যখনই বড় ধরণের হাতবদল ঘটে ভারতের মতো দেশে, সে টাকাই হোক বা খাদ্যসামগ্রীর, আমাদের যথেষ্ট চিন্তায় পড়তে হয়। কোনও মধ্যবর্তী দালালের হাতে হয়তো ওই টাকা বা খাদ্য গিয়ে পড়ল, সে সাধারণ করদাতার টাকায় বড়লোক হয়ে গেল, এমন একটা সম্ভাবনা চিন্তার উদ্রেক করে বৈকি। একদিক থেকে দেখলে, যে 'খারাপ কিছু দেখব না' জাতীয় আশাবাদ থেকে জন্ম নিয়েছে সরকার-পরিচালিত হোটেল বা নদীবক্ষে 'বিলাসবহুল' প্রমোদ ভ্রমণ, সেখান থেকে সরে আসাটা জরুরি বটে। কিন্তু এই মহামারী এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়, যখন লকডাউনের কবলে দেশ, এবং জীবন ও জীবিকা দুইই সঙ্কটে, তখন এইসব সম্ভাবনা নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে চলে না।
লকডাউন যে আরও বেশ কিছুদিন চলবে, তা যতই স্পষ্ট হচ্ছে, সে স্থানীয় ভাবেই হোক বা সামগ্রিক ভাবে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র গ্রাস করার সম্ভাবনা, এমনকি তাঁদের অনাহারে মৃত্যুর সম্ভাবনাও। এর একটা কারণ জীবিকার অভাব, পাশাপাশি স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় রকমের ব্যাঘাত। নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক, কিন্তু এতেই শেষ নয়। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যাপক হারে লকডাউন ভাঙা হবে - কারণ অভুক্ত মানুষের হারানোর বিশেষ কিছু নেই। বৃহত্তর সমাজ যে তাঁদের নিয়ে চিন্তিত তা তাঁদের বোঝানো, এবং তাঁদের ভালো থাকার ন্যূনতম রসদ নিশ্চিত করা, এখন আশু প্রয়োজন।
সেই রসদ কিন্তু আমাদের আছে; চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার ভাণ্ডারে মজুদ ছিল ৭৭ মিলিয়ন (৭.৭ কোটি) টন খাদ্য, যা বছরের এই সময়ে অতীতে প্রায় কখনোই দেখা যায় নি, এবং যা যথাবিহিত নিয়মের অনুপাতে তিনগুণেরও বেশি। 'রবি' শস্য, অর্থাৎ শীতকালে রোপিত কৃষিজাত ফসল, ঘরে তোলা হলে আগামী কয়েক সপ্তাহে আরও ফুলেফেঁপে উঠবে এই ভাণ্ডার। লকডাউনের ফলে কৃষিপণ্যের বাজারে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বুঝে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনার ব্যাপারে সাধারণের চেয়ে বেশিই সক্রিয়। অতএব রাষ্ট্রের জরুরি অবস্থার সময়ে বর্তমান ভাণ্ডার থেকে কিছু যদি বিতরণ করাও হয়, কোনও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবরক্ষণ ব্যবস্থাই তাকে অত্যধিক ব্যয়বহুল বলতে পারে না।
বস্তুত, ইতিমধ্যেই এই ভাণ্ডারের সদ্ব্যবহার করার ইচ্ছাও প্রদর্শন করেছে সরকার - আগামী তিনমাস রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতি মাসে গ্রাহক পিছু পাঁচ কেজি অতিরিক্ত খাদ্য বণ্টনের ঘোষণা করে। তবে এই তিনমাস যে যথেষ্ট হবে না, তা এখন মোটামুটি স্পষ্ট, কারণ লকডাউন উঠে গেলেও অর্থনীতি উন্মুক্ত করার প্রক্রিয়াতে অনেকটা সময় লাগবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো, দেশের দরিদ্র মানুষের এক বড় অংশ রেশন ব্যবস্থার আওতায় পড়েন না, সে যে কোনও কারণেই হোক (যেমন রেশন কার্ড পেতে গেলে যে শনাক্তকরণ প্রয়োজন, তা করতে না পারা)। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানতে পেরেছি যে ঝাড়খণ্ডের মতো ছোট রাজ্যেও আটকে আছে আন্দাজ ৭ লক্ষ রেশন কার্ডের আবেদন। এছাড়াও প্রচুর সংখ্যক যথাযথ আবেদন (ধরুন পেনশনভোগীদের কাছ থেকে) যে শনাক্তকরণ স্তরেই আটকে আছে, তারও প্রমাণ রয়েছে, মূলত জাল নথিভুক্তিকরণ রুখতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সাবধানতার কারণে।
এই অতিরিক্ত সাবধানতার ভালো দিক অবশ্যই রয়েছে, তবে এই সঙ্কটের মুহূর্তে নয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজন আবেদন জমা পড়লেই ন্যূনতম পরীক্ষার পর অস্থায়ী রেশন কার্ড বিলি করা - ধরুন ছ'মাসের জন্য - যাতে কেউ লাইনে দাঁড়িয়ে মাসিক রেশন তুলতে ইচ্ছুক হলে তুলতে পারেন। যাঁদের সত্যিই রেশনের দরকার নেই, তাঁদের এই ব্যবস্থার বাইরে রাখার প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর কর্তব্য হলো অনাহারের মুখে পড়া মানুষদের রেশন সরবরাহ করা।
এই কথাটা অনুধাবন করতে হবে, কারণ এর নানান তাৎপর্য রয়েছে। প্রথমত, কেউ যাতে অভুক্ত না থাকেন, তা নিশ্চিত করতে সবরকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে সরকারকে। এর মানে শুধু গণবণ্টন ব্যবস্থা প্রসারিত করাই নয়, পরিযায়ী বা ঘরছাড়াদের জন্য পাবলিক ক্যান্টিন খোলা, স্কুলের মিড-ডে মিল (বা তার সমতুল্য) সেইসব শিশুদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যারা বর্তমানে বাড়িতে আটক (যে প্রক্রিয়া কিছু রাজ্যে শুরু হয়েছে), এবং একেবারে প্রান্তিক মানুষদের কাছে পৌঁছতে স্থানীয় কোনও নির্ভরযোগ্য এনজিও-র সাহায্য নেওয়া, যেহেতু তারা এমন অনেক ক্ষেত্রে যাতায়াত করে, যেখানে সরকারের নাগাল পৌঁছয় না।
দ্বিতীয়ত, অনাহার স্রেফ একটা দিক; রোজগার এবং সঞ্চয়ের ওপর এই অপ্রত্যাশিত আঘাতের অন্যান্য অনেক গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে, খাওয়াদাওয়ার চিন্তা মিটে গেলেও: নতুন ফসল রোপণের জন্য বীজ কেনার টাকা প্রয়োজন কৃষকদের; দোকানের তাক ফের কীভাবে ভরবে, তা ঠিক করতে হবে দোকানদারদের; আরও অনেকে কীভাবে বিভিন্ন ঋণ শোধ করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত। সামাজিক স্তরে এই সমস্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে উপেক্ষা করতে পারি না আমরা।
কিছু গোষ্ঠীকে টাকা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এই সমস্যার আংশিক মোকাবিলা করেছে সরকার; কিন্তু সেই টাকার পরিমাণ যেমন কম, তেমনই প্রাপকদের পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ। শুধু কৃষক কেন? ভূমিহীন শ্রমিকদের কী হবে? বিশেষ করে যেখানে লকডাউনের ফলে অচল হয়ে পড়েছে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন (Mahatma Gandhi National Rural Employment Generation Act বা MGNREGA)? এছাড়াও সাহায্যের প্রয়োজন শহরাঞ্চলের দরিদ্রদেরও। এবং আবারও সকলকে সাহায্যের আওতায় আনতে হলে কিছু ভুলত্রুটি হলেও তা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। পি চিদাম্বরম বলেছেন ২০১৯ সালের MGNREGA তালিকা ব্যবহার করার কথা, পাশাপাশি 'জন আরোগ্য' এবং 'উজ্জ্বলা' প্রকল্পপের মাধ্যমে দরিদ্র গৃহস্থালিগুলিকে চিহ্নিত করে তাদের প্রত্যেকের 'জন ধন' অ্যাকাউন্টে ৫,০০০ টাকা করে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। প্রথম ধাপ হিসেবে তা করা যেতেই পারে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এইসব তালিকার কোনোটিই সম্পূর্ণ নয়, এবং সাম্প্রতিক কালে রোহিণী পাণ্ডে, কার্তিক মুরলীধরন প্রমুখ দেখিয়ে দিয়েছেন যে একেবারে হতদরিদ্রদের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে অনেক ফাঁক রয়ে গিয়েছে 'জ্যাম' (JAM বা Jan Dhan-Aadhaar-Mobile) পরিকাঠামোয়। সুতরাং এঁদের কাছে পৌঁছতে গেলে রাজ্য এবং স্থানীয় স্তরে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা প্রয়োজন।
এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সাহসী এবং অভিনব চিন্তাধারার প্রয়োজন। আগামী কয়েক মাসে যে বিপুল অর্থের দাবি উঠতে চলেছে, সেকথা মাথায় রেখে বিচক্ষণভাবে খরচ করা উচিত, কিন্তু যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, তাঁদের ক্ষেত্রে হাত খুলে খরচ না করলে কিন্তু অচিরেই পথ হারাব আমরা।
(অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, রঘুরাম রাজন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন