করোনা ডায়েরি/২৮ মার্চ, শনিবারআজ পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখে জীবনানন্দের কথাই বার বার মনে পড়ছে। করোনা নামক ভয়ঙ্কর অজানা দৈত্য আচমকা আমাদের বিশ্বের আলয়ে ঢুকে পড়েছে। আইেসােলেশনে আছি। টিভিতে খবর শুনেছি। এলাহাবােদর প্রায় বিশ-পঁচিশ জন দিনমজুর, যাঁরা দিল্লির এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাস করতেন, তাঁরা সব নিয়ম ভেঙ্গে দলবদ্ধ ভাবে উত্তরপ্রদেশের সীমান্ত বাস টার্মিনালে এসে জড়ো হয়েছেন। উত্তেজিত পুলিশ যখন তাঁদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে, কেন আপনারা এখানে এসেছেন? তখন সেই গরীব মানুষগুলো বলছেন, তাঁরা শুনেছেন এখান থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার বাস ছাড়বে আজ। এটা গুজব। ওঁদের কাছে পকেটে কানাকড়ি নেই। পুলিশ ওঁদের ধরে পেটাচ্ছে। এমনকি মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছে। কেউ কেউ বিস্কুট খেয় দিন কাটিয়েছেন। ভাবছেন, কোনও ভাবে রোজগারের জন্য ইমিগ্রেশনের মায়া ত্যাগ করে গ্রামে ফিরে যাই। তাতে হয়ত পেটে কিছু পড়বে। দিল্লিতে থাকলে অনাহারে মৃত্যু হবে। এ আমার দেশ ভারতবর্ষ?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া রেপো রেট কমিয়েছে। কারণ কেউ ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শিল্পে বিনিয়োগ করছেন না। ব্যাঙ্কে আমাদের টাকাগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে। অথচ ব্যাঙ্কেকে সুদ দিতে হবে আমাদের। তাই ব্যাঙ্কগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে টাকা গচ্ছিত রেখে দিচ্ছে। সুদ পাবে বলে। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কই বা সুদ পাবে কোথা থেকে? তাই রেপো রেট কমাতে বাধ্য হয়েছে তারা, যাতে মানুষ টাকা বিনিয়োগ করেন। আমরা যারা প্রবীণ সমাজের অঙ্গ, আমরা ব্যাঙ্কের সুদের উপর ভরসা রাখি। কিন্তু ব্যাঙ্কের সুদ কমতে বাধ্য। এদিকে স্বাস্থ্য পরিষেবাতে এখন সরকারকে অনেক বেশি খরচ করতে হবে। কোথা থেকে আসবে এত টাকা? এ টাকা কার? নরেন্দ্র মোদীর নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়। এসব আমাদেরই রাজস্ব।
বাংলােদেশের 'প্রতিদিন'-এর সম্পাদক নঈম নিজামের লেখা পড়ে বুঝেছি, আমরা একা নই। আজ দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়ির দোতলায় একা একা থাকতে থাকতে বিষাদ গ্রাস করছে, এদেশের মুটে-মজুরদের অসহায় অবস্থা দেখে। এখানে বহু পুলিশ যা করছে, তা দেখছি বাংলাদেশেও হচ্ছে। আমরা আসলে একই ডিঙ্গির ওপর বসে আছি। উই আর ইন দ্য সেম বোট। নঈম নিজাম লিখেছেন, নিরীহ একজন খেটে খাওয়া মানুষ কেন বাড়ি থেকে বের হন এই সময়? তাঁরও মন চায় আইন মানতে। তবু দু'মুুঠো চাল কিনতে ওঁরা বেরোন। ওঁদের ধরে পেটাবেন না। বয়স্ক মানুষের কান ধরবেন না। বুঝিয়ে বাড়িতে ফেরৎ পাঠান। পারলে রাষ্ট্রীয় খাত থেকে সহায়তা করুন।
ফেসবুকে নঈম সাহেবের সমর্থনে ঝড়। জনৈক সঈফুল জামিল লিখেছেন, আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং তিনি তা ফিরিয়ে দেবেন। কখন দেবেন তা তিনি জানেন। আহেমদ সুলতান বলেছেন, 'মানুষ, তুমি মানুষ হও'। আর এঁদের বলা উচিত, "সরকারি আমলা, তোমরা মানুষ হও"। আমাদের ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশের মধ্যে আয়তন ও জনসংখ্যার তফাৎ যাই হোক, আসলে আমরা একই পরিস্থিতির শিকার। পুলিশকে মিডিয়া-দরদী বলে ভারতীয় কিছু মাধ্যম যতই দেখাক না কেন, আমি তো দেখছি চিত্তরঞ্জন পার্কে এই পরিস্থিতিতে চা-ওয়ালাকে বিক্রির সুযোগ দেওয়ার জন্য ঘুষ নিচ্ছে। দুর্নীতি পিরামিডের শীর্ষ থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত। পুলিশের হাতে প্রচুর ক্ষমতা এখন, তাই ওরা পেটাচ্ছে। এহেন দীর্ঘ কার্ফু তো ভারতীয়রা বহুদিন দেখে নি।
আর আমরা এ অবস্থায় এখনও মোদী ভালো না খারাপ, তাই নিয়ে ঝগড়া করে চলেছি। চিনকে দেখে কেন আগাম ব্যবস্থা নিল না সরকার? আমি বলছি, আপাতত ক্ষুদ্র রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করি। গত সত্তর বছর ধরে যাঁরা দেশ শাসন করেছন, তাঁদেরও ভাবতে হবে, কেন আজও ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামোর হাল এত শোচনীয়। তর্ক অনেক। আপাতত আমরা করোনার মোকাবিলা করি ঐক্যবদ্ধভাবে।
তারপর ফিরে যাচ্ছি ফ্ল্যাশব্যাকে। ডায়েরির পিছন দিকের পাতায়।
করোনা ডায়েরি/২২ মার্চ, রবিবার
কোনও এক দার্শনিক বলেছিলেন, একটা লোককে যদি ঘেন্না করতে চাও, তবে খবরদার তার কাছাকাছি ঘেঁষো না। লোকটাকে একদম না জানেল তাঁকে ঘেন্না করা সহজ। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে এমনটা বলা যায়। আমাদের দেশে এমন কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মোদী সম্পর্কে জানেন খুব কম। কিন্তু তাঁরা তাঁকে ঘেন্না করেন। তিনি যাই করুন না কেন, খুঁত ধরবেনই। নিন্দা করতেই হবে। করোনাভাইরাসের আক্রমণের এমন এক দুঃসময়ে স্বেচ্ছায় বন্দি হয়ে আছি বাড়িতে। বিশ্ব জুড়ে হাহাকার। দেখছি, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কী অভূতপূর্ব আন্তরিকতার সঙ্গে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন। কাজটা কিন্তু সোজা নয়। আমাদের দেশটা চিন, এমনকি সিঙ্গাপুরও নয়। বিপুল জনসংখ্যা। বড় জটিল গণতন্ত্রের দেশ আমাদের ভারতবর্ষ। একনায়কতন্ত্র নয়।
তবু মোদী যেভাবে আজ গোটা দেশে জনতা কার্ফুকে সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়িত করলেন, তা দেখে তাঁর নেতৃত্বের তারিফ না করে পারছি না। চিনে লকডাউন করা হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে, আর করা হয়েছিল দমন নীতির সাহায্যে। আমাদের বৃহত্তম গণতন্ত্রে যখন পান থেকে চুন খসলে আমরা গেল গেল রব তুলি, তখন কোটি কোটি মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘরের মধ্যে থাকতে বাধ্য করা সহজ কাজ নয়। তিনি দেশের প্রকৃত অভিভাবকের মতো কাজ করেছেন।
গতকাল সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী যখন জনতা কার্ফু ঘোষণা করলেন, তখন ভাবতে পারিনি শত শত মানুষ তাঁর কথায় এভাবে সাড়া দেবেন। আজ তো রবিবার। এমনিতেই আজ ছুটির দিন। সারাদিন বাড়িতে। সকাল থেকেই আমাদের দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের পাড়াটা ঝুপ করে নিঃঝুম হয়ে গেছে। আমার পাঁচতলার ব্যালকনির সামনেই আছে একটা পার্ক। সেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ হাঁটেন। বাচ্চারা খেলে। আজ কেউ কোথাও ছিল না। সকালে পরিচারক আসে নি। আমার স্ত্রী কলকাতায় অসুস্থ বাবা-মার কাছে। বাড়িতে আমার সঙ্গী এক বিড়াল। তার নাম পুচকি সুন্দরী। আপাতত সে আমার ছায়াসঙ্গী; এঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছি, তিনি আমার পিছন পিছন এঘর থেকে অন্য ঘর করছেন।
বিকেলে কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ শুনে ব্যালকনিতে গেলাম। আমি টিভিতে তখন নেটফ্লিক্স-এ জুলিয়া রবার্টস-এর 'মিরর মিরর' দেখছিলাম, গ্রিম ভাইদের এক অসাধারণ প্রাচীন রূপকথা। অত্যাচারী রানীর হাত থেকে অরণ্যবাসী প্রকৃত রাজকুমারী 'স্নো হোয়াইট' মুক্ত করছে দেশকে, গ্রামের গরীব করদাতা ও অত্যাচারিত মানুষকে, ঠিক তখনই করতালি আর শঙ্খধ্বনি। বিকেলের ঝকঝকে হলুদ রোদ্দুর। মনে হচ্ছে কতিদন পর এমন হলুদ রোদ দেখলাম। শৈশবে হাওড়ার মন্দিরতলায় ছাতে উঠতাম। রবিবার বিকেলে তখন এমন হলুদ রোদ আছড়ে পড়ত। কতদিন দেখি নি। বারান্দা থেকে দেখছি, পাশের প্রতিটি বাড়ির বারান্দায়, ছাতে মানুষ মোবাইলে ভিডিও করছেন। কেউ তালি দিচ্ছেন। আমি হাততালি দিতে লাগলাম। পুচকি হঠাৎ প্রচণ্ড দ্রুততার সঙ্গে এঘর ওঘর ছুটে নিল, তারপর গম্ভীর হয়ে কার্নিশে উঠে পুরো ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগল, মাঝে মাঝে আমাকেও দেখতে লাগল। মনে হলো, পুরো ঘটনায় পুচকির সমর্থন আছে।
করোনা ডায়েরি/২৩ মার্চ, সোমবার
গতকাল রাতে ভেবেছিলাম আবার লিখব। কিন্তু আর লেখা হয় নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন সারাক্ষণ টিভিতে খবর শুনব না ঠিক করেছি। বাড়িতে কেউ নেই তাই টিভিটা চালিয়ে রেখেছি। কথাবার্তা শুনলে একা লাগে না। বহির্জগতের সঙ্গে সংযোগকারী যন্ত্র এটি। যেমন হাতের মোবাইল। তবে সারাক্ষণ মোবাইল আর টিভির খবর দেখলে মনে হবে একই কথা বারবার শুনছি। সবাই হোয়াটসঅ্যাপে করোনা নিয়ে জ্ঞান দিয়ে চলেছে। আমি অন্যকে জানাতে ব্যস্ত, কিছু না কিছু। অবশ্য সবসময় যে তা অন্যায় তা তো নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, প্রকাশেই আনন্দ। খেয়েদেয়ে আমরা হাঁটি, তাতে খাবার হজম হয়ে যায়। তেমন কোনও বই পড়লে তা অন্যকেও জানাতে, পড়াতে ইচ্ছে হয়, এটা তো নার্সিসিজম নয়।
নরেন্দ্র মোদীকে দেখুন। মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কী প্রচণ্ড ক্ষমতা। ওঁর প্রশংসা করলেই অনেকেই বলবেন আমি বিজেপি-র দালাল। কী মুশকিল। আমি উনি যা যা করেছেন ছ'বছরে, সব যে সমর্থন করেছি এমন নয়। সমালোচনার পরিসরটাও অনেকটা। আর সবচেয়ে বড় কথা, কেউ রাহুল গান্ধী তথা গান্ধী পরিবারের স্তাবকতা করলে তা কংগ্রেসের দালালি বলি আমরা? বলতাম, 'কমিউনিস্টদের দালাল' কথাটাও কলকাতায় খুব জনপ্রিয় ছিল। রাজপথের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হতো, 'সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দালালের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও'। সে যা হোক, আমাকে বিজেপি-র দালাল যদি বলেন, কী আর করব, শুধু এটুকু বলতে পারি, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার লাইন - 'বরং আস্থা রাখো দ্বিতীয় সত্তায়'। আমার সঙ্গে যদি আপনার মতের অমিল হয়, তা হোক, তবু শ্রদ্ধার সঙ্গে ভিন্নমতকে মানার অভ্যাস প্রয়োজন।
করোনা ডায়েরি/২৪ মার্চ, মঙ্গলবার
নরেন্দ্র মোদীর মতো কর্মকুশলী সুপ্রশাসক আমি কম দেখেছি। উনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, তখন কীভাবে ভুজের একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করেছিলেন, তা দেখেছিলাম খুব কাছ থেকে। গুজরাতের সে ভূমিকম্প কভার করতে সেখানে গেছিলাম। এখন দেখছি, তিনি কীভাবে করোনার মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সামলেছেন। প্রতিপক্ষকে একটা কথা মানতেই হবে, কোটি কোটি মানুষের আস্থা আছে মোদীর উপর; আছে বলেই তিনি এভাবে জনতা কার্ফুকে সফল করিয়ে দেন। তাঁর কথা মানুষ শুনেছেন।
একই ভাবে আজ রাতে তিনি যখন লকডাউন ঘোষণা করলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গে সব স্তরের মানুষ তা সমথ ন করেছে। অবাক লাগছিল, সিপিএম এবং রাজ্য কংগ্রেসের কিছু নেতা এখনও করোনা নিয়ে ছিদ্রান্বেষী। তাঁরা এখনও 'চােখে আঙুল দাদা'। তাঁরা বুঝতেই চাইছেন না, এ মুহূর্তে বিষয়টা বিজেপি বা সিপিএম বা কংগ্রেস নয়। এটা আজ গোটা বিশ্বের সামনে এসে আচমকা দণ্ডায়মান এক ভয়াবহ অসুর। পৃথিবীর গভীর, গভীরতম অসুখ এখন। এখনও কেন যে মোদী-বিরোধিতা করছেন জানি না। কয়েকদিনের জন্য ভাবতে পারছি না আমরা যে, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক, এদেশের মানুষের বিপুল সমর্থন নিয়ে তিনি ক্ষমতাসীন। সারাক্ষণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসনের নিন্দা না করে ভাবুন তো, আজ এক নড়বড়ে জোট সরকার যদি ক্ষমতাসীন হতো, তবে আজ যেভাবে করোনার প্রকোপ কমছে, চিকিৎসকরা বলছেন, তাও হতো না, নরেন্দ্র মোদী ভারতের এক দীর্ঘ সমাজ জীবনে ঢুকে পড়েছেন, এ তো অস্বীকার করা যায় না।
করোনা ডায়েরি/২৫ মার্চ, বুধবার
ইশ, এইমাত্র খবর পেলাম, মধ্যপ্রদেশের এক সাংবািদক করোনা আক্রান্ত। মানুষকে বুঝতে হবে, চাকরির চেয় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো জীবন। প্রবীণ এই রিপোর্টার কেন যে কমল নাথের সাংবাদিক বৈঠকে গেছিলেন, কে জানে।
আজ ছাতে গিয়ে গাছে জল দিলাম। গুনলাম, মোট ৬৮ টা টব আছে। কত ফুল হয়েছে। জবা, গোলাপ। তুলসী গাছ দুটোতে বেশি জল ঢাললাম। মনে হচ্ছিল, ওরা বেশি তৃষ্ণার্ত। কত পাখি এসেছে আজ ছাতে। নাম না জানা। ওদের সাহস মনে হয় বেড়েছে, একদম কাছাকাছি এসে ঝগড়া করছে, ভালবাসছে দুজনে মিলে। পালাচ্ছে না। হঠাৎ চােখে পড়ল, ছাতের কোণে পড়ে আছে পুত্রের শৈশবে কেনা বড় শখের পাখিদের জল আর খাবার দাওয়ার একটা খাঁচা। কতদিন বাদে ছাতে আসছি।
আজ রান্না করলাম। খিচুড়ি আর ডিমভাজা। রান্না করতে গিয়ে বেশি বাসন বের করলাম না, কেননা সব তো এখন নিজেকে ধুতে হবে। নরেন্দ্রপুরে আমরা রোজ নিজেদের বাসন নিজেরাই মাজতাম। কাপড় কাচতাম। রান্নাটা করি নি কখনও। ডাইনিং হলে গিয়ে সবাই একসঙ্গে খেতাম।
টিভিটা চালালাম নিচে এসে। দেখছি, মমতা কী প্রচণ্ড সিরিয়াস। কোনও সন্দেহ নেই, করোনাভাইরাস সামলাতে তিনিও পশ্চিমবঙ্গে অনবদ্য। মনে হচ্ছে না, এই মুহূর্তে ওঁর মাথায় অন্য আর কিছু আছে। খুবই মমতাময়ী। ঠিক যেভাবে মোদী দিল্লিতে করছেন, রাজ্যে মমতা করছেন। এই ক'দিনে দেখলাম দুজনের মধ্যে অনেক মিল আছে। দুজনেই ২৪×৭ রাজনীতি করেন। দুজনেই মাটি থেকে উঠে এসেছেন। দুজনেই জনপ্রিয় নেতা। দুজনেই টিপিক্যাল শহুরে অভিজাত নেতা নন। দুজনেই 'গ্রেট কমিউনিকেটর'। ভিডিও কনফারেন্স-এ দেখে মনে হয়, সরাসরি মানুষের সাথে কথা বলছেন।
লকডাউনে যাওয়ার আগে মোদী ভেবে নেন, ২১ দিনের মধ্যে ক'টা শনি, ক'টা রবিবার আছে, উৎপাদন ও অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হবে। রামনবমী থেক গুড ফ্রাইডে অনেকগুলো ছুটির দিন আছে। মমতা ভাবছেন, অসংগঠিত মুটেমজুর বাড়িতে থাকলে কীভাবে রোজগার করবেন? আর একটা ব্যাপার দেখছি, মমতা আর মোদী দুজনেই জানেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যকে আপাতত হাতে হাত মিলিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, হিন্দু-মুসলমান, মধ্যপ্রদেশের সরকার ভাঙা, এসব আপাতত গৌণ।
করোনা ডায়েরি/২৬ মার্চ, বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যায় ইউটিউবে ঠাকুরের আরতি চালালাম। বেলুড়ের সন্ধ্যারতি। 'খণ্ডন ভব বন্ধন জগ বন্ধন বন্দি তোমায়'।এই গানের সুর আমার শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে। চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান চলছে, শাহিনবাগের আন্দোলন কীভাবে নীরবে উঠে গেল করোনাতঙ্কে। দেখছি, তবু চার-পাঁচজন বসেছিল। উঠতে চাইছিল না। পুলিশ বাধ্য করল। কোনও সংবাদমাধ্যমে দেখলাম না, করোনার পরও শাহিনবাগ আন্দোলন প্রত্যাহার না করার নিন্দা করতে। সংখ্যালঘু বলে সাত খুন মাফ? কিছু মানুষ এমন ইডিয়ট কেন? এখনও সকালে বাজারে গিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে জিনিসপত্র কিনছে? যোগী আদিত্যনাথেরও উচিত হয়নি নবরাত্রির প্রথম দিনে রামলালার মন্দির নির্মাণ করতে গিয়ে এত ভিড়ের মধ্যে যাওয়া। কী দরকার বাবা এখন এসব করার?
করোনা ডায়েরি/২৭ মার্চ, শুক্রবার
দিন পরে যায় দিন। 'Inward journey'-র সুযোগ এসেছে। আমি ভালো আছি। মেইলবক্স ভর্তি হয়ে গেছে, অফিসের সিস্টেম থেকে ফোন, "আপনার মেইল বাউন্স করছে, প্লিজ খালি করুন!" রবীন্দ্রনাথের 'আগমনী' পড়ছি। 'লিপিকা'-র ছোট প্রবন্ধ। মন জিজ্ঞেস করছে আমাকে, কিছু বুঝতে পারলে? আমি বললেম, সেইজন্যই ছুটি নিয়েছি। এতদিন সময় ছিল না। তাই দেখতে পাই নি। শিউলি বনের শিউলি ফুল। ভোরবেলার একটি দােয়েল পাখি। এক অপূর্ব ঝকঝকে সকাল। মনে হচ্ছে চারদিকে দূষণ কমেছে।
অর্থনীতির শোচনীয় হাল, ভবিষ্যৎ কী হবে জানি না। গরীব নিম্নবর্গের মানুষ আরও গরীব হলে মধ্যবিত্তও সর্বহারা হবে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে আর ক'টা দিন। 'ন্যানো' পন্থা। হয়তো ঘন অন্ধকার কালো মেঘের চারধারে থাকে রূপালি রেখার বৃত্ত। রাত্রির তপস্যা দিনকে এনেছে চিরকাল।
প্রকৃতির এ এক অত্যাশ্চর্য প্রতিশোধ। ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে আবার। বদলাতে হবে জীবনধারার অন্ধ কিছু অভ্যাস। দৌড়তে গিয়ে ক্লোজ-আপে একে অন্যকে দেখি নি। 'Post truth' নামক এক ভার্চুয়াল বাস্তবতার জীবন-জগৎ তৈরি করে সবাই এক একটা ব্র্যান্ডের ভূত হয়ে নাচছিলাম ডান্স বার-এর ফ্লোরে। আধা অন্ধকার।
এখন একা একা ভাবছি। ভাবা প্র্যাকটিস করছি। নতুন পৃথিবীর ভাবনা।