কী বার আজকে? বেলা দশটা নাগাদ মনে হল প্রশ্নটা। আর, অবাক লাগল। বাড়িতে উপস্থিত বাকি দুটি লোকই একটু দ্বিধাগ্রস্ত, শেষে মোবাইল দেখলাম। যেন আমরা আছি একটা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মাঝখানে, যেখানে ক্যাপসুলের মধ্যে দিনরাত্রি শীতগ্রীষ্ম ঠিকমত ফিড করা থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সংযুক্ত কাজগুলোর হিসেব গিয়েছে গুলিয়ে। দৈনন্দিন কাজের বোধ আছে, স্মৃতি আছে কিন্তু এই কিছু সময়ের জন্য তার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
আজ পাঁচদিন হল আমরা বাইরের সব কাজকর্ম থেকে বিযুক্ত, বাড়ির ভেতরে আছি। একবার বেরিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে পাড়ার মধ্যে কিছু জরুরি কেনাকাটা সেরে তাড়াতাড়ি আবার বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকে পড়ছি। পথে প্রায় কারো সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। যদি বা দু-একজনকে দেখতে পেলাম, তাদের চেনা যাচ্ছে না কারণ মুখ নাক কপাল প্রায় পুরো ঢাকা। তাছাড়া সব লোক দাঁড়িয়ে আছে পরস্পরের থেকে তিনহাত করে দূরে। কথা বলতেও বেশি আগ্রহী নয়, যেন কথা বলা, হাসিঠাট্টা করার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা আছে। নানা নির্দেশিকায় বারে বারে প্রচার করা হচ্ছিল ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার কথা, যাহোক কিছু শুভবুদ্ধিমান মানুষের আপত্তিতে সেই শব্দবন্ধ বদল হয়েছে।
২১ দিনে হবে না, বলছে বাঙালি বিজ্ঞানীর আন্তর্জাতিক গবেষণা
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তো আরেক সমস্যা, সামাজিক দূরত্ব কেন! ক্রমশ বাড়তে থাকা সামাজিক দূরত্বই কি আজকে আমাদের অন্যতম প্রধান ব্যধি নয়, যা বাড়তে বাড়তে আজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব তৈরি হচ্ছে? একটা বিকট আর অশ্রুতপূর্ব বিপদের সময়ে আমাদের খুব দরকার সামাজিক নৈকট্য। বাস্তবে বলা হচ্ছে হয়ত শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথাই, যাতে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম হয়, কিন্তু ব্যবহৃত হতে শুরু করেছিল অন্য অবাস্তব এবং ক্ষতিকারক ভাবনার শব্দবন্ধটি। আর, সেটা খুব কমজনকেই হয়ত অস্বস্তিতে ফেলেছিল।কিছুজনের মনে হয়েছিল বিচ্ছিন্নতা দিয়ে কোনো নিরাপত্তা সাধিত হতে পারবে।
জানি না অবশ্য এইভাবে কোনো সম্পূর্ণ নিরাপত্তা সম্ভব কী না, বিশেষত আমাদের এই বিশাল বিস্তৃত দেশে যেখানে গ্রামে শহরে লক্ষ লক্ষ লোক জীবিকার কারণে, আরো হাজার রকম কারণে বাড়ির বাইরে, দূরে থাকতে বাধ্য হন। সেখানে এরকম একটি সার্বিক নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠলে সামাজিক নিরাপত্তাই তো প্রথম এবং সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সেই নিরাপত্তা ও যত্নের কিছু কিছু খবর আসছে। কেরলের রাজ্য সরকার হাজারে হাজারে ঘরের দিকে আসতে থাকা গরিব মানুষদের মাইগ্রেটরি লেবার না বলে অতিথি শ্রমিক হিসাবে নিয়েছেন, তাঁদের খাবার ও যানবাহনের কিছু ব্যবস্থা করছেন। আমাদের রাজ্যসরকারও একই ভাবে এঁদের বাড়ি পৌঁছবার ক্ষেত্রে কিছু সাহায্যের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারও আগে খুব স্থানীয়ভাবে এই চেষ্টা শুরু করেছিলেন বিভিন্ন জায়গায় সহমর্মী কিছু দায়িত্ববান মানুষ, অন্যের কষ্টকে যাঁরা নিজেদের কষ্ট হিসাবে অনুভব করেছিলেন। অবশ্যই এই চেষ্টাগুলি প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ব্যক্তিগত সমবেদনা আর তা থেকে উৎসারিত কাজের সততা আর সৌন্দর্যই মানুষের সভ্যতাকে রক্ষা করে। অন্যপক্ষে তার প্রায় পাশাপাশিই কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিক লোকজনের মধ্যে আমরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জিনিস কেনার যে আগ্রাসন দেখেছিলাম, সংখ্যা বা পরিমাণে তাও হয়ত খুব বেশি ছিল না কিন্তু প্রতিবেশী, সহ-নাগরিক বা যে-কোন ‘অন্য’দের প্রতি যে অসম্ভব দায়িত্বহীন সংকীর্ণ স্বার্থকেন্দ্রিক মনোভাব সেখানে প্রকাশ পেয়েছিল, তা যে কোনো সমাজের পক্ষে নিঃসন্দেহে ক্ষতিকর।
করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা
ছোট বা তুচ্ছ কোনো ঘটনা, কাজ বা ভাবনার গুরুত্ব স্পষ্ট হয় যখন আমরা বুঝতে শিখি যে বিচ্ছিন্নতা বলে কিছু হয় না। মনে মনে বিচ্ছিন্ন বলে বোধকরার বাইরে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই। প্রকৃতির মধ্যে ক্ষুদ্রতম বিষয়গুলিও শিকলের বা মালার মত একটি অপরটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ জড়ানো। মানুষও যেহেতু প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার একটি গ্রন্থি, তাই তার কোন কাজও পারম্পর্যবিহীন, বিচ্ছিন্ন হতে পারে না।
আজ যে ‘ভাইরাস’ঘটিত বিকট সমস্যায় পড়েছে বিশ্বের সভ্যতা, তাও কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়, একথা এখন অনেকেই জানেন। মাত্র আড়াইশ বছরের উচ্ছৃঙ্খল অপ্রাকৃতিক আচরণে কিছু মানুষ কেবল নিজেদের প্রজাতিকে নয়, এই পৃথিবীর জটিল, সূক্ষ্ম শৃঙ্খলাজালকে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। সমস্ত সময়টা ধরে শুভচিন্তক বিজ্ঞানসাধকরা শিক্ষিত মানুষদের সতর্ক করে এসেছেন। বলা বাহুল্য, এখানে ‘বিজ্ঞানসাধক’ শব্দটি আমি প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করলাম, প্রচলিত প্রযুক্তিবাদী অর্থে নয়।
প্রকৃতির নিয়মসমূহকে যারা যত্ন নিয়ে বোঝবার ও সেই বোঝাকে কল্যাণসাধনে লাগাবার চেষ্টা করে এসেছেন, তাঁরাই বিজ্ঞানসাধক। প্রক্ররতি থেকে এর আগেও বহুবার বিপর্যয়ের চেহারায় এসেছে নানা সতর্কবাণী। কিন্তু মুনাফার লোভে অতি-উৎপাদক ও তাদের সুবিধাভোগী কিছু মানুষ সেদিকে কান দেয় নি। সাধারণ মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা, প্রকৃতির নিজের সুরক্ষা থেকে। এই ক্রমবিচ্ছিন্নতা আজকে এই সংকট ঘনিয়ে তুলেছে। ভবিষ্যতে এরকম সংকট আরো আসবে, একথা কোনো ভয় জাগানো কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। আসবে, যদি এখনও আমাদের মত সাধারণ মানুষজন এই ভাবনার বিপরীতে নিজেদের শক্তিপ্রয়োগ না করি। মানুষের অতি প্রয়োজন, অতিভোগ লালসা এই বিপর্যয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল, ভবিষ্যতে এর চলন পালটাতে হলে উদ্যোগ নিয়ে চেষ্টা করতে হবে। না হলে পনেরো-একুশ-চল্লিশ...কোন গণনার দিনেরই কর্মবিহীন গৃহবন্দিত্ব আমাদের কোনো পরিত্রাণ দেবে না। যাঁরা ভাবছিলেন নিজেদের জন্য একশ কিলো চাল চল্লিশ লিটার তেল দশটা গ্যাসের ব্যবস্থা করে সুরক্ষিত থাকবেন, তাঁদের মনে পড়ুক পুরোন প্রবাদটি- ‘আগুন পীরের ঘর মানে না’।
করোনা অধিমারী: দায়িত্ব ও কর্তব্য
বিশ্বের বোধ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নজন কোথায় যাবে? যে প্রকৃতি সত্যিই আমার জীবনস্বরূপা, যে আমার একমাত্র ভূমি, আমার সমস্ত জীবনখানির যে একমাত্র ধাত্রী- তার থেকে নিজেকে এতখানি বিচ্ছিন্ন করেছি যে তার ভাষাও বুঝতে পারি না। তার ভেঙেপড়ার শব্দ, তার ফেটে পড়ার আর্তনাদ, তার একের পর এক সাবধানবাণী- কিছুই শুনতে পাইনা। বধির হয়ে গেছি। শুনলেও তার অর্থ বুঝিনা। যারা বোঝে তাদের থেকে কান ফিরিয়ে রাখি। দিনে দিনে বিশ্ববিচ্ছিন্নতার কারাগার তৈরি করেছি। আমি নিজেই করেছি, আর তাকে ভেবেছি পরম রঙমহল। আকাশের রামধনুর চেয়েও রঙীন। শুকতারা সন্ধ্যাতারার চেয়েও সুন্দর। তাই শিশুকে বাইরে থেকে কিনে আনা খেলনা দিয়েছি- খেলবার, শিখবার, অভ্যেস করে স্মার্ট হবার জন্য। তাকে বাইরে নিয়ে বিশাল জগত দেখাবার কথা ভুলেছিলাম, যা সে জন্মমাত্র আপনিই পেয়েছে খেলা করার, মুগ্ধ হবার জন্য।
এমন একটা বিভ্রমের ভঙ্গি রয়েছে চারপাশে যেন এই নোভেল করোনা একটা আকস্মিক বিপদ। কোনরকমে ‘ঘরবন্দী’ ’আইসলেশান’ ইত্যাদিতে এবারটা পরিত্রাণ পেয়ে গেলে আবার অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে। কিন্তু এমন নয় বলেই মনে করছেন অনেকে।
ভাইরোলজি এবং পরিবেশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়ে দীর্ঘকাল গবেষণারত কর্মীরা অনেকেই উৎকঠিত ভাবে জানাচ্ছেন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার ওপর মানুষের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপের ফল কেবল জলবায়ুর পরিবর্তন- এমনটা ভাবা ভুল হবে। বিশ্বপ্রাণের অতি ছোট অংশগুলির জীবনচক্রের সঙ্গে এইসকল পরিবর্তন অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এইসব ভাইরাস বহুকাল ধরে পৃথিবীতে বর্তমান ছিল। অন্যান্য প্রাণিদের শরীর ছিল এদের বাসস্থান। অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণ প্রাণী ধ্বংস করতে করতে মানুষ এই ভাইরাসদের পুরোন বাসস্থানগুলি ধ্বংস করে ফেলেছে। প্রাণী যত সহজে লোপ পায়, ভাইরাস তা পায় না। বরং বিপন্নতার ফলে তাদের অনেকুগুলোই প্রতিকূল অপরিচিত বাসস্থানেও টিকে থাকতে অভ্যস্ত হয়েছে। মানুষের শরীর সেইসব বাসস্থানের অন্যতম। বর্তমান অবস্থা সেই ভাইরাসদের সংগে তাদের নতুন বাসস্থানের অনভ্যস্ততার প্রকাশ।
যদি এখনও মানুষ সতর্ক না হয়, অতি-উৎপাদনমুখী উৎপাদনব্যবস্থা আর তার ওপর নির্ভরশীল আপাত-আত্মসুখী বিনাশমূলক জীবনযাপন একই রকমভাবে চালাবার কথা ভাবে যদি, তাহলে এর চেয়ে আরো অনেক বড় মূল্য দেবার জন্য তাকে তৈরি থাকতে হবে।
আজ যাঁরা দূর দূর থেকে সারাদিন সারারাত মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটছেন, খিদে তেষ্টা ক্লান্তিতে মরণাধিক কাতর আর যাঁরা আজও আছেন নিরাপদে ‘উচ্চবৃক্ষচূড়ে’...’নগর পুড়িলে’ দেবালয় কিন্তু বাঁচে না। মাটি বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল ভাইরাস ঘটিত বিপদও কোনো সীমানা জানে না।
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে