Advertisment

করোনা বদলে দিল শিক্ষার রূপরেখা

স্পেনে রেডক্রস ক্ষুধার্ত ও গৃহহীনদের  জন্য অন্ন ও বাসস্থানের পাশাপাশি পরিবারগুলিকে ১ হাজার ট্যাবলেট কম্পিউটার ও থ্রি-জি কার্ড দিয়েছে, যাতে বাচ্চাদের লেখাপড়ার পথটিও চালু থাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
online education

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

বাজার-হাট, শপিং মল, মন্দির-মসজিদ-গির্জা সর্বত্র খুলে গেছে তালা। এবার? এবার কি তবে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা? এই একটি প্রশ্নেই রীতিমতো হোঁচট খাচ্ছেন কর্তাব্যক্তিরা। এখানে একটা কথা উল্লেখ প্রয়োজন, সমস্যাটা স্কুল স্তরেই বেশি। ওরা ছোট। ফলে, অসচেতন ও অসহায়। স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক, শিক্ষক থেকে শুরু করে খোদ সরকারি শিক্ষা দফতর তাই স্কুল খোলার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। একদিকে এই মুহূর্তে কোভিড ১৯-এর বিপুল হারে বৃদ্ধি। ফলে, ছাত্রদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে দুশ্চিন্তা। অন্যদিকে তাদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে  দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতা তাদের পক্ষে একেবারেই ভালো হচ্ছে না।

Advertisment

এই দুই সংকটের মাঝে আপাতত দোদুল্যমান স্কুল খোলার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা একটা হয়েছে বটে, কিন্তু নানা শর্ত ও সন্দেহে জর্জরিত সেই সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল সম্প্রতি জানিয়েছেন, আগামী ১৫ আগস্টের পর ধাপে ধাপে খুলবে স্কুল। প্রথমে গ্রিন ও অরেঞ্জ জোন। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা যেমন বাড়িতে থেকে অনলাইনে ক্লাস করছে, তেমনই করবে। স্কুলে যাবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি।

ইউনিসেফের মতে, লকডাউনের সময়টা ছাত্র ও অভিভাবক, উভয়ের পক্ষেই ছিল যথেষ্ট কঠিন। এই মুহূর্তে বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশ তাদের স্কুলশিক্ষার বিষয়টিকে পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। এক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব এবং লকডাউন উঠে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। করোনা-পরবর্তী কঠিন বাস্তবতা সম্পর্কে সকলেই ওয়াকিবহাল। বাইরের পরিবেশ কোনওভাবেই ছাত্রদের জন্য আগের মতো নেই। তাই স্কুল খুলবে পরীক্ষামূলক ভাবে ও অঞ্চলভিত্তিক। স্কুল কর্তৃপক্ষকে পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টাকে গ্যারান্টিযুক্ত করতে হবে। স্কুল আরম্ভ, ছুটি, টিফিনের সময় বিশেষভাবে সাবধান থাকা দরকার। ছাত্ররা তখন এলোমেলো ঘোরাঘুরি করে। ফলে, সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে না। ওদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবা জরুরি। পরিস্থিতি তাদের সরল মনে নানা জটিল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

আরও পড়ুন: ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বললেই কাজ হয়ে যায় কি?

এবার আসা যাক তাদের কথায়, যারা বাড়িতেই অনলাইন মাধ্যমে লেখাপড়া করছে এবং করবে। এই 'করবে'টা আপাতত অনির্দিষ্টকালের। এ প্রেক্ষিতে কী ভাবছেন শিক্ষক, অভিভাবকগণ? ঘরে উঁকি দেওয়ার আগে একটু বহির্বিশ্বের খবর নেওয়া যাক। অস্ট্রেলিয়ার একজন শিক্ষাকর্মী জানান, স্কুল বন্ধ অবস্থায় শিক্ষার কাজটা চালিয়ে যাওয়া খুবই শক্ত। এমনিতেই এক একটি বিষয় পড়ানোর পদ্ধতি এক একরকম। তার মধ্যে অভিভাবকরাও প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত তুলে আনেন। নতুন নতুন সমস্যা খাড়া করেন। ইতালির এক মা তাঁর ছয় বছরের মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বেজায় ভাবিত। ওঁর কথায়, "আমার মেয়ে অত্যন্ত লাজুক। শিক্ষক ও স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ও সামনাসামনি অধিক স্বচ্ছন্দ। মনিটরের দিকে চোখ রেখে ক্লাসের বাকিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে অসুবিধা হচ্ছে ওর। ফলে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলছে আমার মেয়ে।"

বুলগেরিয়ার শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের মতে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পড়াশোনার সার্বিক সাফল্যের ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায়। সব পরিবারের হাতে উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা নেই। প্রসঙ্গত, স্পেনে রেডক্রস এক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা ক্ষুধার্ত ও গৃহহীনদের  জন্য অন্ন ও বাসস্থানের পাশাপাশি পরিবারগুলিকে ১ হাজার ট্যাবলেট কম্পিউটার ও থ্রি-জি কার্ড দিয়েছে, যাতে বাচ্চাদের লেখাপড়ার পথটিও চালু থাকে। এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশের সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে একটা নতুন দিশা দেবে আশা করা যায়।

প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা। দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় স্কুলের বিকল্প এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কতটা ফলপ্রসূ হতে পারবে বা পারছে, তাই নিয়ে সংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যেই রয়েছে সংশয়। এই জটিলতার জালে রয়েছে আমেরিকার মতো ধনী ও উন্নত রাষ্ট্রও। একজন অভিভাবক সংবাদ সংস্থাকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে জানিয়েছেন, "আমার মেয়েদের স্কুল সাইটে লগ ইন করতে কোনও কোনও দিন ৪০ মিনিট লেগে যায়। অনেক সময় শিক্ষকরাও সাইটে লগ ইন করতে হিমশিম খান। এভাবে কি লেখাপড়া সম্ভব?" জেনে নিন, এটি হলো ওখানকার নামী ব্র্যান্ডের স্কুলগুলির অন্যতম। ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, সর্বত্র এক ছবি। স্কুল খুললে ভাইরাস আতঙ্ক। আবার বাড়িতে বসে ছাত্রছাত্রীদের সঠিক মাত্রায় শিক্ষা পরিষেবা দেওয়া যাবে কিনা, তাই নিয়ে সংশয়, সন্দেহ।

আরও পড়ুন: করোনা খুলে দিক শিক্ষা পদ্ধতির নতুন অভিমুখ

আদতে মূল সামাজিক বিষয়গুলি দেশকাল ভেদে খুব বেশি তফাৎ হয় না। ইতালির এক শিক্ষক জানিয়েছেন, "আক্ষরিক অর্থেই এই ডিজিটাল পদ্ধতি আমাদের পেশাদারি ক্ষেত্রে বেশ কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। ভিডিও রেকর্ডিং, আপলোডিং, মেইলিং, এই প্রায় অচেনা পর্বগুলো এখন রোজের রুটিন। এসব অতি দ্রুত আয়ত্তে আনতে হয়েছে। কাজ অনেকটাই বেড়ে গেছে আমাদের। মনে হচ্ছে একটা পুরো দিন যেন যথেষ্ট নয়।"

প্রতিধ্বনি কলকাতার এক স্কুল শিক্ষিকার কণ্ঠে। বললেন, "যে কোনও নতুন পদ্ধতি আয়ত্তে আনাটাই সমস্যার। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পড়াতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছি।" ওঁর কথায়, বাচ্চাদেরও নতুন এই ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। এই যে স্কুলে না যাওয়া, তাতে মানসিক সংকটের অবকাশও আছে। আজকের চার দেওয়ালে বন্দি ছেলেমেয়েদের কাছে স্কুলই একমাত্র প্রাণ খুলে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। সেটা ওরা পাচ্ছে না। শিক্ষিকার স্নেহ এবং বকুনি, বন্ধুদের সাহচর্য, কোনওটাই নেই। স্কুলের নিয়মিত কার্যক্রম, সেগুলোও হচ্ছে না এখন।

তাহলে নতুন পদ্ধতির সবটাই কি নেতিবাচক? "নাহ, সেটা বলব না। বাচ্চাদের কাছে স্মার্টফোন এতদিন ছিল শুধুই গেম খেলার মাধ্যম, এখন তারা সেটাকে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজে লাগাতে শিখছে। টিচারকে স্ক্রিনে দেখে তাঁর কথা বুঝে বিষয়কে আয়ত্ত করছে। তবে, একেবারে ছোটদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সহযোগিতা একান্ত জরুরি। যদিও লকডাউন উঠে যাওয়া ও অফিস চালু হওয়ার পর ওঁদের ব্যস্ততা বেড়েছে। সেখানে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা যায়, সেটা দেখতে হবে। আদতে পুরো প্রক্রিয়াটাই সমন্বয়ের। বিজ্ঞান বা যে বিষয়গুলি প্রাকটিক্যাল ক্লাস সহ পড়ানো হয়, সেটা কী করে অনলাইনে বোঝানো যাবে, জানি না," বললেন সেন্ট জন্স ডায়াসেশন স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষিকা।

ওঁর মতে, একই কথা প্রযোজ্য মিউজিক, ফাইন আর্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। "আমাদের এখানে ইন্টারনেট পরিষেবা সব অঞ্চলে যথাযথ নয়। অভিযোগ, অনেকেই চাহিদামতো স্টাডি মেটেরিয়াল সময়ে পাচ্ছে না। সংযোগ স্থাপনেও সমস্যা আছে," যোগ করেন তিনি। এই অভিজ্ঞ শিক্ষিকার মতে, স্কুল মানে শুধু পড়াশোনা নয়, নিয়মশৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হওয়ারও একটা ক্ষেত্র। এই প্রেক্ষিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কিছু নেতিবাচক অবদানও রয়েছে। "স্মার্টফোন হাতে। ক্লাস সেভেন-এইটের ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেলেই চ্যাটে মেতে ওঠে। সেখানে কোন টিচার কেমন মেকআপ নিয়ে ভিডিও রেকর্ডিং করেছেন, কে কিভাবে কথা বলেন, সেসব নিয়ে রসিকতা শুরু করে দেয় ওরা ফাঁক পেলেই। এটা অস্বাভাবিক বলব না। তবে, লেখাপড়ায় মনোনিবেশে বাধা সৃষ্টিকারী তো বটেই।"

ওঁর থেকে আর একটু এগিয়ে বললেন শিলিগুড়ির এক গৃহশিক্ষিকা। "স্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়া ফেলে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট সাইট দেখবে, এটা ভাবতেই কেমন ভয় করে। অভিভাবকদের অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে। শাসন নয়, বুঝিয়ে বলতে হবে, এখন লেখাপড়াটাই ওদের জন্য সবথেকে জরুরি।" সামগ্রিকভাবেই ওঁর মতে অভিভাবকদের দায়িত্ব বাড়ল। অনেক বাচ্চা ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখাই ভালো বুঝতে পারে না। ভিডিও কী করে ফলো করবে? ওদের অসুবিধা নিয়ে বকুনি, তুলনা, বিদ্রুপ একবারে নয়। মা-বাবাকে বন্ধু হয়ে বোঝাতে হবে।

শিলিগুড়িরই এক তরুণী শিক্ষিকা, দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর খুদেরা তাঁর স্কুলের ছাত্র। নতুন পদ্ধতিকে স্বাগত জানাবেন তিনি, এটাই স্বাভাবিক। "প্রথমে বিষয়টা একটু চাপিয়ে দেওয়া মনে হলেও এখন সড়গড় হয়ে গেছে। বাচ্চারাও বেশ অভ্যস্ত, ওরা রীতিমতো ভিডিওর জন্য অপেক্ষা করে। এই মুহূর্তে স্কুলে যাওয়াটা ওদের জন্য যথেষ্ট বিপদজনক। তাই এই বিকল্প পদ্ধতিই ভালো। তবে, ওদের কাছে নিজেদের ফোন নেই। তাই ক্লাস, স্টাডি মেটেরিয়াল ইত্যাদির জন্য মা-বাবাকেই ট্র্যাক রাখতে হবে। আর স্কুলের মতো রুটিন নেই। তাই সকালে যে ভিডিও পাঠালাম, সেটা হয়তো কেউ বিকেলে দেখল। এটা না হলেই ভালো। তবে, আমার মনে হয়, ওদের সংযোগ স্থাপনের ক্ষমতা বাড়বে এতে। আবার বন্ধুদের কাছে না পাওয়ার ফলে কিছু সমস্যা হতে পারে। সেটাও অভিভাবকদেরই দেখতে হবে।"

কোভিড-১৯ সারা বিশ্ব জুড়েই শিক্ষাক্ষেত্রে এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে । এই বিপ্লব বা পরিবর্তন সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী, তা সময় বলবে। বিদেশের মতো এদেশেও 'স্টাডি অ্যাট হোম' বা 'হোম স্কুলিং' চালু হবে কি? সেক্ষেত্রে প্রথমেই পরিকাঠামো নিয়ে ভাবতে হবে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে। বাচ্চারা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে স্বনির্ভর ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হয়ে ওঠার একটা সুযোগ পাবে। তবে, সেটা তখনই সম্ভব যদি অভিভাবকরা নতুন চিন্তার অনুসারী হন। সারাক্ষণ 'পড় পড়' ,বলার অভ্যাস ছাড়তে হবে তাঁদের। সবার ওপরে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা! শিক্ষার পদ্ধতি যা-ই হোক, কেউ যেন তার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা দেখা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment