আর তো পারা যাচ্ছে না! থালা বাজাও, মোমবাতি জ্বালাও, ডিগবাজি খাও... পুনঃপুনঃ নির্দেশে একেবারে স্থির বিশ্বাস হয়ে গেছে যে দেশদুনিয়ায় করোনা ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই। করোনা এক দেবীর রোষ, কোনোরকমে নানা আচার ও সেই আচার পালনের জন্য আমি কিছু সেবামূলক ব্যবস্থা নেবার মত কয়েকটি কাজ করলেই করোনার রোষ থেকে আমরা সবাই মুক্তি পাব।
কার সেবামূলক? কী অদ্ভুত! আমি দেশের শীর্ষব্যক্তি, আমার সেবাই তো দেশের সেবা। আমার স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া দেশের কি আবার কোন আলাদা এজেন্ডা আছে নাকি? যদি থাকত, তাহলে এতগুলি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ না কেউ কি সেই কথা নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলতেন না? এই করোনাযজ্ঞের অনুষ্ঠানে সকলেই একমত হয়ে যোগ দিয়েছেন, এতেই প্রমাণ হল যে এইকাজটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। এ প্রায় রামায়ণে উল্লিখিত অশ্বমেধ যজ্ঞের মতই বিরাট সফল ও উন্নয়নমূলক সাফল্য। এজন্য আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে, ব্যক্তিগত নামে সেবার খরচ তুলছি, যাঁরা এখানে অর্ঘ দেবেন তাঁদের কালো টাকা সাদা হবে, হারানো টাকা ফিরে আসবে, রমরমার অন্ত থাকবে না। সে টাকা খরচের কোন হিসেবও দিতে হবে না। দানের কি হিসেব থাকে কোন...
অকর্মণ্য বৃক্কের ভাইরাস মারবে প্রদীপের দৈত্য
ইত্যাকার ঢক্কানিনাদে আমরা গত প্রায় পনের দিনে আর কিছু ভাবতে পারছিনা। আমরা এই অভাগা দেশের অভাগা সাধারণ লোকজন যাদের কোথাও টাকা বা নিরাপত্তা জমানো নেই। বাজার বন্ধ কিন্তু ঠিক বন্ধও নয়। মোটামুটি খাদ্যবস্তু গোড়াতেই একশ্রেণির গৃহপতিরা এত প্রচুর পরিমাণে সঞ্চয় করে রেখেছেন যে আগামী ছয়মাস লক ডাউন চললেও তাঁদের খাদ্যবস্তু ও জ্বালানির সমস্যা হবে না। কিন্তু মাসের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে যে অনেক অনেকগুলো লোকের হাতে একটা পুরোমাসের রসদ এবং ওষুধপালা একসঙ্গে কিনে ফেলার টাকা থাকে না, তাঁদের কা হবে? কী হবে পাড়ার মধ্যেকার সেই ছোট দোকানগুলোর মালিকদের যাঁরা পাইকার বা মহাজনের থেকে বাকিতে মাল নিয়ে আসেন, বিক্রি হলে টাকা দিয়ে পরের মালটা নেন? এক আধটু দূর থেকে সাইকেলে, ঠেলায়, লোকাল ট্রেনে ঝুড়ি চাপিয়ে মাছ সবজি এনে যাঁরা শহরের খাবার যোগান, শহর নিজে তো কিছু উৎপাদন করে না- আবর্জনা ছাড়া!
একথা নতুন নয়, শহরের দাপটের তাপ বেশি কিন্তু শহর কোনদিন স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। কিন্তু গ্রামও যে কী দীন দশায় পৌঁছেছে সে কথাও বোধহয় এমন তীব্রভাবে চোখে পড়েনি এতদিনে। ভারতবর্ষের, বইয়ে লেখা থাকত সত্তরভাগ, বাস্তবে আরেকটু বেশিও হতে পারে, ম্নানুষ বাস করতেন গ্রামে, অর্থাৎ তাঁরা কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কেবল হাতে করে চাষ করা নয়, সেই কাজের বা জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত বহু অনুসারী কাজের সঙ্গে। এবং সেই জীবন মানুষকে একটি নিজস্ব সদর্থক বোধ দিয়েছিল। গত মাত্র পঞ্চাশ বছরে বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের অভ্যস্ত খাদ্য উৎপাদনের জীবিকা কী ভয়ংকরভাবে একেবারে মূল থেকে ধ্বংস হয়েছে, করোনা অতিমারী সে বিষয়ে আমাদের চোখ বিস্ফারিত ভাবে খুলে দিয়ে গেল। করোনা প্রসঙ্গে এই কথা এল মূলত দুটি কারণে।
প্রথমত, প্রথাগত কৃষিকাজের যে ধরন তার ছিল এক অতি বিস্তৃত, জটিল ব্যাকরণ। সেখানে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মগুলিকে পাঠ করা ও সেইমত চলা ছিল আবশ্যিক। সেই ধরণের কাজে সমস্যা ছিল, কিন্তু সেই সমস্যাগুলিও প্রাকৃতিক নিয়মেরই অংশ। আমাদের দেশের প্রবল গ্রীষ্ম বা কানাডার তীক্ষ্ণ শীতকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে বুঝতে না পেরে, মেনে নিতে অভ্যস্ত হবার বদলে তাকে ‘নিজের স্বাচ্ছন্দ্য’ অনুযায়ী পালটানোর চেষ্টা একরকমের অ-বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার। প্রাকৃতিক নিয়মসমূহের মধ্যে থেকে যতখানি পারা যায় স্বচ্ছন্দ থাকতে শেখাই সভ্যতা। সেই জীবনযাপন থেকে দূরে সরতে সরতে এক অ-প্রাকৃতিক অলীক উন্নয়নের স্বপ্নকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করে, প্রকৃতির মূল নিয়মগুলিকে অবিমৃষ্যকারিতায় লঙ্ঘন করে কিছু মানুষ বাকি সব মানুষের শুধু নয়, জীবজগতের ভবিষ্যতকে ‘মুনাফার বিজ্য’ বলে বাজি রেখেছে। ইবোলা, এইডস, নভেল-করোনার মত দুর্যোগ তার অবশ্যম্ভাবী ফল। এগুলো কোন রোমাঞ্চকর কল্পবিজ্ঞানের বহির্জগত থেকে আসা এলিয়েনদের আক্রমণ নয়। অথচ সেই সভ্যতার ভিত্তিটি পৃথিবীময় পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করা হয়েছে অগ্রগতির নামে।
লকডাউনের রোজনামচা – এখন লড়াই, ভবিষ্যতে কী?
দ্বিতীয়ত কৃষিভিত্তিক দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে তুচ্ছ কেনাবেচার বস্তু করে তোলার দরুণ স্বাভাবিক জীবিকা হারানো লক্ষ লক্ষ মানুষ শেকড় ছিঁড়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ছেঁড়া কাগজের মত উড়ে বেড়াচ্ছেন। কোন স্থায়ী আশ্রয় নেই, কোন মূল্যবোধ সম্পন্ন জীবনযাপন নেই একসময়ের এই দরিদ্র কিন্তু গৃহস্থ মানুষগুলোর। এঁদের এক বড়ো অংশ কোনমতে বেঁচে থাকেন বেআইনি খনিতে, পাথর খাদানে, নানান বিপজ্জনক জীবিকায়। উঞ্ছবৃত্তিতে, গুন্ডামিতে, হরেকরকম ভিখারীপনায়। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, বিপর্যয়, এঁদের জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা। করোনায় কী আসে যায় এঁদের? মাটি চাপা পড়ে জীবন্ত কবর হওয়া, টিবি কিংবা সিলিকোসিসে মরা, সন্তানদের অনাহারে থুড়ি পুষ্টিহীনতায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখা যাঁদের পরিচিত হয়ে গেছে? যে কথা আমরা জানি না, তা হল এই মানুষদেরও এক সমাজ আছে। এঁদের সঙ্গে সঙ্গেই চলে সেই সমাজও। তাঁদের ঠিকা কাজ, দিন আনা দিন খাওয়ার কাজও বন্ধ হয়ে গেল। একেবারে নিঃসহায় ভবিষ্যতহীন মানুষগুলো তখন রওনা দিয়েছেন নিজেদের আবাসের দিকে, অন্তত যেসকল জায়গাকে অনেককাল ধরে এঁরা আবাস বলে জেনেছেন, সেই দিকে। যেখানে অনেকেরই বাকি পরিবার আছে। সেই ফিরে যাবার পথে এঁরা পাচ্ছেন যা এঁদের প্রাপ্য ছিল- অস্নাত অভুক্ত শরীরগুলির ওপরে বিষাক্ত রাসায়নিকের বর্ষণ, নিরাশ্রয়, অবহেলা। কাগজে আমার সহ-নাগরিক হলেও সত্যি তো আর এঁরা আমাদের মতন নন!
COVID-19: সমষ্টির লড়াই
একদিন হয়ত এই নভেল-করোনার প্রকোপও কমবে। আমরা আবার ছাড়া পাব গৃহবিশ্রান্তির বন্দিত্ব থেকে বাইরের জীবনযাপনে। হয়ত অনেকেই আশা করে আছেন, আবার ফিরে আসবে অভ্যস্ত রোমাঞ্চকর সুখবিলাসিতার পরিশ্রম ও অবকাশ! কবিতা ও নাট্য-উৎসব হবে করোনা নিয়ে। হয়ত আসবে। জানি না। কেমন যেন ভয় হয়- এমন তো হতে পারে আমরা জারোয়াদের থেকে, আফ্রিকা অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছি, মাতৃভাষা বুঝতে পারি না আর। পিঁপড়ে, ফড়িং, পাখিদের দেখতেও ভুলে গেছি। হয়ত প্রকৃতি সতর্ক করছেন। ব্যস্ত ব্যাকুল হয়ে সাবধান বাণী পাঠাচ্ছেন আর আমরা ভাবছি তাকে আমাদের উন্নয়নের চূড়া! কে জানে!
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে ক্লিক করে
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন