরে বেরিয়ে আসুক গণ স্ক্রিনিং এবং ব্যক্তিগত স্ক্রিনিং এর সমস্ত সম্ভাবনা। এটা খুব অসম্ভব কিছু বলা হচ্ছে তা তো নয়, ঘরে বসে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা যদি করা যায়, buccal smear testing for HIV যদি সম্ভব হয়, তাহলে করোনা স্ক্রিনিং কেন নয়!
মানুষ জানতে চায় সমস্যা কোথায়? কিট/ ল্যাব /দক্ষ কর্মী/ না অন্য বিশেষ কোন কারণ? সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও গণ স্ক্রিনিংয়ে এই গড়িমসি কেন? দেরি হলে সংক্রমণ যে হাতের বাইরে চলে যাবে সেটা নতুন করে বলার বোধহয় অপেক্ষা রাখেনা।
কাজটা সহজ নয় ঠিক, তবে অসম্ভবও নয় - বিত্তশালীর হাত ধরে বিদেশ থেকে এলেও করোনার গতি এখন বিত্তহীনের দিকে, আর গ্রামগুলো হতে চলেছে তার ভরকেন্দ্র। ভারতীয় বৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসকদের অনুমান সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি করোনা তার সর্বোচ্চ রূপ নেবে এবং ৫৮% মানুষ এতে সংক্রামিত হবেন।
COVID-19 বিজ্ঞানের সহজপাঠ
সুতরাং গ্রাম/ অঞ্চলকে বাঁচাতে এবং সংক্রমণের তীব্রতা ও গতি রোধ করার অন্যতম পথ স্থানীয় প্রতিরোধ, দুঃখের বিষয় সুদূরপ্রসারী এই নীতি এবং আগে থেকে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই কাজটা এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। চিনের হুবেই প্রদেশে প্রত্যেক সংক্রামিত ব্যক্তিকে খুঁজে চিকিৎসার আওতায় আনতে এবং গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে তাঁরা যে শুধু ফোনের কালার কোড (traffic signal system) ব্যবহার করেছেন তা নয়, ১৮০০টা পাঁচ/ছয় জনের গ্রুপ লাগাতার কাজ করে সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙেছে, বিভিন্ন জায়গায় ভলান্টারি কোয়ারান্টিন খোলা, যথেচ্ছ টেস্টিং এবং স্থানীয় যুবসম্প্রদায়কে দিয়ে সেগুলো দক্ষতার সাথে পরিচালন করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। চিনের তৃণমূলস্তরের এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেরালা তার জনস্বাস্থ্যকে ঢেলে সাজিয়েছে পৌঁছে গেছে মানুষের কাছে। আমরাও কি পারি না সর্ব শক্তি নিয়ে এরকম একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে?
সম্প্রতি একজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকের সাক্ষাৎকারে জানতে পেরেছি দেশে ১০,০০০ ভাল ল্যাব আছে যেখানে অপেক্ষাকৃত কম খরচে এই টেস্ট হতে পারে। আমাদের মতে কাজটা সহজ তখনই হবে যদি স্থানীয়ভাবে মহল্লা ক্লিনিক ও পৃথকীকরণ কেন্দ্র থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রোটোকলকে মান্যতা দিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সেগুলো নির্দিষ্ট ল্যাবে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।এই ব্যবস্থায় মানুষের হয়রানি কমবে শুধু নয়, দূরদূরান্তে যাওয়া–আসা সংক্রান্ত সংস্পর্শ সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে।
নওলাখা-তেলতুম্বে: অন্যায় ও নির্মমতার আরেকটি উদাহরণ
পরিশেষে যে কথাটা বলা বাকি থাকে তা হল মানুষকে সংযুক্ত করা। মানুষ এগিয়ে এসে উপসর্গ তুলে ধরলে, সংক্রমণের ইতিহাস দিলে করোনা মহামারী রোধের কাজটা অবশ্যই অনেক সহজ হবে। সাধারণের মধ্যে ভরসা গড়ে তুলতে দরকার সংস্পর্শে থাকা ও লাগাতার বোঝানো, তবে কাজটা শুধু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মীর (A.N.M & ASHA) নয় টিমের কাজ অর্থাৎ প্রশাসন, পঞ্চায়েত, পুলিশ, স্বাস্থ্য কর্মী, স্থানীয় বিশেষ ব্যক্তি্র মিলিত প্রয়াস (জেনেছি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় এরকম টিমভিত্তিক কাজ হচ্ছে, যা প্রশংসনীয়)। করোনা সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙার কাজে মানুষকে কাছে পেতেই হবে এবং সেই প্রক্রিয়ায় তার বিশ্বাস অর্জন অসুখের ভয় এবং সামাজিক বৈষম্যের ভয়কে কাটানো শুধু জরুরি নয়, সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার আবশ্যিক শর্ত।
(ড. সুব্রতা সরকার কলকাতার আর.জি.কর হাসপাতালের গভ. নার্সিং কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা, বর্তমানে মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত।)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন