"আগে লোকসভা, বিধানসভা খুলুক। মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়করা কাজকর্ম শুরু করুন, তারপর নাহয় আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে।" জনৈক অভিভাবকের এই বক্তব্য আদতে ওঁর একার কথা নয়। অধিকাংশেরই এটাই মত। স্কুল খোলার ব্যাপারে তাঁদের আপত্তির কারণটা সহজেই প্রণিধানযোগ্য। প্রত্যাশা মতোই আনলক হওয়ার পর প্রবল পরিমাণে বেড়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। কোন ভরসায় সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন তাঁরা? সামাজিক দূরত্ব বজায় বাড়ির বাইরে পা রাখলে আদৌ কি সম্ভব?
কেন্দ্রীয় সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক মোটামুটি যে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে, তাতে ১৫ আগস্টের পর স্কুল খোলার সম্ভাবনা। যাবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করবে, যেমন ডিজিটাল মাধ্যমে এখন স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পাঠ নিচ্ছে তারা। এই প্রেক্ষিতেই উঠে আসে কিছু জরুরি কথা। এক, যারা স্কুলে যাবে বলে সরকারের তরফে নির্দেশ দেওয়া হলো, তাদের অভিভাবকরা কী ভাবছেন? তাঁরা কি সন্তানদের নিশ্চিন্তে স্কুলে পাঠাতে পারবেন? আর যারা ছোট, কবে স্কুলে যাবে ঠিক নেই, তাদের ক্ষেত্রেই বা কী ঘটবে? বাস্তবিক, স্কুলে এতদিন পর্যন্ত না গেলে, পড়াশোনার ভবিষ্যৎটাই বা কী? রুটিন মেনে পড়ার অভ্যাস, সাধারণ নিয়মশৃঙ্খলা, সবই তো জড়িয়ে স্কুলে যাতায়াতের সঙ্গে!
আরও পড়ুন: করোনা বদলে দিল শিক্ষার রূপরেখা
সাল ২০২০। তামাম বিশ্ববাসীই পারলে তাঁদের জীবনের ইতিহাস থেকে এই সালটা মুছে ফেলেন। এমন নয় যে এর আগে খারাপ ঘটনা ঘটেনি। দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মারণ ভাইরাসের আক্রমণ তো কয়েকবারই হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ এর মতো সর্বব্যাপী এমন করাল ছায়া বোধহয় আর কেউ ফেলতে পারেনি। কথা বলছিলাম কলকাতার এক স্কুল শিক্ষিকার সঙ্গে। এই যে দীর্ঘদিন বাচ্চারা স্কুলের বাইরে। এর ঠিক কিরকম প্রভাব পড়তে পারে ওদের ওপর? ওঁর কথায়, "খুবই জটিল একটা অবস্থা। এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে প্রায় একটা পুরো বছর ওদের নষ্ট হলো। শুনছি প্রথামাফিক নির্ধারিত মোট যে শিক্ষাবর্ষ, তার থেকে এই সালটা বাদ দেওয়া হবে। যদি সত্যিই সেটা হয়, খুব ভালো। এটা চাকরির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া দরকার। ওরা এই এক বছরের ছাড়টা যদি পায়, তবে আমরা শিক্ষকরা না হয় পরে যথাসম্ভব পড়িয়ে ওদের পিছিয়ে থাকার ক্ষতিপূরণটা করে দেব।"
বলা বাহুল্য, এই একটা বছর বিয়োগ করার পুরো প্রক্রিয়াটাই আলোচনা ও সিদ্ধান্তসাপেক্ষ। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক দিক বিবেচনা করার আছে। মোদ্দা কথা, এই বিষয়টা এখনও বিশ বাঁও জলে। আপাতত ঘরে থেকেই পড়াশোনা। প্রশ্ন ছিল, এখন যেভাবে অন লাইন মাধ্যমে ক্লাস চলছে, সেটা কতটা ছাত্রমুখী? কতটা স্বচ্ছন্দ শিক্ষক ও ছাত্ররা? জবাবে, "এটা অনেকটাই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন আমি বাংলা পড়াই। সাহিত্যের দিকটা বোঝাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ব্যাকরণ অর্থাৎ ভাষার দিকটা বোঝানো শক্ত হয়। বিজ্ঞানের বিষয়গুলি পড়ানো নিশ্চয়ই আরও ঝামেলার!"
একদিকে স্কুল খুললে সংক্রমণের আশঙ্কা। অন্যদিকে স্কুলে না যাওয়ার একাধিক নেতিবাচক ফল। দুয়ের মাঝে দোদুল্যমান দেশের অগণিত ছেলেমেয়ের শিক্ষার ভবিষ্যৎ। অনেকেই বলছেন, শিক্ষা বড়, না, জীবন? এটাও বলছেন, একটা বছরের তো ব্যাপার। এরপর প্রতিষেধক বাজারে এসে গেলে আর চিন্তা কী? প্রথম কথা হলো, জীবন নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড়। এ নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকতেই পারে না। পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে, অভিভাবকরাও একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমন এক আতঙ্কের আবহে গুছিয়ে ভাবার মতো অবস্থা থাকে না। যখন স্বাভাবিক অবস্থাটা আসবে, তখন হয়তো তাঁরাও অনুধাবন করবেন শিক্ষার থেকে যেমন জীবন বড়, তেমনই যথা সময়ে যথাযথ শিক্ষা না পেলে, সেটা জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কতটা প্রতিকূল হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন: ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বললেই কাজ হয়ে যায় কি?
তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিষেধক আবিষ্কারের তত্ত্ব ও তথ্য। বাজারে এই নিয়ে বহু রটনা। সবাই তথ্য সম্প্রচার করছেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়েই করছেন। এক বছরে বাজারে কোভিড ১৯-এর প্রতিষেধক এসে যাবে, এমন কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক গ্যারান্টি নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক থেকে দেড় বছর লাগবে। সঙ্গে এটাও বলছেন, সেক্ষেত্রে এটা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা হিসেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ তাঁরাও নিশ্চিত নন।
শিক্ষকরা প্রত্যেকেই কিছু বিষয়ে সহমত পোষণ করেন। স্কুলে না যাওয়াটা ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য, কোনওটার পক্ষেই ভালো নয়। এমনিতেই আজকাল বাড়িতে ওরা একা। না আছে ভাইবোন, না খেলার সাথী। স্কুলে বন্ধু ও খোলামেলা পরিবেশ পায় ওরা। এখন টানা বাড়িতে, কিছুটা একঘেয়েমির ব্যাপার তো বটেই। একজন প্রবীণ শিক্ষিকার কথায়, "যে বিষয়গুলো প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া শেখা সম্ভব নয়, সেটা কী করে ল্যাব ছাড়া পড়ানো হবে? ঘরে বসে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া কি সম্ভব? তার তো পৃথক পরিকাঠামো চাই। আর একেবারে ছোট যারা, তাদের তো ভিতটাই ভালো করে তৈরি হবে না। ওদের পক্ষে কি ডিজিটাল পদ্ধতিতে পড়াশোনা সম্ভব?"
ছাত্র-শিক্ষকের নিবিড় সম্পর্ক থেকে স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার অভিজ্ঞতা, সবটাই ব্যাহত হচ্ছে এখন। এগুলো কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এই একই মত পোষণ করেন যাঁরা, সেই তিনজন শিক্ষিকা তিন বয়সের। অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে এগিয়ে-পিছিয়ে আছেন। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কাছে স্কুল কতটা প্রয়োজনীয়, তা বোঝাতে সকলেই সমান আবেগপ্রবণ।
"আমি এখন বাড়িতে বসে ওদের পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, স্লাইড, এসব দেখিয়ে পড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ব্ল্যাকবোর্ডের বিকল্প হিসেবে ওরাও এখন মানিয়ে নিতে পারছে। এই যে একেবারে শুরুতে ছোটরা নতুন একটা পদ্ধতি আয়ত্তে এনে পড়াশোনার শুরুটা করল, এটা ভবিষ্যতের পক্ষে ভালো হতে পারে। কোনও একদিন হয়তো এটাই নিয়ম হয়ে যাবে।" জানান এক তরুণী শিক্ষিকা।
আরও পড়ুন: সংক্রমণ না কমলেও অবশেষে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা হয়েছে
নতুনকে তো আহ্বান জানাতেই হবে, তার উদ্ভাবনা যে পরিস্থিতিতেই হোক। ইউরোপ, আমেরিকায় স্টাডি ফ্রম হোম ইতিমধ্যেই প্রচলিত। কিন্তু এ দেশের কতজন ছেলেমেয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনা করতে পারে? প্রবীণ শিক্ষিকার মতে, আর্থ সামাজিক বিভাজনটা খুব স্পষ্ট হয়ে যাবে এক্ষেত্রে। সবার কাছে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট যোগাযোগ নেই। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই, এমন জায়গাও আছে এদেশে। এই সব অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের কী হবে?
এতকিছুর পর অভিভাবকরা কী বলছেন, দেখা যাক। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দেখলাম, তাঁরা এখনই সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে মনে মনে একেবারেই প্রস্তুত নন। কেউ কেউ তো যথেষ্ট দোটানায় ভুগছেন। চাকুরীরত (এখন অধিকাংশই) মা-বাবারা উভয় সংকটে। স্কুলে পাঠাতে রাজি নন। এদিকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না ছেলেমেয়েদের। এই সময় দেওয়ার বিষয়েও কয়েকটি কথা বলা জরুরি। একেবারে খুদেদের পক্ষে স্মার্টফোন বা বাড়ির বড়দের কারও ল্যাপটপ অনুসরণ করে পড়া ও লেখা অসম্ভব। বড় কাউকে থাকতেই হয়, তাদের ক্লাসের সময়। যারা একটু বড়, যাদের কিছুদিন আগে পর্যন্তও স্মার্টফোন হাতে নেওয়ার অনুমতি ছিল না, এখন পড়ার জন্যই তাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। কিন্তু সারাক্ষণ পাহারা? পড়ছে না চ্যাট করছে দেখা? সেও তো অস্বাভাবিকতা। অতএব মা-বাবাকে একটা ব্যালান্স করে চলতে হচ্ছে। অর্থাৎ দিনের শেষে তাঁদের কাছেও উত্তর নেই, সন্তানদের স্কুলে যাওয়া আর কতদিন বন্ধ থাকা উচিত। যদিও তাঁরা নিজেরাও এটা বুঝতে পারছেন, এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। কারও কাছেই সমাধান দূরস্থান, স্থির ভাবে বসে চিন্তা করার অবস্থা পর্যন্ত নেই। তবে, একটা বিষয় পরিষ্কার, অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ থাকতে পারে না। এদেশে স্টাডি ফ্রম হোমের পরিকাঠামো শহরেই নেই, তো গ্রাম। শিক্ষা পদ্ধতিতে ডিজিটাল মাধ্যম মুষ্টিমেয় ছেলেমেয়ের জন্য। আগে তাকে সার্বিক করতে হবে। আর স্কুল যেদিনই খুলুক, কর্তৃপক্ষকে ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার গ্যারান্টি দিতে হবে।
আক্ষেপ, এখানে এসেই সব ইতিবাচক কথা থেমে যায়। স্কুল খোলেনি। কিন্তু প্রাইভেট স্কুলগুলির অনেকেই ফি বাড়ানোর পথে চলা শুরু করে দিয়েছে। এই যাদের মনোভাব, তারা এমন এক জটিল অবস্থায় কোন আশার বার্তা দেবে অভিভাবকদের? স্কুল খুলতেই হবে একদিন। তার আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের মধ্যে ভাবনার সমন্বয় সাধনটা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপও সমান গুরুত্বে কাম্য।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন