কোনও সন্দেহ নেই, নিজামুদ্দিনের তবলিগি জামাতের মরকজ (উর্দুতে এর অর্থ 'কেন্দ্রবিন্দু') একা হাতে বহু সংখ্যক করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই মরকজ যাঁর উদ্যোগেই হয়ে থাক, তিনি দোষী, এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারায় শাস্তিযোগ্য। যেখানে সারাদেশে লকডাউন চলছে, এবং কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার আপ্রাণ লড়ে চলেছে মহামারী রুখতে, সেখানে মুষ্টিমেয় কিছু মৌলবাদীদের জন্য এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিপদে পড়বেন, এটা সত্যিই ধারণাতীত। তবে একথাও ঠিক, স্থানীয় প্রশাসনের উচিত ছিল আরও অনেক বেশি সজাগ থেকে আরও দ্রুত ওই সমাবেশ ভেঙে দেওয়া।
সেখান থেকে চলে আসি ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের বৃহত্তর সমস্যায়। তাঁরা যে খুব আনন্দজনক পরিস্থিতিতে নেই, তা অনস্বীকার্য। অধিকাংশই বাস করেন সমাজের প্রান্তভাগে: দরিদ্র, অশিক্ষিত অবস্থায়, এবং বর্তমান সরকার যে তাঁদের প্রতি ন্যায়বিচার করবে না, সে সম্পর্কে একপ্রকার নিশ্চিত। এমন নয় যে এর পূর্ববর্তী কোনও সরকারের শাসনকালে তাঁদের পরিস্থিতি খুব ভালো ছিল, তবে জনমত মোটামুটি এই যে এর আগে সরকারের "হাত" এত ভারী ছিল না। যদিও একথাও ঠিক, সব দায় তৎকালীন সরকারের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সময় এসেছে, মুসলমান সমাজের অন্তর্লীন ভাঙ্গনরেখা দেখার।
মাদ্রাসার প্রাচীনপন্থী শিক্ষাব্যবস্থার যে মেয়াদ ফুরিয়েছে, তা অত্যন্ত স্পষ্ট। কিছু মাদ্রাসায় ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং অঙ্ক শেখানোর চেষ্টা হয় বটে, তবে সেগুলি সংখ্যায় খুব বেশি নয়। পড়ুয়াদের কোরান মুখস্থ করানো হয়, এবং আট বা ১০ বছর বয়সে কোনও শিশু 'হাফিজ' (কোরান মুখস্থ যার) হয়ে গেলে তার পরিবারের গর্ব আর ধরে না। হ্যাঁ, অনেক মুসলমান ছেলেমেয়ে মূলস্রোতের স্কুল-কলেজেও পড়ে, তবে অধিকাংশই যে মাদ্রাসা ব্যবস্থাতেই আবদ্ধ, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
সুতরাং বৃহত্তর সমস্যা হলো সম্প্রদায়ের ওপর মৌলবি এবং মৌলানাদের দাপট, যাঁরা মসজিদে এবং ধর্মীয় শিক্ষালয়ে বসে নাগাড়ে ফতোয়া জারি করতে থাকেন। আমার বিপুল সংখ্যক অমুসলিম বন্ধুবান্ধব আছেন যাঁদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি। উৎকণ্ঠা রয়েছে তাঁদের আর্থিক অবস্থা, শিক্ষার অভাব, এবং নিম্নমানের ও অপ্রতুল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে। আমার অমুসলিম বন্ধুরা বলেন ভারতের অন্তর্নিহিত ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, তার মজবুত সংবিধানের কথা, এবং গোমূত্র পান করে ভাইরাস মারার চেষ্টাকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন। তবে মুসলমান গোঁড়ামি এবং প্রাচীনপন্থার বিরুদ্ধে দক্ষিণপন্থী হিন্দু, অথবা সেই অভিমুখী যাঁরা, তাঁদের যুক্তিকে খণ্ডন করা ক্রমশ মুশকিল হয়ে পড়ছে।
আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, আজকের ভারতীয় মুসলমানরা বৌদ্ধিক জড়তার শিকার। পূর্ববর্তী প্রজন্মের বিদ্বানরা পড়তেন ইবন আরাবি, ফখরুদ্দিন রাজি, আইনস্টাইন, বার্গসন, রাসেল, এবং ফ্রয়েড-এর মতো পণ্ডিতদের লেখা। এখন ফের একবার সেই কাজটা করতে হবে - ইসলাম সম্পর্কে নতুন করে ভাবনাচিন্তা, অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন না করে। এর একমাত্র পথ, যেমন আল্লামা ইকবাল বলে গিয়েছিলেন, "আধুনিক জ্ঞানকে শ্রদ্ধাপূর্ণ অথচ স্বাধীন চোখে দেখা, এবং সেই জ্ঞানের আলোয় ইসলামের শিক্ষার বিচার করা"।
কোনও সমাজের, বিশেষ করে ধর্মের, পক্ষে সম্ভব হয় না নিজের অতীতকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা। এবং এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে হজরত মহম্মদের (সাঃ) মৃত্যু-পরবর্তী সময়কে ইসলাম এবং ইসলামি ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। তবে একথাও সত্যি যে ইসলামকে, বিশেষ করে ভারতের মুসলমানদের, আজকের মৌলানাদের মধ্যযুগীয় কল্পনার শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে হবে, সময়োপযোগী চিন্তাভাবনা করতে হবে। কোরানকে বুঝতে হবে তার প্রস্তাবনা-ভিত্তিক যুক্তিবাদ এবং প্রথা ও জল্পনামূলক দর্শনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণে। বিতর্ক বা 'ইজতিহাদ'-এর শক্তিকে ফের জাগিয়ে তুলতে হবে।
হজরত মহম্মদ (সাঃ) জীবিত থাকতেই বিতর্ক এবং বিজ্ঞানচর্চাকে প্রশ্রয় দেওয়া হতো। হজরত তাঁর অনুগামীদের উৎসাহ দিতেন, সুদূর চিন পর্যন্ত গিয়ে জ্ঞান আহরণ করে আনতে। ওই একই সুরে ইকবাল বলেছিলেন: "মনজিল সে আগে বঢ়কর মনজিল তালাশ কর/ মিল যায়ে তুঝকো দরিয়া, সমন্দর তালাশ কর (নাগালের বাইরে গন্তব্যের খোঁজ করো/নদী পেয়ে গেলে সমুদ্রের খোঁজ করো)"।
সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর-বিরোধী প্রতিবাদের মাধ্যমে এক নতুন কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছিলেন ভারতের মুসলমানরা। এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সুফল ছিল ভারতে মুসলমান মহিলাদের যথার্থ আত্মপ্রকাশ (যদিও ইসলামি ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের কথাও রয়েছে)। মহিলাদের পাশে পুরুষরা রয়ে গিয়েছিলেন নিতান্তই সহায়ক হিসেবে। আশা করাই যায়, এই ধারা বজায় থাকবে, এবং মহিলাদের অবস্থার উন্নতি হবে।
কিন্তু পুরুষদের কাছ থেকে কী আশা করতে পারি? তবলিগি জামাতের মতো প্রতিষ্ঠান, তা সে যতই শুভ কাজে জড়িত থাকুক না কেন, বা পবিত্র ধর্মীয় কার্যকলাপ করুক না কেন, সম্প্রদায়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। ধর্মের দোষ নেই - দোষ হচ্ছে এইসব স্বঘোষিত নেতাদের বদ্ধ মন। একটি অবিবেচক পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলমানদের অনেকগুণ বেশি ক্ষতি করেছে নিজামুদ্দিনের মরকজ।
অন্যদিকে সরকারও কোনোরকম সাহায্য করছে না। মুসলমানদের ক্রমাগত 'অন্যপক্ষ' বানিয়ে দিয়ে তাঁদের আরও কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে। একের পর এক গণপ্রহার ও হিংসার ঘটনা, ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর মন্ত্রীমহলে উল্লাস, সিএএ এবং তার আনুষঙ্গিক চ্যালেঞ্জ, এনআরসি/এনপিআর-এর হুমকি, শাসকদলের নেতা-মন্ত্রীদের মুখে "গদ্দারদের" শাস্তি দেওয়ার বিবৃতি, উদারপন্থীদের প্রতি এবং মুসলমানদের মধ্যে যেসব এনজিও কাজ করে তাদের প্রতি অবজ্ঞা, দিল্লির সাম্প্রতিক গণহত্যা, সমস্ত কিছুই মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলেছে।
এখানেই চ্যালেঞ্জ। স্রেফ ভারতীয় মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্যই। মুসলিমদের সামনে রয়েছে শিখদের উদাহরণ। ধর্মীয় রীতিনীতির ব্যাপারে শিখরা কিছু কম গোঁড়া নন। কিন্তু তাঁরা ক্রমাগত স্থাপন করে চলেছেন সাহস, বদান্যতা, এবং সমৃদ্ধির নিদর্শন। প্রথমে দেশভাগ, তারপর ১৯৮৪-র ভয়াবহ দাঙ্গা, এই দুইয়েরই স্মৃতি পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। এই প্রকৃত সময়, যখন এগিয়ে আসা উচিত প্রত্যেক আধুনিক মুসলমানের। এবং সরকারের বোঝা উচিত, মুসলমান সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে "ইতিবাচক পদক্ষেপ" এবং "তোষণের" মধ্যে তফাৎ।
(লেখক প্রাক্তন সরকারি আমলা, মতামত ব্যক্তিগত)
Read the full article in English