স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ এর আগে কখনো এমন কোনও সংকট দেখেনি, ব্যক্তিগত বিত্ত ব্যবহার করে যার হাত থেকে সুরক্ষিত থাকা যায় না। ভারতবর্ষ কখনো দেখেনি এ পোড়া দেশে মানুষ হবে না বলে, উপযুক্ত চিকিৎসা হবে না বলে, ব্যক্তিগত বিত্তের বিনিময়ে 'ফরেনে' যেতে মানুষ পিছিয়ে যাচ্ছে, বরং 'ফরেন' থেকে আসা মানুষদের দেখে কুঁকড়ে যাচ্ছে ভয়ে। এই দেশ কখনো দেখেনি বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় পরিয়ে রাখতে হয় ট্রিপল-লেয়ার্ড সার্জিক্যাল মাস্ক। সারা বিশ্ব কখনো মক্কার কাবাকে এরকম খাঁখাঁ দেখেনি।
এবং কী আশ্চর্য, সিয়াচেনে মাইনাস পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পাহারা দেওয়া জওয়ানদের শুধু নয়, ভারতীয় নাগরিকের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার কৃতিত্ব সমাজের আরও এক শ্রেণীর পেশাদারদের দিতে হলো অবশেষে, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে সেটাও প্রথম। 'অ্যায় মেরে ওয়াতন কে লোগোঁ' গেয়ে বা 'লাইন অফ কন্ট্রোল' নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে - দেশরক্ষার, দেশের জনগণ রক্ষার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বের উত্তুঙ্গ শিখরে যাঁদের তুলে রাখা হয়েছিল, কীভাবে যেন সমাজের অন্য কিছু মানুষও, যাঁদের আকৃতি প্রকৃতি ও আচরণে আপাতদৃষ্টিতে বীরত্বের, বা 'প্যাট্রিয়ার্কাল হিরোইজম'-এর লেশমাত্র নেই, সেই গুরুত্বে নিঃশব্দে ভাগ বসিয়ে ফেললেন। কোটিপতি থেকে শুরু করে স্বল্পপুঁজির মুদি দোকানদার, অশিক্ষিত রিকশাচালক থেকে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক, সবাই সেই আপাত নন-হিরোইক পার্সোনালিটিদের মতামতের ওপরেই ভরসা করতে শুরু করলেন প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র গিরিশ বনসল তেরোবার করে রামনাম জপ করে সুরক্ষিত থাকার দাওয়াই দেওয়ার পরেও, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে থালাবাটি বাজানোর নিদান হাঁকতে হলো সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মান দিতেই। যদি এটা মোদীর নির্বাচনী কৌশলও হয়, তা সত্ত্বেও মেনে নিতেই হবে, এতে করে বিজ্ঞানের নৈতিক জয়ই প্রতিষ্ঠিত হলো রামলালার অলৌকিক শক্তির ওপরে। বর্তমান ভারতের সোশিও-পলিটিক্যাল প্রেক্ষিত থেকে, বাসন-বাদ্য'র ফরমানকে সামান্য ঘটনা ভাবলে ভুল হবে।
মানুষের মাথার চুলের ব্যাসের থেকে পাঁচশো গুণ ছোট একটি আধাজড়-আধাজীব গত কয়েক সপ্তাহে আমাদের অভূতপূর্ব শিক্ষা দিয়েছে। আমরা দেখেছি, ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট হাসপাতাল নয়, বাঁচতে গেলে দৌড়তে হবে সরকারি হাসপাতালগুলোতেই। সারা জীবন প্রচারের আলোর আড়ালে থাকেন যে 'গেঁইয়া' ডাক্তারবাবু বা স্বাস্থকর্মীরা, যাঁরা কিনা পাবলিক হেলথ সিস্টেমের স্তম্ভবিশেষ, যাঁরা কিনা গ্রামে গ্রামে, ব্লকে ব্লকে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই হোক, বা জেলা হাসপাতালে, অপ্রতুল ওষুধ এবং ক্ষয়াটে ইকুইপমেন্টমাত্র সম্বল করে বাঁচিয়ে তোলেন লক্ষ লক্ষ প্রাণ - তাঁরাই এখন ভারতবাসীর ত্রাতা।
রাষ্ট্র যদি এটা বুঝত অনেক আগে, যদি ক্ষমতার স্বার্থে পাবলিক হেলথ সিস্টেম চূর্ণ করে কর্পোরেট হেলথ কালচার গড়ে না তুলত, যদি ব্লকে ব্লকে গড়ে তুলত প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্র জনগণের করের টাকায় - আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীকে এরকম ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হতো না করোনা ধরলে বেডের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে সেই আতঙ্কে।
ব্যক্তিগত মালিকানার পুঞ্জীভূত বিত্ত দিয়ে মুষ্টিময় কিছু মানুষ যেভাবে আবহমান কাল ধরে জনসাধারণের থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করে এসেছেন, মহার্ঘ্য কর্পোরেট স্বাস্থ্য পরিষেবা উপভোগ করে এসেছেন, বিদেশে পাঠিয়েছেন সন্তানকে নিজের খরচায়, নিজেদের শ্রেণীকে সচেতন ভাবে, সগর্বে, তফাৎ রেখেছেন আম নাগরিকের থেকে, কালান্তক যমের মতো, বলরামের মুষলের মতো করোনা ভাইরাস আউটব্রেক সেই শ্রেণীসচেতন উন্নাসিকতার বেলুন ফুটো করে দিয়েছে অতি সুচারুভাবে। মানুষ দেখছে, প্রকৃতির অমোঘ মারের হাত থেকে কারো কোনো নিস্তার নেই, সেখানে উচ্চনীচ ভেদাভেদ নেই। দেখছে, শ্রেণীচেতনা জনিত উন্নাসিকতা কালভৈরব প্রকৃতির এক ফুঁয়ে উড়ে যায়। হয়তো আরও অনেক কিছু দেখবে, সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের হাতে, চিকিৎসকদের হাতে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে। খানিকটা অতিসরলীকৃত শোনালেও, এটিই এই মুহূর্তে কঠোর বাস্তব। পাবলিক হেলথের সঙ্গে যুক্ত আছেন যে সকল বিশেষজ্ঞরা, আপামর জনসাধারণকে এখন তাঁদের কথা শুনেই চলতে হবে, গোমূত্র, ঊটের বর্জ্য, রামলালা, পীরবাবা মাথায় থাক এখন, আপনি বাঁচলে বাপের নাম।
সামান্য দেরি হয়ে গেলেও (প্রাথমিক স্তরে, করোনা সংক্রমণের অভিঘাতটা ঠিক আন্দাজ করা যায়নি, এই ধরণের সঙ্কটের সেভাবে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না বলে। এটা শুধু ভারতবর্ষে না, তুলনায় উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো আছে, ইউরোপের এমন একাধিক দেশেও হয়েছে দুর্ভাগ্যবশতঃ), স্বাস্থ্যকর্মীরা পূর্ণোদ্যমে মাঠে নেমেছেন, অসম্ভব পরিশ্রম করছেন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবং রোগ ছড়ানো ঠেকাতে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সরকারও সদর্থক ভূমিকা নিয়েছেন।
শিক্ষিত জনগণের উচিৎ এই ইস্যুতে রাষ্ট্রের সাথে, পাবলিক হেলথ সিস্টেমের সাথে সহযোগিতা করা, কী করতে হবে এবং কী করা বারণ, তা শুধু নিজে বোঝা'ই নয়, উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে যাঁরা তা বুঝতে পারছেন না, তাঁদের বোঝানো, বুঝতে সাহায্য করা। শুধুমাত্র গৃহবন্দী হয়ে ছুটি কাটানোর নিজস্বী সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দায়িত্ব সেরে ফেলাটা কোনো কাজের কথা না। আমাদের বুঝতে হবে আমাদের নিজেদেরও দায়িত্ব আছে, যাবতীয় দায়িত্ব রাষ্ট্র বা স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে শুধু আত্মস্বার্থ দেখার সময় এটা নয়। কারণে অকারণে ছিদ্রান্বেষী হয়ে সিস্টেমের সমালোচনা করার সময়ও এটা নয়। আমরা যেন ভুলে না যাই, সমগ্র মানবজাতি এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা আছে দেশ ও সমাজের মঙ্গল সুনিশ্চিত হয় এমন ভূমিকা নেওয়া।
দায়িত্বশীল হতে হবে বিভিন্ন ভাবে। সাবধান হতে হবে, কিন্তু 'প্যানিকড' নয়। আশঙ্কিত হোন, আতঙ্কিত না। মনে রাখতে হবে, সাবধানতা একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আতঙ্ক ছড়ানো, গুজব বা অতিরঞ্জনের মাধ্যমে - একটি অপবিজ্ঞান। আতঙ্ক ছড়ানো অশিক্ষাই নয় শুধু, কুশিক্ষা। নিজেও আতঙ্কিত হবেন না, অন্যে আতঙ্কিত হয় এরকম কোনও ভয়ানক ভবিষ্যৎবাণী করবেন না। কত লক্ষ লোক ক'দিনে মারা যেতে পারে এই দেশে, সে নিয়ে সাধারণ মানুষ, যাঁরা বিশেষজ্ঞ নন, তাঁরা নাই বা জ্ঞান বিতরণ করলেন।
গ্রাফের 'লিনিয়ার রিজিওন' থেকে 'এক্সপোনেনশিয়াল আউটব্রেক' জোনে যাওয়া নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গভীর আলোচনারত নেটিজেনদের কত শতাংশ জানেন যে পপুলেশন ডায়নামিক্স এর কোন অবকল সমীকরণ (ডিফারেনশিয়াল ইক্যুয়েশন) সমাধান করে ওই লেখচিত্র পাওয়া গেছে? ট্রায়াল রেসপন্স ফাংশনই বা কী ধরা হয়েছিল ডেটা ফিটিংয়ের সময়? ইতালির আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপরে ভিত্তি করে যে ভবিষ্যৎবাণী করার অঙ্ক তৈরি হয়েছে, সেই অনুমিতি ভারতীয় প্রেক্ষিতে বেমালুম ব্যবহার করা মূর্খের কাজ, এটিই বা কতজন নেটিজেন বোঝেন? সেই প্রফেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কি তাঁদের?
প্রত্যেক পেশার সুনির্দিষ্ট ট্রেনিং থাকে, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রকর, সাংবাদিকরা তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই সফল এবং স্বানামধন্য হোন না কেন, পপুলেশন ডায়নামিক্সের নন-লিনিয়ারলি কাপলড ডিফারেনশিয়াল ইক্যুয়েশন-এর সমাধান ও তার ভিত্তিতে ভারতবর্ষে কত লোক কদিনের মধ্যে মারা যাবে সেই ভবিষ্যৎবাণীর বিষয়গুলি গণিতজ্ঞ এবং চিকিৎসকদেরই বুঝতে দিন।
ফলতঃ, এমন কিছু করবেন না, যাতে আতঙ্ক ছড়াতে পারে। আতঙ্ক অতি বিষম বস্তু। বিশেষতঃ তা যখন সমষ্টিগত ভাবে ছড়ায়। বাজার থেকে উধাও হয়ে যাবে চাল, ডাল, দুধ, বেবিফুড এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। কালোবাজারি বাড়বে জীবনদায়ী ওষুধের (যা আপনি না কিনে থাকতেও পারবেন না), এবং অধিক দামে সেই ওষুধ কিনতে না পেরে বহু দরিদ্র মানুষ বেশি করে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বেন, তাঁদের ইমিউনিটি কমে যাবে, তাঁরা আরও অনেক বেশি মাত্রায় ভালনারেবল হয়ে পড়বেন করোনা আক্রান্ত হওয়ার এবং আক্রান্ত হলে মৃত্যু হওয়ার পোটেনশিয়াল জনগোষ্ঠী হিসেবে।
মৃত্যু মিছিল বাড়বে অন্যান্য রোগেও। সীমিত দামে মেলে এমন পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে, ওষুধের অভাবে, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগ - ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, টিউবারকুলোসিস, আন্ত্রিক। আপৎকালীন জনস্বাস্থ্য পরিষেবার যাবতীয় রিসোর্সকে ভাগ করে ফেলতে হলে এগুলি সামলাতে, করোনার চিকিৎসা ব্যাহত হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিপূর্ণ ভেঙে পড়বে।
এবং মাস হিস্টিরিয়া অচিরেই হয়ে উঠতে পারে অসম্ভব, অবর্ণনীয় হিংসাত্মক। আগ্রাসন, হিংস্রতা, এবং উন্মত্ত হিংসার পূর্ব-বিন্যাস (প্রি-ডিসপোজিশন) হিসেবে আতঙ্কের ভূমিকা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা বহুবছর ধরে কাজ করে আসছেন। 'বিহেভিয়ারাল সাইকোলজি'র জনক, জন ব্রডস ওয়াটসনের উল্লেখযোগ্য কাজ আছে এ নিয়ে। ফ্রয়েড এবং অন্যান্য প্রথিতযশা মনোবিজ্ঞানীরাও এ বিষয়ে বিশদ কাজ করেছেন। বাংলা ভাষায় সহজলভ্য এবং সহজবোধ্য বই হিসেবে অধ্যাপক অর্ধেন্দুশেখর ভট্ট্যাচার্যের 'এতো হিংস্র কেন' (প্রকাশক: এডুকেশন ফোরাম) পড়ে দেখা যেতে পারে। মূল বিষয়টি হলো - মানুষ ভীত হলে যুক্তি বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে, তার আচরণ তখন বোঝা বা সংহত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
আর কে না জানে, সব ভয়ের বড় ভয় মৃত্যুভয়, কারণ তখন জেগে ওঠে মানুষের 'অ্যানিম্যাল ইন্সটিঙ্কট'। মানুষ প্রকৃতপক্ষে দ্বিপদ পশু বই তো নয়, যদিও সেই 'পাশবিকতা' অর্থাৎ অ্যানিম্যাল ইন্সটিঙ্কট অধিকাংশ সময়েই অবচেতনে প্রচ্ছন্ন থাকে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে বেরিয়ে আসতে পারে। মৃত্যুভয় অবশ্যই সেরকমই একটি পরিস্থিতি। বিবর্তনসংক্রান্ত জীববিজ্ঞানের (এভোল্যুশনারি বায়োলজি) একটি বিখ্যাত উপপ্রমেয় ভ্রূণতত্বগত সমান্তরলতা (এমব্রায়োলজিক্যাল প্যারালালিজম) বা অনুচিন্তনের তত্ত্ব (থিওরি অফ রিক্যাপিচুলেশন)। সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ সহ উচ্চশ্রেণীর প্রাণীর গর্ভস্থ ভ্রুণ প্রাথমিক অবস্থা থেকে বেড়ে ওঠার সময় ভ্রুনের গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট মিল পাওয়া যায় বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে যে সমস্ত শ্রেণীর প্রাণীরা এসেছে সময়ের অক্ষ ধরে, সেই সব শ্রেণীর (ট্যাক্সোনোমিক অর্থে) প্রাণীদের ভ্রুণের গঠনের সাথে।
অর্থাৎ, কোনো মানবীর গর্ভস্থ ভ্রুণ প্রাথমিক স্তরে জলজ প্রাণী (মাছ), উভচর (স্যালাম্যান্ডার), খেচর (মুরগি) প্রভৃতি প্রাণীর ভ্রুনের মতো দেখতে হবে তার বৃদ্ধির সাথে সাথে, অবশেষে তা মানুষের ভ্রুনের পর্যায়ে আসবে পরিপূর্ণ বিকাশের পরে। জীববিজ্ঞানী এটিন সেরেস এবং ইয়োহান ফ্রিডরিশ মেকেল-এর নামে একে অনেক সময় মেকেল-সেরেস সূত্রও বলা হয়। এই অনুচিন্তনের তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য অনুমিতি হলো 'অন্টজেনি রিপিটস ফাইলোজেনি' - অর্থাৎ জীবজগতে কোনো প্রাণীর অঙ্গসংস্থানগত গঠনে তার বিবর্তনগত পূর্বপুরুষের ছাপ বা 'স্মৃতি' রয়ে যায়।
সুতরাং অ্যানিম্যাল ইনস্টিংক্ট বা কিলার ইনস্টিংক্ট (বৈজ্ঞানিক রেমন্ড ডার্ট-এর খুনে বানরের অনুমিতি বা 'কিলার এপ হাইপোথিসিস', যেখানে বলা হয়েছে, যুদ্ধ এবং পারস্পরিক আগ্রাসনই মানব বিবর্তন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম মূল ভিত্তি) একটি অবশ্যম্ভাবী ধর্ম যা অবচেতনে লুকিয়ে থাকবেই। দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সারের 'কালচারাল রিক্যাপিচুলেশন থিওরি অফ এডুকেশন'-এর তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার বছর পাঁচেক বাদে প্রখ্যাত জার্মান বৈজ্ঞানিক আর্নস্ট হাইনরিশ ফিলিপ অগাস্ট হেকেল 'অন্টজেনি রিপিটস ফাইলোজেনি-র' কথা প্রথম বলেন, যার প্রাথমিক ইঙ্গিত স্পেন্সারের তত্ত্বে প্রচ্ছন্নভাবে ছিলো ("If there be an order in which the human race has mastered its various kinds of knowledge, there will arise in every child an aptitude to acquire these kinds of knowledge in the same order... Education is a repetition of civilization in little" - হার্বার্ট স্পেন্সার, 'এডুকেশন: ইন্টেলেকচুয়াল, মরাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল', নিউ ইয়র্ক, ডি অ্যাপলটন অ্যান্ড কোম্পানি, ১৮৯১)।
পরবর্তী কালে কগনিটিভ নিউরোলজি এবং সমাজবিজ্ঞান (যাকে হেকেল স্বয়ং বলেছেন ফলিত জীববিজ্ঞান), দর্শন, ও সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় এই তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ হয়েছে (যদিও, বিজ্ঞানের অন্যান্য বহু তত্ত্বের মতোই, এই তত্ত্বেরও একাধিক বিরুদ্ধ মতবাদ এবং অপব্যবহার রয়েছে, নাৎসি জার্মানি হেকেলের এই তত্ত্বকে বিকৃত করে জাতির শুদ্ধতা তত্ত্ব এবং আর্য্যরক্তের বিশুদ্ধতা সংক্রান্ত মতবাদ প্রচার করার জন্য)। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর 'থিওরি অফ নিউরন' বা 'ডিফেন্স মেকানিজম হাইপোথেসিস'-এ হেকেলের মতবাদ প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন, আতঙ্ক থেকে কীভাবে বিচার বুদ্ধি গুলিয়ে গিয়ে হিংসার উদ্ভব হয় (স্টিফেন জে গোল্ড, 'অন্টজেনি অ্যান্ড ফাইলোজেনি', কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস, বেলন্যাপ প্রেস অফ হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৭, দ্রষ্টব্য)।
সুতরাং, সাধু সাবধান! অতি সক্রিয় সতর্কতার নামে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে প্যানিক উস্কে দেবেন না, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই যা করছেন, পেশা নির্বিশেষে (কিছু স্বাস্থকর্মী বা চিকিৎসককেও ভীতি উদ্রেককারী পোস্ট দিতে দেখা যাচ্ছে, দুর্ভাগ্যবশত। হয়তো তাঁরা ভয় দেখিয়ে মানুষকে সাবধান করতে চাইছেন, কিন্তু তার উল্টো ফল হতে পারে)। এই যে জনৈক আমলার বিদেশফেরত সন্তান এবং তার মা-বাবাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এত হিংস্র, ব্যক্তিগত আক্রমণ, তার মূলেও কিন্তু ওই প্রাণের ভয়ই। অবশ্যই সেই ছেলেটি অসম্ভব আপত্তিজনক আচরণ করেছে, কিন্তু আবহমান কাল ধরে ক্ষমতাশালী পরিবারের ছেলেমেয়েরা পরিবারের ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটিয়ে বহু দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করে এসেছে, মানুষ তখন এত হিংস্রতা উগরে দেয়নি সোশ্যাল মিডিয়ায়। এবার দিল, কারণ মানুষ ভয় পেয়েছে। নিখাদ, দমবন্ধকরা ভয়। মৃত্যুভয়!
এই প্যানিক থেকেই, যদি রাস্তায় অচেনা কেউ হাঁচি দেন নাকে গাড়ির ধোঁয়া ঢুকেই, পথচারীরা দল বেঁধে পাথর ছুড়ে তাঁকে মেরে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারেন, মেরেও ফেলতে পারেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই দু'দিন বাদে কলকাতার রাস্তায় এরকম ঘটনা ঘটলে। এই লেখা পড়ে প্রতিবেদককে যদি কেউ বাতিকগ্রস্ত ভাবেন, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, ইজরায়েলের নাগরিক আম-সালেম সিংসন নাম জন্মসূত্রে ভারতীয় ২৮ বছরের এক ইহুদি যুবককে ইজরায়েলের টাইবেরিয়াস শহরে এমন প্রহার করা হয়েছে যে তিনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। আম-সালেম মিজোরামের মানুষ, চাইনিজদের মতো দেখতে, সুতরাং তিনি করোনা ছড়াচ্ছেন, এই 'কারণে' প্রহার। গত ১৬ মার্চের ঘটনা।
করোনাভাইরাসের মতোই, আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। তারও 'লিনিয়ার রেজিম' থেকে 'এক্সপোনেনশিয়াল আউটব্রেক' হয়। যুদ্ধ (প্রকৃত যুদ্ধ, কার্গিল-কার্গিল খেলা নয়) বিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষ বা মহামারী-পীড়িত বিভিন্ন দেশের মানুষের অভিজ্ঞতায় তার প্রমাণ আছে। সেই দাবানলকে খুঁচিয়ে না তোলাই মঙ্গল, নিজের, দেশের, সমাজের।
সাবধান থাকুন, চিকিৎসকের পরামর্শে চলুন, নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন। তার বাইরে যাবেন না। সক্রিয়তা ভালো, অতি সক্রিয়তা নয়। তাতে হিতে বিপরীত ঘটবে।
(লেখক ভারত সরকারের পরমাণু শক্তি বিভাগে কর্মরত মহাকাশবিজ্ঞানী। মতামত ব্যক্তিগত)