ফোন করলেই খুক খুক কাশি এবং করোনাভাইরাস (COVID-19) সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির সরকারি প্রচার। কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের এহেন প্রচেষ্টায় সকলেই যে সন্তুষ্ট বা নিশ্চিন্ত, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। অনেকেই বিরক্ত। যেমন চেন্নাইয়ের এক আইনজীবী, এই প্রচার আরও বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, এই ভিত্তিতে মাদ্রাজ হাইকোর্টে রীতিমতো মামলা ঠুকে দিয়েছেন।
সরকারি শুভ প্রচেষ্টার বিরোধিতা না করেও একটা কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। উদ্দেশ্য যাই হোক, যে কোনও ধরণের প্রচারই যদি অতি প্রচারে পরিণত হয়, তার ফল আর ইতিবাচক থাকে না। 'করোনা' সংক্রান্ত প্রচার এভাবেই কোথাও এক আতঙ্ক উদ্রেককারী ভূমিকাও যে পালন করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বলতে পারেন, আতঙ্কের নয়া ব্র্যান্ড 'করোনা'। একেবারে রাতারাতি আমাদের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে তাড়া করে বেড়াচ্ছে করোনা ভূত। মাস্কের কালোবাজারি হচ্ছে। স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। একেবারে রেকর্ড বিক্রি। এদিকে এঁরা ব্যবসায় লাভ করছেন, ওদিকে মুরগি ব্যবসায়ীদের গালে হাত। লোকজনের মাথায় কোথা থেকে এসেছে কে জানে, তাঁরা মুরগির সঙ্গে করোনা ভাইরাসের আত্মীয়তা বের করে ফেলেছেন। মুরগি ছেড়ে যেই খাসির চাহিদা, অমনি খাসির মাংস বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দাঁও মারার চতুর হাসি হাসছেন।
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কের বলি মুরগি, ৩ সপ্তাহে রাজ্যে ক্ষতি ৪৫০ কোটি টাকা!
অর্থাৎ করোনা নামক ক্ষমতাশালী ভাইরাস শুধু রোগভোগ নয়, আমাদের বাজারেও থাবা বসিয়েছে। বাজার বলতেই মনে পড়ল, করোনা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে সেনসেক্স-এ। বাজারে ধ্বস। অপরিশোধিত তেলের দামও পড়েছে। অর্থাৎ বিশ্ব অর্থনীতির ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণেও হাজির করোনা। আর পর্যটন ব্যবসা তো একেবারে শেষ। করোনা আক্রান্ত হোক না হোক, প্রায় সব দেশই একে অপরের ভিসা বাতিল করায় পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশি খেলোয়াড়দের আসা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় সমস্যায় আইপিএল। অলিম্পিক কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
কতটা ভয় পাওয়া উচিত?
সত্যি কতটা ভয়াবহ এই ভাইরাসের আক্রমণ? তথ্য বিশ্লেষণ নয়, প্রচার বলছে মানতেই হবে এর ভয়াবহতা। নাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 'হু' কি আর একে আন্তর্জাতিক মহামারী ঘোষণা করে? নিঃসন্দেহে এটা ভাবার বিষয়। কেন না, 'হু'-র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই হু হু করে নামে সেনসেক্স। আন্তর্জাতিক স্তরে যখন কোনও একটি বিষয় গুরুত্ব পায়, তখন সেটা আর তত সরল থাকে না। সেখানে অনেক ধরনের সমীকরণ কাজ করে।
সেসব বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, অতি সক্রিয়তা কখনও কখনও তুলনামূলক সাধারণ বিষয়কেও মাত্রাহীন গুরুত্ব দেয়। সেটা সচেতন বা অচেতন, যেভাবেই হোক, সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে বাধ্য। অতি প্রচারে যে শুধু আতঙ্ক বৃদ্ধি পায়, তা নয়। প্রচারের কেন্দ্রে থাকা বিষয় সর্বক্ষণ সামনে থাকার ফলে বহু প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বিবেচনাক্ষেত্রে পিছনে চলে যায়। এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর। পরিস্থিতি বুঝে দাবার চাল ফেলা রাজনীতির অতি প্রাচীন খেলা। করোনা নিয়ে আতঙ্কে মাতাল মানুষ তাঁদের আশপাশের বাকি সমস্যাগুলি কিছুদিনের জন্য তো ভুলে থাকুন।
এটা বলছি না, সচেতনতার প্রচার জরুরি নয়। এটাও বলছি না সাবধানতা অবলম্বন করবেন না। কিন্তু তাই বলে প্রচারমাধ্যমের অন্ধ অনুসরণ নয়, সন্দেহ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সর্বত্র বারবার বলছেন, আতঙ্কের কিছু নেই। তবে, সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে নিশ্চয়ই। স্বাস্থ্যরক্ষায় পরিচ্ছন্নতা সব সময়ই জরুরি। যেখানে সেখানে কফ-থুথু ফেলা আমাদের জাতীয় অভ্যাস।
আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কে প্লেন টিকিট বাতিল করলে জুটছে মোটা টাকার ‘শাস্তি’
করোনা আতঙ্ক চলে গেলেই আবার আমরা পাইকারি হারে গুটখা গিলব আর থুথু ফেলে দূষিত করব পথ-ঘাট-দালান। কুঅভ্যাস এবং অন্ধ হুজুগ, এই দুটো ব্যাপারই সমাজের পক্ষে মারাত্মক। আজ করোনা, কাল অন্য কিছু। অনাহারে টিবি, অস্বাস্থ্যকর যাপনে একাধিক মারণ রোগ, আজও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে এল না। আমরা এসব নিয়ে কখনও আতঙ্কিত হই না। আতঙ্কিত হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু ভাবা উচিত নয় কি?
এবার করোনাভাইরাস আক্রমণ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান। এটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে আজকের দিনে প্রচারের অতি সক্রিয় ভূমিকাটি।
সাল ২০০৩। এমনই এক ভাইরাস 'সার্স' (SARS বা Severe Acute Respiratory Syndrome) আলোড়ন ফেলে দেয়। ২৬টি দেশে ছড়ায় এই রোগ, মারা যান ১০ শতাংশ রোগী। ২০০৯-এ এল সোয়াইন ফ্লু। আক্রান্ত ৫৭ মিলিয়ন (৫.৭ কোটি), মৃত ৪.৫ শতাংশ। ২০১৪-র বহু আলোচিত ভাইরাস ইবোলা-য় আক্রান্ত হন ১১,৩১০ জন মানুষ, মৃতের হার ২৫ শতাংশ। এবার ২০২০, 'তারকা ভাইরাস' করোনা-য় এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর হার স্রেফ ২ শতাংশ। হ্যাঁ, এই সামান্য সংখ্যক মানুষের জীবনের দামও নিশ্চয়ই আছে। এই অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট বেদনাদায়ক। কিন্তু তার ফলে আমরা পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যরক্ষার সাধারণ নিয়মগুলি মেনে চলব কি?
এবার প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা
২০০৩-এ 'সার্সের'-এর সময় ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না। ২০০৯-এ সোয়াইন ফ্লু, তখন শুধুই ফেসবুক, ব্যবহার করেন আন্দাজ ১৫০ মিলিয়ন (১৫ কোটি)। ২০১৪-য় ইবোলা, তখন হোয়াটসঅ্যাপ আছে, ব্যবহার করেন ৪৫০ মিলিয়ন (৪৫ কোটি)। এবার 'করোনা', ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) মানুষ ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে বিচরণ করেন ১.৬৯ বিলিয়ন (১৬৯ কোটি)।
এই যে ঘুম ভাঙতেই হেডলাইন জুড়ে করোনা-র উজ্জ্বল বিচরণ, সেটা ছেড়েই দিলাম। সংবাদমাধ্যমের কিছুটা দায়িত্বও রয়েছে এক্ষেত্রে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া? তার সারা শরীর জুড়ে যে এই করোনা-র আলপনা, এর দায়িত্ব কে নেবে? সেখানে তো কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফেসবুকে নানা পোস্ট। হোয়াটসঅ্যাপের ব্যক্তিগত সংযোগ এবং গ্রুপে বার্তা বিনিময়ে শুধুই আতঙ্কের করোনা। সবাই সবজান্তা, সবাই বিশেষজ্ঞ, সবার তথ্যভান্ডার করোনা-র তথ্যে পরিপূর্ণ। যত তথ্য, তত বিনিময়। এবং আতঙ্কের রমরমা।
আরও পড়ুন: ভারতে প্রথমবার করোনা মোকাবিলায় এইডস-এর ওষুধ প্রয়োগ
গত ক'দিন যাবৎ সংবাদমাধ্যমে আর কোনও খবর নেই। করোনা এখন শিরোনামে। কোন কোন দেশ আক্রান্ত, কতজন আক্রান্ত, কতজন মৃত, এই সব খবরই আমাদের মস্তিষ্কস্থ! হলিউড তারকা টম হ্যাঙ্কস ও তাঁর স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে আক্রান্ত। ব্রিটেনের জুনিয়র স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাদিন ডেরিসও আক্রান্ত হয়েছেন। বিশিষ্টজনের খবরে আতঙ্ক বাড়ে। ভাবটা এমন, ওঁরাই যদি করোনা-য় আক্রান্ত হন, তাহলে আমরা কোন ছার? যেন এমনটা এই প্রথম। যেন খ্যাতনামারা এর আগে কখনও কোনও দিন ভাইরাসে আক্রান্ত হন নি!
তথ্য বলছে, মূলত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কারণ তাঁরা বারবার আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসেন। অর্থাৎ সাবধানতা অবলম্বন তাঁদেরই বেশি করা দরকার। বাকি যে কোনও ভাইরাসের মতোই করোনা ছড়াবার মুখ্য উৎস ও সম্ভাবনাগুলি সেই অপরিচ্ছন্নতা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা। অবশ্যই আক্রান্ত অঞ্চল ও মানুষের থেকে দূরে থাকতে হবে। আক্রান্তের নিজের দায়িত্বও কম নয়। তাঁরও রোগের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে নিজের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
যথাযথ চিকিৎসা একে প্রতিহত করতে সক্ষম। শিশু ও বয়স্কদের সাবধানে থাকা বেশি জরুরি। বিশেষত যাঁরা ৭০-এর ওপরে, তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন। কারণ, তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অন্যদিকে এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন বা যে কোনও আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক সীমানাযুক্ত অঞ্চলে ভাইরাসজনিত রোগ ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। এই বিষয়ে সব দেশের সরকারই যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছে, এটা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ। এই মুহূর্তে প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা চলছে বিশ্ব জুড়ে। বিজ্ঞানীরা দিবারাত্র কাজ করছেন। সর্বস্তরে এই চেষ্টা নিশ্চয়ই ফলদায়ক হবে।
আরও পড়ুন: জল-সাবানই কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ আটকানোর মোক্ষম অস্ত্র
আর যাই হোক, আতঙ্ক ছড়িয়ে এর সমাধান হবে না। আতঙ্ক কী জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তার প্রমান, শোনা যাচ্ছে এরই মধ্যে কিছু মানুষ করোনা আটকাতে ব্লিচিং পাউডার সহযোগে গার্গল করছেন। এই অজ্ঞতা নিয়ে মজা করা যেতেই পারে। কিন্তু এটা নিয়ে কী বলবেন? জানেন কি, করোনা রুখতে বাজারে এসেছে নতুন গেরুয়া টোটকা - গোমূত্র দিয়ে প্রস্তুত হ্যান্ড স্যানিটাইজার 'কাউপ্যাথি'? পাওয়া যাচ্ছে ঘুঁটে দিয়ে প্রস্তুত সাবানও। দু'টোই অনলাইনে দেদার বিক্রি হচ্ছে। এর আগে গেরুয়া শিবির থেকে প্রচার করা হয়েছে, গোমূত্র ও গোবরেই করোনা-র মতো মারণরোগ প্রতিরোধ সম্ভব। দিল্লিতে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গোমূত্র পার্টির আয়োজন করেছে হিন্দু মহাসভা।
ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে বিশ্ব জুড়ে গবেষণায় ব্যস্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা, সেখানে আমরা গোবর ও গোমূত্রচর্চায় নতুন করে অন্ধ সংস্কার ছড়াচ্ছি। একদিকে প্রচার মাধ্যমের অতি সক্রিয়তায় আতঙ্কের বাড়াবাড়ি। অন্যদিকে হুজুগে লোকজনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মেসেজ বিনিময়। এরই সঙ্গে ধর্মের অন্ধ রাজনীতি। মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্র একবারে প্রস্তুত। এমন অবস্থায় একটাই পথ। এগিয়ে আসতে হবে সচেতন ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে। বোঝাতে হবে, কোনটা আসল জরুরি। আতঙ্কিত হয়ে লাভ নেই। স্বাস্থ্যরক্ষার বিধি ও পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস যথাযথ মেনে চলুন। আজ 'করোনা'-র হানা রুখতে নয়। সব সময়। ঘরে-বাইরে, সর্বত্র।