বন্ধ ঘরে করোনার ছায়ায় বৈশাখ পেরোলো। সেই যে সেইসব শত্তুর, যাঁরা বলেছিলেন রোদ বাড়লেই পুড়ে মরবে আরামপ্রিয় করোনা আর ভাইরাস-পোড়া ছাই গঙ্গায় ভাসিয়ে স্নান সেরে কাজে ফিরবে সুস্থ ট্রপিকাল ভারত, তাঁদের মুখে ছাই দিয়ে রোদ বৃষ্টি গায়ে মেখেই জৈষ্ঠ্যের উঠোনে পা রাখল নব করোনাভাইরাস। ক্লান্তির কোনো লক্ষণ নেই। ভারতের চেয়েও বেশি করে দক্ষিণ আমেরিকার ক্রান্তীয় এবং নিরক্ষীয় অঞ্চলের প্রখর গ্রীষ্মে দাপট অক্ষুণ্ণ রেখেছে COVID-19 অতিমারী। ব্রাজিলে শুরু হয়েছে গণকবরের ব্যবস্থা। উষ্ণ অ্যামাজন থেকে শীতলতর ভোল্গা, সব নদীর কিনারে মানুষের গ্রাম শহর গিলে ফেলছে অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাস।
মারণ ক্ষমতা তার খুব বেশি না হলেও আতঙ্ক জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট। তবে তার প্রকৃত শক্তি হলো সবরকম পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, নিজেকে বদলে ফেলার ক্ষমতা, আর ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা। গালে হাত দিয়ে ভাবতে ভাবতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও শেষ পর্যন্ত জানিয়েছে যে ও যাবার জন্য আসেনি, থাকতে এসেছে। পৃথিবী কি শুধু মানুষের জন্যে? আমাদের গ্রহ এখন করোনারও বসতভিটা। এখানে থাকতে হলে তার পাশে পাশেই আমাদের থাকতে হবে।
এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি, যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এ এক সন্ধিক্ষণ। এই মুহূর্তে কোন পথে আমরা পা বাড়াব, তার ওপর নির্ভর করবে শেষ পর্যন্ত (অথবা শেষের কথা যদি ছেড়েও দিই তবে নিদেনপক্ষে কিছুদিন পর) কোথায় আমরা পৌঁছাব। অথচ এই মুহূর্তে কোনো একদিকে পা বাড়ানো বড় সহজ কাজ নয়। ব্যক্তির পক্ষেও নয়, সরকারের পক্ষেও নয়। যে কোনো একদিকে এগোনোর পর ফল যা হবে, কিছুদিন পেরোলে সেই পথ নির্বাচনের সমালোচনা করা পেশাদার সমালোচকদের পক্ষে যত সহজ হবে, এই মুহূর্তে পথ বেছে নেওয়া তেমন সহজ নয়।
আরও পড়ুন: বিশ্ব-স্বাস্থ্য, সুস্থ বিশ্ব
পুবমুখো গেলে বাঘে খাবে আর পশ্চিমে হাঁটলে পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আবার কোনো একদিকে না এগোলেও নয়। জগৎ হল কিনা গম্ ধাতু ক্বিপ প্রত্যয়, অর্থাৎ সদাসঞ্চরমান। স্থিতাবস্থা বজায় রেখে এখানে বেঁচে থাকার জো নেই। অগত্যা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে এবং বেছে নিতে হবে কোনো এক চলার পথ। রবিবার ১৭ মে ভারতের তৃতীয় দফার লক ডাউনের মেয়াদ শেষ। আজ থেকে শুরু পরবর্তী পর্যায়ের পথ চলা। লকডাউন শিথিল করা বা না করার সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। উপায় নেই করোনা যুদ্ধে থেমে থাকার বা দু'দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার। উপায় নেই এই অনাহূত অতিথিকে বিদায় দেওয়ারও।
একদল বিদ্বান প্রথম থেকেই বলছিলেন যে লকডাউন একটি অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। তাঁদের কারো কারো মতে, অসুখটি সামান্য। যেখানে অবজ্ঞা করলেই চুকে যায়, সেখানে এত কামান দাগার প্রয়োজন কী? তাঁদের যুক্তি আগে এক পর্বে খণ্ডন করা হয়েছে, তাই আর শব্দক্ষয় করব না। COVID-19 মোকাবিলায় লকডাউন জাতীয় সামাজিক ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পরীক্ষা করা দরকার, নইলে শুধু লকডাউনে যথেষ্ট কাজ হবে না… এই মর্মে কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র এবং সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সেসব কথাকে অংশত উদ্ধৃত করে এবং অংশত উল্লখ না করে অনেকে বলেছেন যে সেখানে নাকি লেখা আছে লকডাউনের আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই।
অতীতে মাও জে দং-এর বক্তব্যকে এরকম সামান্য মোচড় দিয়ে কেউ কেউ বলেছিলেন বা ভেবেছিলেন, বন্দুকের নল থেকেই নাকি মানব মুক্তির জন্ম হয়। এসব ছোটখাটো বোঝার ভুলের সামাজিক বা রাজনৈতিক অভিঘাত ছোট মাপের নাও হতে পারে। যেসব দেশ শুধুমাত্র টেস্টের ভরসায় থেকে তাড়াতাড়ি লকডাউন শিথিল করতে চেষ্টা করেছে, তারা নতুন করে করোনার থাবায় আহত। সুতরাং এই বিষয়ে শেষ কথা বলে ফেলার জায়গায় আমরা পৌঁছইনি এখনো।
আরও পড়ুন: চিকিৎসক ও সমাজ – মহামারীর দ্বিপ্রহরে
লকডাউনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিটা ছিল 'হার্ড ইমিউনিটি'র তত্ত্ব। বায়ুবাহিত এবং শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটানো ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বটি মূল্যবান। জনসংখ্যার অন্তত ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ একটি ভাইরাসের দ্বারা সংক্রামিত হলে এবং মরে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে শারীরিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে সমগ্র জনগোষ্ঠীটি সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে একরকম গোষ্ঠীগত প্রতিরোধ লাভ করবে এবং জীবাণুটি সেই জনগোষ্ঠীতে আর ছড়াতে বা রোগ সৃষ্টি করতে পারবে না। এই তত্ত্বের সমর্থকেরা বলছিলেন যে যত তাড়াতাড়ি ৮০ শতাংশ মানুষ সংক্রামিত হন, ততই ভালো। নইলে অকারণে মহামারীর সময়কাল প্রলম্বিত হবে।
এই যুক্তিটি আপাত সঠিক হলেও এর কিছু ফাঁকফোকর আছে। এঁরা তাড়াতাড়ি 'হার্ড ইমিউনিটি' গড়ে তোলার স্বার্থে সবরকম সামাজিক দূরত্ব-বিধি তুলে দিয়ে এই সময়টুকুর জন্যে শুধুমাত্র অতি-বয়স্কদের আড়াল করে রাখার কথা বলছিলেন। বাস্তবে ভারতের মতো বেশিরভাগ দেশে এইভাবে বয়স্কদের আড়াল করা অসম্ভব। বয়স্ক মানুষেরা অল্পবয়সীদের সঙ্গে মিলেমিশে একই পরিবারে থাকেন। যুবকেরা সংক্রামিত হলে পরিবারের বৃদ্ধেরাও সংক্রামিত হবেন এবং মারা যাবেন। হার্ড ইমিউনিটি তাত্ত্বিকরা এবং অর্থনীতিকে সচল রাখাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া তাত্ত্বিকেরা আসলে এঁদের মৃত্যু মেনে নেওয়ার কথাই বলছিলেন, কিন্তু শ্রুতিকটু বলে একটু আড়াল রেখে বলছিলেন। আমাদের মতো পরিবার-কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে এজাতীয় কথা শুধু শ্রুতিকটু নয়, মর্মান্তিক। পথটি আমাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া যুবক-যুবতীদের মধ্যে মৃত্যুর হার কম হলেও ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়সে অনেকেরই মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
খুব কম মারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ভাইরাসের ক্ষেত্রে 'হার্ড ইমিউনিটি'র তত্ত্ব যতটা গ্রহণযোগ্য, তিন-চার শতাংশ মৃত্যুহার সম্পন্ন অসুখের ক্ষেত্রে তেমন নয়। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ মানুষ যদি সংক্রামিত হন এবং তার মধ্যে তিন শতাংশের মৃত্যু হয়, তবে ভারতে তিন কোটি এবং বিশ্বে ১৫ থেকে ২০ কোটি মানুষ অল্পদিনের মধ্যে একটিমাত্র ব্যাধিতে মারা যাবেন। এমন ব্যাপক হারে সকলকে অসুস্থ হতে দিলে রোগীর চাপ নিতে না পেরে স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়বে এবং তার ফলে অন্যান্য রোগের মৃত্যুহারও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। ফলে এক বছরের মধ্যে ১০০ কোটি মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এতকিছু হতে দেওয়ার পর যদি দেখা যায় যে ভাইরাসটি দ্রুত নিজের গঠন পরিবর্তন (mutation) করার ফলে হার্ড ইমিউনিটি বিশেষ কাজে লাগছে না? তখন এই মৃত নগরী নিয়ে কী করবেন রাজা ইদিপাস? এসব ভাবনা সম্ভবত এড়িয়ে গেছেন হার্ড ইমিউনিটি-র প্রবক্তারা।
আরও পড়ুন: হার্ড ইমিউনিটিই কি অনিবার্যতা?
অগত্যা কার্যকর ওষুধ আর প্রতিষেধক আবিষ্কারের ভরসায় দিন গোনা আর সাময়িকভাবে নানারকম ঢাল ব্যবহার করে সময় কেনা। এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে নব্বুই শতাংশ ছাপোষা মানুষে ছাওয়া পৃথিবী? অবশ্য সেই কাজটাও সহজ নয়। সঠিক পদ্ধতি মেনে নতুন প্রতিষেধক বা ওষুধ তৈরির কাজ করলে, তা বাজারে আসতে বছর দেড়েক লাগবে সর্বাধিক দ্রুততার সঙ্গে কাজ এগোলেও। প্রক্রিয়াটির জটিলতার সম্পূর্ণ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, পরে চেষ্টা করা যাবে।
আপাতত ভাবার বিষয় হল, করোনাভাইরাস যদি ঋতুচক্রের খেলায় হেরে অন্তত সাময়িকভাবে কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে যেত, তবে আমরা খানিক গুছিয়ে নেওয়ার অবসর পেতাম। যদি সেটুকু অবসরও সে না দেয়, তবে এই দেড়-দুই বছর একটানা কীভাবে দুর্গ সামলাব আমরা? টানা দুই বছর লকডাউন? তাও কখনো সম্ভব? বিশ্বের ধনীতম দেশগুলোর পক্ষেও অতদিন বিনা উৎপাদনে, বিনা বাণিজ্যে সব নাগরিককে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা কঠিন, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে তো একপ্রকার অসম্ভব। ইতোমধ্যে অর্থনীতি চাপে পড়ে গেছে প্রবলভাবে। দরিদ্র জনসাধারণের জীবন সঙ্কটাপন্ন।
তাহলে এবার আমরা কী করব? পুরোদমে ফিরে যাব কাজে? চালু করব কারখানা, বাণিজ্য, স্কুল, সবকিছু? ফিরে যাব আপাত স্বাভাবিক জীবনে? এই আপাত স্বাভাবিকতার আড়ালে লুকোনো থাকবে এক নিষ্ঠুর অস্বাভাবিকতা। লুকোনো থাকবে বহু প্রিয়জনের মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার পরাজয়। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ কি তবে পেটের দায়ে এক ভাইরাসের কাছে পরাজয় মেনে নেবে? আমরা কি নতজানু হয়ে বলব, "আমরা ছেড়ে দিলাম আমাদের মা-বাবাদের, হয়ত স্বামী-সন্তানদেরও। তাঁদের নিয়ে যাও। আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম আর অর্থনৈতিক বেঁচে থাকাটুকু ফেরত চাই।" আমরা কি বিকিয়ে দেব আমাদের অবশিষ্ট সামাজিক পারিবারিক মূল্যবোধটুকুও?
এই পরাজয় মেনে নেওয়াও সহজ নয়। একটাই পথ। ইতিহাসে কখনো হয়নি, এমন এক মানব-সংহতি নির্মাণ। ভেদাভেদ ভুলে, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে, এমনকি অর্থনৈতিক লাভালাভের হিসেব ভুলে সকলে মিলে অসামান্য দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উৎপাদনমুখী কাজগুলো চালু করে, অল্পে সন্তুষ্ট থেকে এই দেড়-দু'বছর দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে দুর্গটিকে টিকিয়ে রাখা। তেমন লড়াই সম্ভবত এই ভাইরাসকে হারাতে পারবে। হয়ত আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবার ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করে দেবার কাজটাও শুরু হবে এই লড়াই থেকেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন