Advertisment

প্রবাসে, দৈবের বশে...করোনার পূর্ণগ্রাসে

প্রচুর প্রবীণ ও বৃদ্ধ দম্পতি আছেন এদেশে, যাঁদের সন্তানেরা বিদেশে থাকেন। যাঁরা পারেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus indian students abroad

প্রতীকী ছবি

"এখানে আমার মতো আরও অনেক ভারতীয় ছাত্র আছে, বাঙালিও। যে যেখানে থাকে, কাজের সূত্রে বা পড়াশোনার জন্য, তখন সেটাই তার বাড়ি হয়ে যায়। আর কেমব্রিজের পরিবেশটা এত সুন্দর। চারপাশে নির্মল প্রকৃতি। সব মিলিয়ে লকডাউনের এই সময়টায় এমনিতে খুব খারাপ আছি, বলব না। তবে কলকাতায় আমার বাবা-মাও তো গৃহবন্দি। চাকরিসূত্রে দেশের অন্যপ্রান্তে থাকে ভাই। বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে। কেমন করে সবকিছু ম্যানেজ করছে, ভাবলে খুবই চিন্তা হয়। এই জায়গাটাতেই কেমন এক অসহায়ত্ব গ্রাস করে।"

Advertisment

কিছুটা বিষন্ন দেশ থেকে অনেক দূরে লন্ডনে বসবাসরত এই তরুণ। কেমব্রিজে গবেষণা করছে সে, স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, খুব শিগগিরই থিসিস জমা দেবে। সেই তৃপ্তির মাঝেই হঠাৎ করে এই করোনা ঝড়। ফোন বা ভিডিও কলে কথা চলছে পরিবারের সঙ্গে । তবু কোথাও একটা আশঙ্কার কালো মেঘ। নিজে ভালো থাকলেই তো শুধু ভালো থাকা যায় না। খুব জরুরি প্রয়োজন পড়লেও এখন ছুটে যাওয়া যাবে না দেশে।

সারা বিশ্বের জনজীবন এই মুহূর্তে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি। করোনার থাবা গ্রাস করছে একের পর এক শহর, গ্রাম, জনপদ। সংক্রমণ রুখতে লকডাউন! বন্ধ বিমান, ট্রেন, বাস চলাচল। সীমানাগুলি সিল করে দেওয়া হয়েছে। মোদ্দা কথা, লকডাউন ঘোষণার ঠিক আগে যে যেখানে ছিলেন, সেখানেই আটকা পড়ে গেছেন। সাধারণভাবে এখন সকলেই অসুবিধা, আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যেই কোথাও একটু আলাদা ধরনের দোলাচলে রয়েছেন বিদেশে বসবাসরত অগণিত মানুষ ও এদেশে তাঁদের পরিবার। কেউ কর্মসূত্রে, কেউ পড়াশোনার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে। কেউ বহু বছর আছে। কেউ তুলনায় নতুন। তবে, সকলেরই পিছুটান রয়েছে। ওদিকে ওঁরা, এদিকে পরিবারের মানুষ। দুপক্ষই চিন্তায় অস্থির।

কথা বলছিলাম একজন মায়ের সঙ্গে। ছেলের উজ্জ্বল কেরিয়ার। পেশায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার এই তরুণ এখন ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক এক সংস্থায় কর্মরত। মায়ের গর্ব হওয়ারই কথা। কিন্তু সেই গর্বেও এখন প্রবল দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। "রাতে ঘুম হয় না। খবরের চ্যানেল খুললেই দেখছি খারাপ খবর। আমেরিকায় প্রচুর সংক্রমণ, মারাও যাচ্ছে অনেক মানুষ। ছেলের সঙ্গে রোজ কথা হয়, ভিডিও কল করে দেখতেও পাই। সাবধানে আছে, ঘরেই থাকছে জানি। তবু, চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পাই না। মনটা কিছুতেই ভালো থাকে না।" আবেগ ঢাকা পড়ে না। সত্যি মায়ের মন! এমন অবস্থা আরও অনেক মা ও বাবার। অন্য সময় যেমন-তেমন। কিন্তু এই ভাইরাস আক্রমণ ও তার প্রতিরোধে লকডাউনকে ঘিরে হঠাৎ কেটে গেছে যোগাযোগের, জীবনযাপনের চেনা ছন্দ। আজ ভৌগোলিক দূরত্বটা যেন প্রযুক্তির আশীর্বাদেও কাটতে চাইছে না।

প্রচুর প্রবীণ ও বৃদ্ধ দম্পতি আছেন এদেশে, যাঁদের সন্তানেরা বিদেশে থাকেন। যাঁরা পারেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করেন। যাঁরা পারেন না, তাঁরা মূলত পরিচারকের তত্ত্বাবধানে থাকেন। বছরে একবার হয়তো ছেলেমেয়েরা আসে। তারা দূরে থাকলেও যতদূর সম্ভব বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করে। অনেকেই ভিন দেশে স্থিতু হওয়ার পর মা-বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে। কিন্তু সচরাচর প্রবীণ বা বৃদ্ধরা পুরোনো চেনা জগৎটা ছেড়ে যেতে চান না।

এমন এক পরিবারকে জানি, যেখানে ছেলেটি তার বউ-বাচ্চা নিয়ে সিনসিনাটিতে থাকে। বাবা-মায়ের  যথেষ্ট বয়স হয়েছে। একমাত্র সন্তান সে। বাবা-মাকে নিয়ে যাওয়ার বহু চেষ্টায় ব্যর্থ। অর্থাৎ টানাপোড়েন চলে এমনিতেই। এবার করোনার আক্রমণ ও লকডাউনকে ঘিরে সেই টানাপোড়েন দ্বিগুণ। দুপক্ষই এই মুহূর্তে চরম টেনশনে। বিশেষত ছেলে খুবই ছটফট করছে। বয়স্ক মানুষ দুটির হঠাৎ কিছু হলে, সে হাজার মাথা কুটলেও আসতে পারবে না। যেটা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রায়শই করে থাকে সে। এমন অনেক পরিবারকে নিশ্চয়ই আপনারাও চেনেন, করোনার প্রভাব যাদের আক্ষরিক (পড়ুন ভৌগোলিক) অর্থেই বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আজ।

"দীর্ঘ সাত বছর বাড়ির বাইরে, পৃথিবীর অপর প্রান্তে, যেখানকার সঙ্গে ভারতের সময়ের ব্যবধান ১২ ঘন্টা। তবু কখনও সেইভাবে বিচ্ছেদ বা একাকীত্ব অনুভব করিনি। এই ভাইরাস আক্রমণকে কেন্দ্র করে যা পরিস্থিতি তৈরি হলো, তাতে যেন সেই রকমই একটা অনুভূতি হচ্ছে," জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটেল শহরে কর্মরত এক তরুণী। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শহরেই প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে । সেটার কথা ভেবে আবার কলকাতায় তার বাবা-মা দুশ্চিন্তায়।

"স্মার্টফোনের কল্যাণে ভিডিও কল করা যায়, এটাও যেন ক্ষণিকের শান্তি। আমি নিজে বাড়িতে বসে কাজ করছি। সতর্ক থাকছি। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য চাইলেও কিছু করতে পারছি না। অন্তত অনলাইন পরিষেবাটাও যদি কাজ করত! বিল পেমেন্ট থেকে ওষুধ বা জরুরি জিনিস কেনা, সবই এখানে বসে করে দিতে পারতাম। খুব অসহায় বোধ করছি। ওঁদের যদি দৈনন্দিন কেনাকাটার জন্য বাড়ির বাইরে যেতে হয়, সেটা তো এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে খুবই বিপজ্জনক," তার গলায় হতাশা স্পষ্ট।

নিজের রাজ্য বাংলাতেই আছি। একরাতের ট্রেনজার্নি। তবু ফেলে আসা শহর কলকাতায় চাইলেই ছুটে চলে যেতে পারব না এখন। এটা ভাবলেই বুকের মধ্যে কেমন একটা দলা পাকানো কষ্ট গুমরে ওঠে। ঠিক এই অনুভূতিটাই এখন ভিন দেশে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষের মনে। শুধু পরিবার নয়, পাড়া, ছোটবেলার বন্ধু, গলির চায়ের দোকান, রাস্তার ধারের বুড়ো বটগাছ, দেখলেই লেজ নেড়ে এগিয়ে আসা পাড়ার কুকুর, সবই যেন বড্ড দামি এখন। পাসপোর্ট, ভিসা, টাকা, কোনও কিছুর জোরেই এই মুহূর্তে তাদের কাছে পৌঁছনো যাবে না।

ঠিক এমনই এক অনুভূতিতে মুখর হয়ে ওঠে এক বাঙালি তরুণ। গবেষণা শেষ করে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির হাত ধরে আজ সে আমেরিকায়। লকডাউন, শুধু তো ঘরে আটকে থাকা নয়। এর পাশাপাশি  ভৌগোলিক সীমা পার করার অনুমোদন না থাকাটা যেন অনেক বড় উপলব্ধির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। "শুধু পরিবার নয় ,পাড়ার অগণিত মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ওদলাবাড়িতে বড় হয়েছি। সেই ছবিটা করোনাভাইরাসের কারণে কোনওভাবে বদলে যাবে, সেটা কল্পনা করতেও ভয় হয়। মনেপ্রাণে চাইছিলাম, করোনার প্রভাব যেন আমাদের দেশে না পড়ে। কিন্তু যেভাবে সারা বিশ্বে একটা একটা করে নতুন দেশে করোনা তার উপস্থিতি জানান দিয়েছে, তাতে সেটা সম্ভব ছিল না। স্বভাবতই চিন্তা ছিল, ওদলাবাড়ির সবাই এই পরিস্থিতির গভীরতা বুঝে নিজেদের সামলে নেবে কিনা। দূর থেকেই বাড়ির সবাইকে, বন্ধুবান্ধবদের বুঝিয়েছি। খুশি হলাম দেখে যে বেশিরভাগ মানুষ বিষয়ের গুরুত্বটা বুঝেছে। এই মুহূর্তে সচেতনতা আমাদের একমাত্র পথ। যতদিন না অবস্থা স্বাভাবিক হবে, দূরে বসে নিজের দেশ, পরিবার, পাড়ার বন্ধু সবার জন্য দুশ্চিন্তা, মন খারাপ হতেই থাকবে।"

করোনা আমাদের জীবনের শিকড় ধরে টান দিয়েছে। আজ সারা বিশ্ব ওলটপালট। জীবিকা বা অন্যান্য প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিভক্ত পরিবারগুলি আজ বড়ই বিষণ্ণ। দূরকে কখনও এত দূর মনে হয়নি আগে। মাইল যেন আলোকবর্ষে পরিণত। ওখানে ছেলেমেয়েদের দুশ্চিন্তা। এখানে বাবা-মায়ের। সকলেই চাইছে এই দমবন্ধ অবস্থা সমাপ্ত হোক। স্বাভাবিক হোক জীবন। খুলে যাক সীমানা। যে যেখানেই থাক, দেশ যে ডাক দিয়েই যায়। সুখে এবং দুঃখে।

Advertisment