১
ভারতবর্ষে বায়োমেডিক্যাল রিসার্চের প্রস্তুতি, সমন্বয় ও উৎসাহদানে শীর্ষস্থানীয় দায়িত্বে রয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) নামক সংস্থাটি। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ভারতবাসীর এই লড়াইয়েও তাই স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক সমস্ত নীতি নির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছে আইসিএমআর। ডাঃ রমণ গঙ্গাখেড়কর, আইসিএমআর-এর ডেপুটি ডিরেক্টর, এনডিটিভি টেলিভিশন চ্যানেলকে ১৬ মার্চ দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে ভারতের মতো এত বিপুল জনসংখ্যার দেশে সবাইকে টেস্ট বা পরীক্ষা করাটা দুরূহ ব্যাপার, এবং সবাইকে পরীক্ষা করে ফেললেও নাকি সমূহ বিপদ।
এই অনুভূত বিপদের উদাহরণস্বরূপ গঙ্গাখেড়কর বললেন যে ধরা যাক, সবাইকে পরীক্ষা করা হলো, এবং অনেকের ফলাফল পজিটিভ এল, তখন আক্রান্ত সবাইকে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এটাও নিশ্চিন্ত করতে হবে যে তাঁরা পৃথক থাকার এই আদেশ পালন করছেন। ভারতবর্ষের মতো দেশে এতটা নজরদারি করা অত্যন্ত কঠিন, তাই কোনও সহজ সমাধান সম্ভব নয়।
এই লেখাটির প্রয়োজনে উক্ত সাক্ষাৎকারটি আমি অন্তত কুড়ি বার শুনেছি। এখনও এই বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটা অনুধাবন করতে পেরেছি, তা জোর গলায় বলতে পারব না। প্রত্যেকবার শোনার পর ভদ্রলোকের দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি নতুন করে উপলব্ধি করি এবং তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি আমাকে নতুন করে স্পর্শ করে। সহজ সমাধান বলতে উনি কী বোঝেন, আর দর্শকদেরই বা কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা আমার বোধগম্য হয় নি।
আরও পড়ুন: অসংখ্য গবেষণায় বাড়ছে গোলযোগ
পৃথিবীর কোনও দেশ এই করোনাভাইরাস মহামারী জনিত বিধ্বস্ত অবস্থার কোনও সহজ সমাধান সূত্র বার করতে পেরেছে বলে তো শোনা যায় নি। ভারতবর্ষেও এই মহামারীর কোনও সহজ সমাধান নেই, সেটা বলাই বাহুল্য। তাই বলে পরীক্ষা করব না? সমাধান সূত্র দুরূহ হতে পারে, তাই সমস্যার জটিলতা অনুধাবনের চেষ্টাই করব না। এই মেধায় আলস্য বহন করে কোনও বৈজ্ঞানিক পথ প্রদর্শন করা যায় না। অতীতেও যায় নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। এভাবে দেখতে গেলে, বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে আমাদের ঘন্টা বাজানোই শ্রেয়। আর কিছু না হোক, জাতির একটি সাধারণ লক্ষ্য তো স্থাপন করা যায়।
আমি সাধারণভাবে বিজ্ঞান চর্চা বুঝি ও ভালোবাসি। শুধু বৈজ্ঞানিক পথ নয়, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়েও আমার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। আর আগ্রহ আছে তথ্যে। লেখাটা নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে হলেও এই প্রতিবন্ধের প্রসঙ্গ তাই বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতি, এবং তথ্য। যে ভাইরাসের সংক্রমণে কোভিড-১৯ একটি 'প্যান্ডেমিক' (পৃথিবীব্যাপী মহামারী বা অতিমারী)-এর আকার নিয়েছে, সেই করোনাভাইরাসকে নভেল বলা হচ্ছে কারণ তার 'স্ট্রেইন'-টা নতুন, 'নভেল' মানে নতুন। ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯-এর পূর্বে বিজ্ঞানের সঙ্গে এই করোনাভাইরাসের পরিচয় হয় নি।
পূর্ব পরিচয় নেই বলেই বিশ্বের তাবড় বিজ্ঞানীরা একে বুঝতে এবং এর বিরুদ্ধে যুঝতে নাকানি চোবানি খেয়ে চলেছেন। বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকরা দিন রাত এক করে রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছেন এই ভাইরাসের প্রতিষেধক এবং যথাযথ চিকিৎসার সন্ধানে। এই ব্যাধির সমাধান তাঁরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন, প্রয়োজন শুধু একটু সময়ের। WHO (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) যে সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশিকা এখন অবধি জারি করেছে, সেগুলির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য একটাই - সময় কেনা। গবেষণারত বৈজ্ঞানিকদের প্রয়োজনীয় সময় আপনার-আমার থেকে WHO কিনে নিয়ে বিজ্ঞানকে ধার দিতে চেয়েছে।
আরও পড়ুন: ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব
WHO-এর এই প্রাণ বাঁচানোর প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে মহৎ উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। কিন্তু মুশকিল হলো যে সময় একটি নিঃশুল্ক পণ্য বা 'ফ্রি গুড' নয়। সময় কিনতে হলে খরচ করতে হবে। অর্থনীতির ছাত্রদের প্রথম ক্লাসেই শেখানো হয় যে আমাদের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের একটি 'অপর্চুনিটি কস্ট' আছে। সন্ধেবেলায় টিভি দেখার 'অপর্চুনিটি কস্ট' হতে পারে পড়াশোনা করে জ্ঞানার্জন করা বা শরীরচর্চা করে সুস্বাস্থ্য অর্জন করা বা আড্ডা মেরে বন্ধুত্ব অর্জন করা, ইত্যাদি। টিভি দেখার সিদ্ধান্তের খরচ হিসেবে তাই আর কিছু না হলেও 'অপর্চুনিটি কস্ট' দিতেই হবে। 'ইন ইকোনমিক্স, দেয়ার ইস নাথিং কল্ড আ ফ্রি লাঞ্চ'। পুরোটাই একটা 'ট্রেড-অফ'। এটা পেতে হলে ওটা ছাড়তে হবে।
এই সহজ সরল অপর্চুনিটি কস্ট-এর বিষয়টি WHO বোঝে না, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ১১ মার্চ WHO-এর ডিরেক্টর-জেনারেল টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস মিডিয়ার সামনে ঘোষণা করলেন যে কোভিড-১৯ একটি প্যান্ডেমিক, যা তখন পর্যন্ত ১১৪ টি দেশে ১ লক্ষ ১৮ হাজার মানুষকে সংক্রমিত করেছে এবং ৪,২৯১ জনের প্রাণ নিয়েছে। এবং এও বললেন যে এই সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ও নির্মমতা যেমন ভীতিকর, তেমনি ভীতিকর হচ্ছে বিভিন্ন দেশের নিষ্ক্রিয়তা। 'ট্রেড-অফ' বা 'অপর্চুনিটি কস্ট'-এর ব্যাপারটা বোঝেন বলে তিনি এও বললেন যে প্রত্যেকটি দেশকে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাঙ্গন, ও মানবাধিকারের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
প্রত্যেকটি দেশের কী করণীয় WHO-এর মতে? আক্রান্তদের খুঁজে বার করা, পরীক্ষা করা, সংযোগ চিহ্নিত করা এবং সর্বোপরি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা। আবার বলছি, দিনটা ছিল ১১ মার্চ। বিপদসূচক ঘন্টা বেজে গেছে ততক্ষণে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া ও ট্রেড-অফ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র লেখার প্রয়োজন, তাই এই বিষয়টি তোলা থাক। আমরা ফিরে যাই বিজ্ঞান ও তথ্য নিয়ে আলোচনায়।
আরও পড়ুন: কোভিড-১৯: লকডাউন বনাম হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিয়ে দার্শনিক চর্চার ইতিহাস পাশ্চাত্যের ইউনিভার্সিটিগুলিতে এখনও পড়ানো হয়। ক্রিটিক্যাল র্যাশনালিজম, ইনডাকশন, ফলসিফিকেশন, রেপ্লিকেশন, ইত্যাদি এখনও কিছু ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুমে আলোচিত হয়। রিসার্চ করার আগে রিসার্চ মেথোডলজি এবং রিসার্চ মেথডস নিয়ে পড়াশোনার প্রয়োজন কিছু ইউনিভার্সিটিতে এখনও আছে। কিন্তু আপনার নির্বাচিত বৈজ্ঞানিক চর্চার দর্শন বা পদ্ধতি যাই হোক না কেন, আপনাকে যুক্তি ও তর্ক যথাযথ স্থাপন করতে হলে যে হাতিয়ার অপরিহার্য, তা হলো তথ্য। তথ্য ছাড়া বাবাজির টোটকা চলতে পারে, গুরুদেবের নিদান চলতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানচর্চা চলতে পারে না। আমরা যেটা সাধারণ জ্ঞান বা 'কমন নলেজ' হিসেবে গ্রহণ করি, তাকেও বৈধতা পেতে হলে তথ্যের দ্বারস্থ হতে হয়।
২
এই নভেল করোনাভাইরাস মধ্য চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে জন্মে, প্লেনে চেপে বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে ভারতে প্রবেশ করল ৩০ জানুয়ারি, ২০২০, এবং সরকারিভাবে ভারতে আত্মপ্রকাশ করল কেরালা রাজ্যে। নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র। তা যাই হোক, সেই একই দিনে WHO ঘোষণা করল যে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব একটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য জনিত জরুরি অবস্থা, যার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্বেগের প্রয়োজন আছে। নতুন একটি ভাইরাস, যার সম্বন্ধে পূর্ব জ্ঞান নেই বললেই চলে, তার মোকাবিলায় তৎকালীন WHO-নির্ধারিত পরিকল্পনার উল্লেখ আগেই করেছি।
এটা বলে রাখা প্রয়োজন যে WHO এই সংক্রমণকে চারটি স্টেজ বা ধাপে ভাগ করেছিল। প্রথম ধাপে 'আবির্ভাব' বিদেশ-ফেরত মানুষের দেহে। দ্বিতীয় ধাপে 'লোকাল ট্রান্সমিশন', যেখানে সরাসরি সংক্রমণ ঘটবে প্রথম ধাপে আক্রান্তদের দেহ থেকে। তৃতীয় ধাপে 'কমিউনিটি ট্রান্সমিশন', যেখানে সংক্রমণের উৎস আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। চতুর্থ ধাপে 'এপিডেমিক'-এর মৃত্যু মিছিল।
WHO-এর যে স্ট্র্যাটেজি-র উল্লেখ আগে করেছি - আক্রান্তদের খুঁজে বার করা, পরীক্ষা করা, সংযোগ চিহ্নিত করা এবং সর্বোপরি হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রস্তুত রাখা - তার সুফল পাওয়া যাবে প্রথম দুই ধাপে। তৃতীয় ধাপেও কিছুটা কার্যকারিতা থাকতে পারে। কিন্তু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা গোষ্ঠী সংক্রমণের হারে বৃদ্ধি হলে এবং চতুর্থ ধাপে পৌঁছে গেলে আক্রান্তদের খুঁজে বার করার চেষ্টা বা পরীক্ষা করে সংযোগ চিহ্নিত করার চেষ্টা অযথা জাতীয় সম্পদের অপচয়। তার চেয়ে রাষ্ট্রের উদ্যম সম্পূর্ণভাবে হাসপাতাল ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
এত স্ট্র্যাটেজি, কর্মপদ্ধতি তৈরী করে WHO সমস্ত দেশের সরকারকে বলল যে তোমাদের এখন শুধু তিনটে কাজ - টেস্ট, টেস্ট ও সর্বোপরি টেস্ট। বেশি পাকামোর প্রয়োজন নেই, যা বলছি তা সৎভাবে মেনে চললে আখেরে তোমাদেরই লাভ। চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, জার্মানি সহ বিভিন্ন দেশ এই স্ট্র্যাটেজি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে উপকার পেয়েছে, বাকিরাও পেতে পারে। ও হ্যাঁ, কেরালা নামক রাজ্যটিও এই একই স্ট্র্যাটেজি মেনে উপকৃত হয়েছে। সৎভাবে কথা শুনে কাজ করলে এদেশেও মহামারীর বিরুদ্ধে লড়া যায়।
এবার একটু নিজেদের দেশের হালহকিকত দেখে নেওয়া যাক। ফেব্রুয়ারির শুরুটা দিল্লির নির্বাচন এবং শেষটা ট্রাম্প-এর আসাযাওয়া আর নাচনকোঁদনে কেটে গেল। সে যাক গে, 'পরম বন্ধুর' জন্য এটুকু না করলেই নয়। নভেল করোনাভাইরাস কেরালায় পৌঁছোনোর পরেও, এবং WHO-এর দ্বারা কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাঁচ সপ্তাহ পরেও, একবার আইসিএমআর-এর প্রস্তুতির বহরটা দেখে নেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: চিকিৎসক ও সমাজ – মহামারীর দ্বিপ্রহরে
৬ মার্চ, ২০২০, আইসিএমআর একটি মিডিয়া বিবৃতি জারি করল। তাতে আমাদের জানানো হলো যে ততদিন অবধি ৩,৪০৪ জনকে সংক্রমণের জন্য পরীক্ষা করা হয়েছে, সারা দেশে ৫২ টি ল্যাবরেটরি পিসিআর (পলিমারেস চেন রিঅ্যাকশন) পদ্ধতিতে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য তৈরী, এবং ৫৭ টি ল্যাবরেটরি নমুনা সংগ্রহের জন্য তৈরী। এ প্রস্তুতি আন্দাজ ১৩০ কোটি অভাগার সুরক্ষার্থে। ১৭ মার্চ আরেকটি বিবৃতিতে পরীক্ষার ল্যাবরেটরির সংখ্যা ৭২ বলা হলো।
১৯ মার্চের বিবৃতিতে আইসিএমআর 'সেন্টিনেল সার্ভেল্যান্স' নামক একটি কর্মসূচির কথা জানাল। এই কর্মসূচির তথাকথিত লক্ষ্য ছিল ভারতের গোষ্ঠী সংক্রমণের উপর নজরদারি করা। কীভাবে হলো এই নজরদারি? ১৫ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি অবধি ১৬ টি স্থানে, এবং তার পর ১৫ মার্চ অবধি অধিকতম ৫১ টি স্থান থেকে সব মিলিয়ে এক মাসে ৮২৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে নাকি দেখা গেল, পরীক্ষিতদের কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত নন। এবং তার থেকেই নাকি নির্ধারণ করা গেল, ভারতবর্ষে গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে না।
আর একবার এটা বুঝে নেওয়া যাক। পিরিয়ড অফ অবজারভেশন - এক মাস, স্যাম্পল সাইজ - ৮২৬, ফ্রিকোয়েন্সি - অজানা, পপুলেশন সাইজ - ১৩৫,০০,০০,০০০, মেথোডলজি - অজানা ম্যাজিক, ইনফারেন্স - গোষ্ঠী সংক্রমণ হচ্ছে না। এই বিবৃতি বেরোনোর দিনই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী 'জনতা কারফিউ'-এর কথা ঘোষণা করলেন। ২২ মার্চ পালিত হলো জনতা কারফিউ, এবং এও ঘোষণা করা হলো যে ২৪ মার্চ থেকে ভারতবর্ষে সম্পূর্ণ লকডাউন জারি হবে। লকডাউন ঘোষণার দিনই সন্ধ্যে ছটায় আইসিএমআর জানাল, ভারতবর্ষে ১৪,৫১৪ জনের কোভিড-১৯ পরীক্ষা হয়েছে, এবং ২৩৬ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এখানে বলে রাখা দরকার যে ২২ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ১২৮ জনকে কোভিড-১৯ এর জন্য পরীক্ষা করা হয়েছিল।
৩
আবার একটু তথ্য ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
ওপরের তালিকাটি সম্পূর্ণ সরকারি ডেটা দিয়ে তৈরী, এবং সরকারি কর্মপন্থা ও নির্দেশিকা এই তথ্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই তথ্যের সত্যতা ও নির্ভরশীলতা প্রশ্নাতীত হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু অভাগাদের দেশে সত্যতা ও নির্ভরশীলতা বড়ই অপ্রতুল। উদাহরণস্বরূপ ৪ এবং ৫ নম্বর কলাম-এর শেষের এন্ট্রি দুটি দেখুন। আইসিএমআর-এর তথ্য আমাদের বলার চেষ্টা করছে যে লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম সপ্তাহে নমুনার চেয়ে ব্যক্তির সংখ্যা বেশি। একটু ভেবে দেখুন, সৎ ও নির্ভরশীল তথ্যের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব কিনা। ভারতবর্ষে এর আগে বহুবার ডেটার সত্যতা ও নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এখনো উঠছে। তিতিবিরক্ত আমি এই লেখার জন্য, এই মুহূর্তে, অনুমান করে নিচ্ছি এটি একটি ডেটা এন্ট্রি জনিত ভুল, এবং সর্বসমেত তথ্যে বৃহত্তর গরমিল নেই।
জানুয়ারি থেকে লকডাউন জারি হওয়া পর্যন্ত ভারতে বিদেশ থেকে আসেন আনুমানিক ১৫ লক্ষ মানুষ, এবং লকডাউন চালু হওয়া অবধি প্রতি ১ লক্ষ মানুষ পিছু ১.৬৮ টি নমুনা পরীক্ষা করা হলো। এই তথ্যের ভিত্তিতে অর্থনীতির চাক্কা জ্যাম করে দেওয়া হলো, ১৫ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে মানুষ থেকে পশুতে রূপান্তরিত করা হলো। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যে লকডাউনের আগে আমরা অ-প্রস্তুত ছিলাম, তাই নিজের প্রস্তুত করতে লকডাউনের প্রয়োজন ছিল। কেন দেড় মাস ধরে সরকার প্রস্তুতি নেয় নি, কেন আমাদের জীবন নিয়ে খেলা করা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
লকডাউনে ফিরে আশা যাক। হ্যাঁ, ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এই এক মাসে। এই মুহূর্তে সব মিলিয়ে ২৭৭ টি সরকারি এবং ৮৯ টি বেসরকারি ল্যাবরেটরি নভেল করোনাভাইরাস পরীক্ষায় নিযুক্ত, যদিও টেস্টিং কিট জনিত সমস্যা এখনো অনেক জায়গাতেই রয়ে গেছে। তা অল্পবিস্তর ভুল-ত্রুটি নিয়ে চলতে হবে মেনে নিলাম, কিন্তু টেস্ট কত হলো? পরিমান কি যথেষ্ট?
টেবিল ১ এর তথ্য একটু নাড়াচাড়া করলে টেবিল ২ তৈরী করা যায়। কী বলছে টেবিল ১ ও ২? লকডাউনের প্রথম ২১ দিনে ভারতবর্ষে গড়ে আমরা দিন প্রতি ১০,৫৮১ টি নমুনা পরীক্ষা করেছি, অর্থাৎ ১ লক্ষ মানুষ পিছু ০.৭৮ জন। দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে দিন প্রতি ৩৬,৫২১ টি নমুনা পরীক্ষা করেছি, অর্থাৎ ১ লক্ষ মানুষ পিছু ২.৭১ জন। এক মাস লকডাউনের পুরো পাওনাগন্ডার হিসেব। পশ্চিমবঙ্গে বাস করি তাই তুলনামূলক তথ্য দিয়ে রাখলাম। এর অতিরিক্ত আলোচনা নিরর্থক। ভারতবর্ষের দিকেই দৃষ্টি থাক।
এত কিছুর পরে প্রতি ১ লক্ষ মানুষ পিছু সাকুল্যে আমরা ৩৭ টি নমুনা পরীক্ষা করেছি। প্রেক্ষিতের জন্য অন্য কয়েকটি দেশের টেস্ট ডেটা দেখা যাক। ১ লক্ষ মানুষ পিছু এখন পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে আমেরিকায় ১,৫৯৫, ইতালিতে ২,৮২৪, জার্মানিতে ২,৪৭৪, ইরানে ৪৮৮, এবং পাকিস্তানে ৬৫।
আরও পড়ুন: হার্ড ইমিউনিটিই কি অনিবার্যতা?
পরীক্ষা-নিরীক্ষার গপ্পো তো বোঝা গেল, কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো? সপ্তাহ দুই আগে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে লাভের হিসেব দিয়ে গেলেন স্বয়ং লব আগরওয়াল। কে তিনি? কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবক্তা, একজন গুরুত্বপূর্ণ আমলা। লকডাউনের জন্য নাকি ৮ লক্ষের ওপর মানুষের প্রাণ বেঁচেছে। এই তথ্য কোথায় পেলেন লববাবু? আইসিএমআর-এর রিসার্চ থেকে নাকি এই তথ্য উঠে এসেছে। সামর্থক তথ্য এবং রিসার্চের বিশ্লেষণ না লব সাহেব দিলেন, না আমাদের সাংবাদিকরা জানতে চাইলেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের একটা বড় গুণ, অযথা প্রশ্ন করেন না। সরকার যা বলে, নোটবুকে চুপচাপ টুকে নিয়ে চলে যান। আইসিএমআর-এর এই গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ তো আমি খুঁজে পাই নি। আপনারা পেলে আমাকে পাঠাবেন প্লিজ। একটু পড়ে দেখতে চাই, এই লেখায় পরিবেশিত তথ্য থেকে কীভাবে ৮ লক্ষের সংখ্যায় পৌঁছনো যায়।
ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রফেসর তথা এপিডেমিওলজিস্ট (মহামারী বিশেষজ্ঞ) নীল ফার্গুসন-এর কিছু গবেষণাপত্র নাড়াঘাঁটা করেছি এই ক'দিনে। দেখা যাক, আইসিএমআর-এর এপিডেমিওলজিক্যাল গবেষণাপত্র পড়ার সৌভাগ্য এ জীবনে হয় কিনা। হয়তো ডাঃ রমণ গঙ্গাখেড়কর ঠিকই বুঝেছেন। ফকির, বাবাজি, চৌকিদারের দেশে তথ্য প্রয়োজনাতিরিক্ত। মনে প্রেম আর হাতে মোমবাতি ধরে রাখলেই হবে। ২০ এপ্রিল থেকে লকডাউন শিথিল হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ১ লক্ষ মানুষ পিছু ০.১৭ টি নমুনা পরীক্ষা দিয়ে শুরু, এবং ২.৭১ দিয়ে শেষের মুখে এবং মাঝে ৮ লক্ষ মানুষ বেঁচে গেলেন। র্যান্ডম স্যাম্পলিং ও টেস্টিং ছাড়াই প্রথম দেশ হিসেবে গোষ্ঠী সংক্রমণের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সত্যি বিচিত্র এই দেশ।
(লেখক অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নোতর দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)