এক মিনিট। আমার এই লেখাটি পড়া শুরু করার আগে আপনাকে একটা ছোট্ট অনুরোধ। দয়া করে কিছুক্ষণের জন্য আপনি ভুলে যান নরেন্দ্র মোদী-মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সুমন-সেলিম-অধীর-সৌমেন। কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতার প্রতি আপনার আস্থা-আনুগত্য থাকতেই পারে। কোন অন্যায় তো নেই। কিন্তু আজ আমি যে লেখা লিখছি, তা কোভিড-১৯ অর্থাৎ করোনা নামক এক ভাইরাসের কাহিনী। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এ প্রবন্ধ। যা লিখছি, বিশ্বাস করুন, কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেই।
আমি মনে করি, করোনাভাইরাসের জন্মদাতা মোদী বা মমতা কেউই নন, হয়তো এ ভাইরাস সংক্রমণের জন্য গুহাবাসী কিছু চিনে বাদুড়কে দোষী সাব্যস্ত করা যায়, কিন্তু তাও বলব না। ভাইরাস প্রতিহত করতে মোদী বেশি ব্যর্থ না মমতা, সেসবও আগামী নির্বাচনের জন্য তর্কের বিষয় হতে পারে। কিন্তু প্লিজ, এই রচনায় হাজার শব্দ পড়ার সময় আসুন আমরা এই ভাইরাস আর মানুষের দুঃসময়ের কথাই ভাবি।
এ এক দুঃসময়। চিনা সমর বিজ্ঞানী সান সু (Sun Tzu) তাঁর পৃথিবী-বিখ্যাত বই 'দ্য আর্ট অফ ওয়ার'-এ লিখেছিলেন, জয়লাভের জন্য শত্রুকে সঠিকভাবে জানা সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। এই যে করোনাভাইরাসের আকস্মিক বিশ্বজোড়া আক্রমণ, আমরা আজও আমাদের এই ভয়াবহ শত্রুকে সম্পূর্ণ জানতে পারি নি। দুনিয়ায় প্রথম জেনেছে জার্মানি, জানুয়ারি মাসে। আজ চার মাস পর এ দেশের নাগরিক হিসেবে এই গণশত্রু সম্পর্কে কী জানলাম আমরা? জানলাম, ভাইরাসের পোশাকি নাম, SARS-Cov-2 বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিনড্রোম, করোনাভাইরাস-২। ভাইরাসটির আকার মাত্র ১২০ ন্যানোমিটার। এই ভাইরাস আক্রান্ত হলে যে রোগ হচ্ছে, তার নাম কোভিড-১৯। ডাক নাম করোনা।
আরও পড়ুন: সংক্রমণ না কমলেও অবশেষে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হয়েছে
এই রোগ প্রতিহত করার জন্য দুনিয়ায় এখনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয় নি। রোগ প্রতিরোধে ঠিক কী কী করা উচিত, আর কী কী করা উচিত নয়, সেটাও আমরা অন্ধের মত হাতড়াচ্ছি আর স্যোশাল মিডিয়ায় - ফেসবুক- টুইটারে গত দু'মাস ধরে কত রকমের উপদেশ দেখছি, ভাবা যায় না। কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে অসত্য, ফেক নিউজ, বোঝা দায়। আমি নিজেও গত একমাস ধরে কার্যত গৃহবন্দী। প্রথম প্রথম অফিস যাচ্ছিলাম, এখন আমার বয়স এবং দিল্লির প্রকোপের ভয়াবহতার কারণে আমাকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন আমার কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু টিভি খুললেই দেখছি, একদিকে মৃত্যুর প্রকোপের শতকরা হার হু হু করে বাড়ছে, আর অন্যদিকে লকডাউন তুলে নেওয়া হচ্ছে। মল খুলছে। মন্দির খুলছে। বাসে-ট্রেনে মানুষ যেভাবে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অফিস যাচ্ছেন, টিভিতে সে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠছি। শুধু তো কলকাতা নয়, মুম্বই, দিল্লি, সর্বত্রই একই চিত্র।
শত্রুকে জানাটা আজ তাই সবচেয়ে জরুরী। খোঁজ নিলাম, এ ব্যাপারে কোনও উপযুক্ত ব্যক্তি কোনও বই লিখেছেন কিনা। বাংলায় কেন, ইংরাজিতেও কোনও ভারতীয়ের কোনও বই দেখলাম না। কারোর জানা থাকলে জানাবেন। একটা বই পেলাম। লেখক ডাঃ মিচেল মোসলে, লন্ডনের চিকিৎসক। বিবিসিতে ২৫ বছর বিজ্ঞান সাংবাদিকতা করেছেন। বিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রায় দশটি বেস্টসেলার বই লিখেছেন। তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই 'কোভিড-১৯ - হোয়াট ইউ নিড টু নো অ্যাবাউট দ্য করোনাভাইরাস অ্যান্ড দ্য রেস ফর দ্য ভ্যাকসিন'। ১৩৮ পৃষ্ঠার বইটি পড়লাম এবং তার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, এই ভাইরাস রোধ নিয়ে আমাদের অনেক ভুল ধারণা আছে। সেসব ভুল ধারণা দূর করা বড় জরুরী। সে সব কথায় আসছি।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে চিনা অনুপ্রবেশ, অভিসন্ধি বোঝা জরুরি
তার আগে বলি, এই ভাইরাস সবচেয়ে বড় যে বিপদ সৃষ্টি করেছে, তা মানুষের। ধরুন, দিল্লিতে বিখ্যাত হনুমান মন্দির খুলে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রকোপ আটকাতে দূর থেকে দর্শন করতে হবে। প্রসাদ দেওয়া/খাওয়া চলবে না। আবার এই মন্দিরের বাইরে দেখতাম, বহু ভিখারি এসে বসেন সারিবদ্ধ ভাবে। হুইলচেয়ারে বসা কুষ্ঠরোগী অথবা বিকলাঙ্গ মানুষও। এখন করোনার জন্য তাঁদেরও বসা নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন, এই গরীব ভিখারিরাই বা এখন বাঁচবেন কী করে? সরকারের পক্ষে দেশের ভিক্ষুকদের ভতুর্কি দেওয়া সম্ভব নয় আমেরিকা বা ব্রিটেনের মতো। ১৩৫ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাট জনশূন্য। সেখানেও সিঁড়িতে বসে থাকা ভিক্ষুকেরা কোথায় গেলেন? অথবা বৃন্দাবনের বিধবা রমণীরা? করোনা না হোক, তাঁরা তো অর্থাভাবেই মৃত্যুমুখে পতিত।
পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে হচ্ছে। অর্থনীতি বিপযস্ত। আমরা লকডাউন করেছি ২৫ মার্চ থেকে। তার আগে পৃথিবীর অন্য দেশগুলি করেছে। যখন বিদেশে শিথিলতা ছিল, তখন ওখানে বেশি মানুষ মারা গেছেন। আমাদের দেশে কঠোরতা থাকায় তখন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম। এখন লকডাউন শিথিল হচ্ছে তো মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তাহলে সাধারণ মানুষ করবে কী? লকডাউন উঠে যাচ্ছে। অফিস যেতে হবে। কিন্তু যথেষ্ট বাস নেই। গা ঘেষাঁঘেষিঁ করে পাগলের মতো অফিস যাচ্ছেন। আবার করোনার জন্য প্রয়োজন সামাজিক আইসোলেশন। 'স্টে হোম, স্টে সেফ'। এর চেয়ে বড় দ্বন্দ্ব, এর চেয়ে বড় সংশয়, আর কী হতে পারে?
বইটির প্রসঙ্গে আসছি। এই বইটি থেকেই জানা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাসের শেষে সাংহাই থেকে এক চিনা মহিলা জার্মানির মিউনিখে আসেন। গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণের এক কারখানা পরিদর্শন করেন তিনি। কয়েকদিন সেখানে ছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়েন সেখানেই। তখন তাঁর মনে হয়, জেটল্যাগ জনিত অসুস্থতা। কিন্তু সাংহাই ফিরে তাঁর অসুস্থতা বাড়তে থাকে। মধ্যবয়স্ক সেই মহিলার হালকা ফ্লু হয়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর করোনা হয়েছে। জার্মানরা সঙ্গে সঙ্গে তাদের কারখানায় আরও টেস্ট চালায়। সে কোম্পানিতে আটজনের মধ্যে করোনা ছড়ায়। তাঁদের মিউনিখ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, হাজার হাজার বছর ধরে দক্ষিণ চিনের কিছু দুর্গম এলাকার গুহায় বহু 'horseshoe' (যেহেতু তাদের নাকে ঘোড়ার খুরের মতো চিহ্ন রয়েছে) বাদুড় ছিল। সেই বাদুড়গুলি থেকেই এই ভাইরাস এসেছে। ২০১৩ সালে এই বাদুড়ের গুহা থেকে বিপজ্জনক 'প্যাথোজেন' আসে। চিনের বিজ্ঞানীরা উহানের ভাইরোলজি প্রতিষ্ঠানে এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছিলেন। হার্ভার্ডের বিজ্ঞানীরা তখন সর্তক করেছিলেন, এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণা মারাত্মক। মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। তবে চিনে এই বাদুড়-করোনা ভাইরাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদের প্রধান ডাঃ সি ঝেংলি বলেছেন, যে ভাইরাস থেকে করোনা হচ্ছে আর যে বাদুড় ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয়েছে, দুটির 'জিনোম' আলাদা। কাজেই এই রোগটির সাথে বাদুড় ভাইরাসের কোনও সম্পর্ক নেই, বলছে চিন। মানছেন না ট্রাম্প। এই বিতর্কের অবসানও হওয়া উচিত।
আরও পড়ুন: করোনা-আমফান, এবং বাঙালির আত্মপরিচয়
এই বইটি থেকে আরও জানতে পারছি, পাশাপাশি মানুষ হাঁটলেও করোনা নাও হতে পারে। আপনি সারাদিনে একশো মানুষের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তাতে কিন্তু করোনা হবেই এমন নয়। কিন্তু একশো জনের মধ্যে যদি একজনেরও মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ থাকে, তবে আপনি করোনা-পজিটিভ হতেই পারেন। দ্বিতীয়ত, অনেক সময়ই উপসর্গ ছাড়াও আপনার মধ্যে করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। আপনি এখন জানতেও পারলেন না। অতীতে সর্বক্ষেত্রেই ভাইরাস প্রতিরোধে প্রতিষেধক আবিষ্কারে অনেক বছর সময় লেগেছে। এই অসুখটি হয়তো মহামারী হবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই রোগটির সঙ্গেই আমাদের বাঁচতে হবে। যেমন এ সমাজে আজও টিবি বা নিউমোনিয়া, ডেঙ্গি, এমনকি এডস্ রোগেও বহু মানুষের মৃত্যু হয়। সেক্ষেত্রে মানুষের সার্বিক রক্ষার দায়িত্ব কোনও রাষ্ট্র বা সরকার নিতে পারে না। নিজেকেই নিজের জীবন রক্ষার জন্য সচেতন হতে হবে।
কতটা দূরে থেকে আমাদের মাদার ডেয়ারির দুধ নিতে হবে, মন্দিরে যেতে হবে, বা বাসে উঠতে হবে, তা কিন্তু আমাদেরই জানতে হবে। করোনা দেবীর পুজো হচ্ছে কলকাতায়; হঠাৎ কিছু মানুষ বললেন, করোনা নামক রাক্ষস দমনে নতুন দেবীর আবির্ভাব হয়েছে। তাঁর পুজো করা হচ্ছে, তিনি রাক্ষসটাকে মারবেন। হায়, আজ ২০২০-তে এই কুসংস্কারের বশবর্তী হব আমরা? কেউ বললেন, ওজন কমালে নাকি এখন করোনা হতে পারে। তাতে নাকি ইমিউনিটি কমে যাবে। এও এক কুসংস্কার-অবিজ্ঞান।
লেখক ডাঃ মোসলে বলেছেন, বরং ওজন কমান। সপ্তাহে দু'দিন পারলে অর্ধ-উপবাস করুন। পরিশ্রম করুন। ব্যায়াম করুন। যাতে বিপাক ভালো হয়। ওজন কমলে, বিপাক ভালো হবে, শরীরের ইমিউনিটি বাড়বে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে ভিটিমিন সি খেলে করোনা হবে না, এর কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ এখন নেই। বরং ভালো ঘুম দরকার। রাতের ঘুম। তাই বলছি, রাজনীতি থাক রাজনীতির জায়গায়। কিন্তু আপাতত শত্রুকে দমন করার জন্য শত্রুকে ঠিকমতো চিনুন। শত্রুকে জানুন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন