একেবারে হতাশ হয়েছেন বেশ কিছু বাম ভাবনার বিদ্বজ্জন, যারা ভেবেছিলেন, বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার দেশের নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে টাকা আর বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেবে অন্তত কয়েক মাসের জন্যে। সে গুড়ে বালি। সম্পূর্ণ সংস্কারমুখী যে ঘোষণাগুলি পাঁচদিন ধরে চলল (প্রধানমন্ত্রী এক, আর দুজন অর্থমন্ত্রী মিলে চার, মঙ্গল থেকে শনি), তাতে গরীব মানুষদের প্রতি একটা বার্তা পরিষ্কার, 'খেটে খাও'। কোভিড পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের সংকট কাটানোর জন্যে এক ঝুড়ি উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যার সারকথা বেসরকারিকরণ এবং বিদেশী বিনিয়োগ। ক্যাপিটালিজমের তো আর পরিযায়ী শ্রমিকদের বাঁচানোর দায় নেই। সুতরাং রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ কিছু আশা না করাই ভালো।
তবে দেশের সাধারণ মানুষ তো সহজে মরবেন না, হাল ছেড়ে দিয়ে বসেও থাকবেন না। যতক্ষণ প্রাণ আছে, স্বাভাবিক নিয়মে মানুষ ঘরে ফেরার পথে হাঁটবেন। যেখানে তাঁরা কাজ করছিলেন সেখানে খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা আপাতত ফিরতে চাইবেন চেনা অঞ্চলে। তারপর বেঁচে থাকলে আবার অনেকটা ফিরতি পথ হাঁটা। পুঁজিবাদের পেন্ডুলামে শ্রমিকরা এভাবেই সরল দোলগতিতে আবর্তিত হন।
অন্যদিকে পুঁজিবাদ লিস্টি করবে সরকারি কোষাগারের অর্থে দরিদ্রকে সুবিধে দিলে বাজার অর্থনীতির কী কী ঝামেলা হবে। তাই জনগণের টাকার বেশির ভাগটা ঋণ হিসেবে যাবে বড় ব্যবসায়ীর কাছে। তাঁদের ব্যবসা যদি টিকে যায়, তবেই সেই সম্পদ চুঁইয়ে পড়বে নীচের তলায়। তাতেই বাঁচবে নিম্নবিত্ত। ব্যবসা ঘেঁটে গেলে সেই টাকা তামাদি। এমনটাই চলছে বিশ্বজুড়ে, বেশির ভাগ জায়গায়।
আরও পড়ুন: সাপ্লাই লাইন, মদ কিংবা ছড়িয়ে থাকা রুটি
একমাত্র প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে পুঁজিবাদ আংশিক সফল, কারণ সেখানে সরকার দায়বদ্ধ থাকে তার নাগরিকের প্রতি। দুর্নীতির পরিমাণ কম। ভারতের ব্যবস্থায় সে দায় নেই। কালোবাজারির রমরমা। সেই জায়গায় পুঁজিবাদের সংকট মোচনে কেন্দ্রীয় সরকার যে ঘোষণাগুলো করল তাতে দেশের ৮০ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলেই মনে হচ্ছে। এই কোভিড আকালে যদি বিদ্যুতব্যবস্থার সংস্কারের উদ্দেশ্যে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে নিম্নবিত্ত মানুষের অবস্থা কেরোসিন, ফলে হাতে হারিকেন আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহার করা যাবে।
নির্বাচনের সময় জনতার ভোট নিয়ন্ত্রণ করেন ছোটবড় নেতারা। একবার জিতে গেলেই কাজ শেষ। পরের ভোটের কিছুদিন আগে ভাবলেই চলবে। আগে তার মধ্যেও জেতা হারা ছিল। আজকের পরিস্থিতিতে বিজেপি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের তুলনায় এতটাই এগিয়ে যে সম্ভবত অন্যান্য দল আর কোনোদিনই লোকসভা নির্বাচনে জিততে পারবে না। কিছু রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করবে বিরোধী দলগুলি। এখন যেমন করছে। হয়ত বিজেপি অনেক বেশি রাজ্য সরকার নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেবে অন্যান্য দলের হাতে। কারণ তারা জানে যে এই দলগুলি লোকসভা নির্বাচনে কখনোই এক হতে পারবে না। রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলে তাদের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও ক্ষোভ জন্মাবে মতদাতাদের। ফলে কেন্দ্রীয় নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের তিরিশ শতাংশের কিছু বেশি জোটালেই কেল্লা ফতে।
সঙ্গে এটাও সত্যি যে ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির গুণগত মানও বিজেপির থেকে খুব আলাদা নয়। সেই হিসেবে আজকের পরিস্থিতি এভাবেই দেখা যেতে পারে যে যা করার তা বিজেপিই করবে। রাজ্য সরকারগুলো বিজেপির হলে সেখানে সরাসরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থা লাগু হবে। যেমন উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ কিংবা গুজরাটে বদলে যেতে চলেছে শ্রম আইন। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে টকঝাল সম্পর্ক চলবে, চিঠি লেখালেখি হবে। বিরোধী নেতা হিসেবে স্বীকৃতিটুকু যাতে টিভির পর্দায় অন্তত বেঁচে থাকে তাই রাহুল গান্দধি নাকমুখ ঢেকে দিল্লির রাস্তায় পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন। এদিকে কংগ্রেস-শাসিত পাঞ্জাব সরকার বিজেপির কাছে শিক্ষা নিয়ে লঘু করবে শ্রম আইন। মেনে নিতেই হবে যে স্ববিরোধিতা রাজনীতির প্রাথমিক উপাদান।
আরও পড়ুন: আরোগ্য সেতু বন্ধনেই মুক্তি না আরও বন্ধন করার জন্যই তৈরি এই মোবাইল অ্যাপলিকেশন?
এটা যদি পরিষ্কার হয়েই যায় যে সরকার সাধারণ মানুষকে ন্যুনতম সুবিধেটুকু দেবে না, তখন মানুষ তো পথে নামবেনই। এই অবস্থায় লকডাউন বেশিদিন চললে গরীব মানুষ একেবারেই খেতে পাবেন না। ফলে অশান্তি বাড়বে। খুব ধনীদের তাতেও বিশেষ অসুবিধে নেই। দেশের এক শতাংশ, অর্থাৎ দেড় কোটি মতো মানুষের হাতে ৭৩ শতাংশ সম্পদ। তাঁদের সুরক্ষা মিলবে অর্থের বিনিময়ে। কখনো সরকারই আইনরক্ষক, কখনো বা ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে কাজ চলবে।
মূল মুশকিল হবে দেশের মধ্যবিত্তদের। দেশে ২০ কোটির মত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত আছেন। দেশের অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। শহুরে নিম্নবিত্ত মানুষ পরিষেবা ক্ষেত্রে যে ধরনের কাজ করে বেঁচে থাকেন, তার বেশিরভাগটাই মধ্যবিত্তের দান। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিপুল বিনোদন ক্ষেত্র, এই গোটা জায়গাটা চালিত হয় মধ্যবিত্তের হাতে, যেখান থেকে চুঁইয়ে পড়া সম্পদের পরিমাণ অনেকটা বেশি। আজকের দিনে সেই ক্ষেত্র একেবারেই স্তব্ধ। লকডাউন ধীরে ধীরে কাটলেও, সেখানে কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। বিউটি পার্লার থেকে শপিং মল, ছোট রেস্টুরেন্ট থেকে পাড়ার সেলুন, এই জায়গায় মানুষ যাবেন কম। এই ধরনের ছোট ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্ত মালিক জমানো টাকায় বছরখানেক চালিয়ে নেবেন, কিন্তু এখানে কর্মরত নিচের তলার কর্মীদের কী হবে, তা একেবারেই জানা নেই। সমাধান যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, একথা তাই মানতেই হবে।
রাজ্য সরকারের কর্মদক্ষতা নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন। সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই খুব গোলমেলে, তবে অন্যদিক দিয়ে দেখলে, সীমিত ক্ষমতার মধ্যে তাদের করার কিছু নেই। তার ওপর আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি, যার কথা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেরাই মাঝে মাঝে স্বীকার করেন। একটা যুক্তি তাই ঘুরে বেড়াচ্ছে যে মানুষের হাতে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দিতে গেলে সেই টাকা রাজ্যে এসে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। সে কথা আপাতত থাক। আসা যাক রাজ্যের সীমাবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায়। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি। যেমন বেসরকারি বাসে লোক উঠবেন কম, এদিকে বাস ভাড়া বাড়বে না। যুক্তি দুদিকেই অকৃতকার্য। এই পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্তের হাতে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে ফাঁকা বাসে ওঠার ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে ভাড়া না বাড়লে ২০ জন যাত্রীর টিকিটের টাকায় জ্বালানির দামও উঠবে না। এর অনুসিদ্ধান্ত একেবারেই সরল, যে বেসরকারি বাস চলা খুব শক্ত।
আরও পড়ুন: হিপোক্রেটিক শপথ বনাম হিপোক্রিসি
শহরের মধ্যে সরকার বিপুলভাবে সাইকেল চালানোর কথা ভাবতে পারতেন, তবে তেমন কিছু উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ে নি। তাতে সব সমস্যার সমাধান হবে না জানাই আছে, তবে কিছুটা যদি সুরাহা হয়। রাজ্য সরকারের স্কুল খোলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক। এই পরিস্থিতিতে স্কুল খুললে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। রাজ্য সরকার পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল মাসে একবার করে বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে। সেটুকু বজায় রেখে স্কুলগুলো খোলার অনিশ্চয়তা দূর করা যেত খুব সহজে। আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে বাচ্চাদের অগাস্ট মাস পর্যন্ত স্কুলে আসতে না দেওয়াই উচিৎ। এতে পরিবহণের ওপর চাপও কিছুটা কমবে। তবে এর বিরোধী যুক্তিও যে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
এই ধরণের বিভিন্ন উদাহরণ হাতে নিলে বোঝাই যাবে যে সমাধানের পথ বাস্তবে কতটা কঠিন। কিছু রাজ্য সরকার অবশ্য এর মধ্যেই অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে কেরালার সাফল্যের কথা উঠে আসছে বারবার। তবে একই সঙ্গে মেনে নিতেই হবে যে বিজেপি শাসনে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যের ক্ষমতা একেবারে সীমিত। বিশেষ করে যেখানে মূল প্রয়োজন আমজনতার কাছে প্রচুর খাদ্য এবং অর্থের যোগান।
এ লেখাটা তাই হঠাৎ করে আগের অনুচ্ছেদেই শেষ করে দেওয়া যেত। অদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে ঠিক কোন দিকে যে যাওয়া যাবে, তা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না। বিচ্ছিন্ন উদাহরণ যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, তা বোঝাই যাচ্ছে। একমাত্র পথ কেন্দ্রীয় সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া। বিজেপি এবং আরএসএস-এর মধ্যেও অনেক রাজনৈতিক নেতা কর্মী আছেন, যাঁদের পথে নেমে কাজ করতে হয়। তাঁরা নিশ্চয় দেখছেন দেশের হাল। মধ্যপ্রদেশে না খেতে পাওয়া শ্রমিক বিক্ষোভে পুলিশের লাঠি চালানোর খবর এসেছে।
রাহুল গান্ধী নন, আজকের সমস্যার সমাধান নরেন্দ্র মোদীর হাতেই। আরএসএস-বিজেপি-র চিন্তন দল বিনীত আবেদনে একবার কান দেবেন কি? পুঁজিবাদের সঙ্কট মুক্তিতে ৮০ কোটি নিম্নবিত্তের অসহায়তা কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে দেশে গৃহযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। সেটা এড়াতে পারাটাই মঙ্গল, যে শুভ বারে প্রধানমন্ত্রী ২০ লক্ষ কোটি আলাদা করে রেখেছিলেন।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন