Advertisment

করোনার রাজনীতিটা কি নিতান্তই জরুরি?

দেশের মানুষের দুর্দশা যখন চরমে তখন তার মোকাবিলা করার চেয়েও বড় লক্ষ্য হলো ভোট। ভোটের রাজনীতির বাইরে বোধহয় আমরা যেতেই পারব না।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus india politics

রবিবার সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন এবং প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। ছবি: প্রেমনাথ পাণ্ডে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ডিএল রায়ের 'শাহজাহান' নাটকে ঔরঙ্গজেব মহম্মদকে বলেছিলেন, "পুত্র, রাজনীতি বড় কূট।" সত‍্যিই রাজনীতি যে কতটা কূট, তা আজ করোনা আক্রান্ত ভারতবর্ষে দেখছি। আমার একটা মস্ত বড় সমস্যা হলো, আমি কোনও একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে আস্থা রাখতে পারি না। তাই আমার মনে হয় যে দল বা যে নেতার যা ভালো তাকে ভালো বলব, যা খারাপ লাগবে তাকে খারাপ বলব। এ তো সাংবাদিক বৈঠক বা রাজনেতার ব্রিফিং কভার করা নয়। আমার যা মনে হয়, সেই অভিমতই জানাব।

Advertisment

করোনার রাজনীতি দেখে মনে হচ্ছে, এ যেন রাজনীতিকেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত করেছে। এর আগের বেশ কিছু রচনায় বারবার আশা করেছিলাম যদি আমরা এই দুর্যোগে ক্ষুদ্র রাজনীতি ভুলে করোনার মত এক ভয়াবহ অসুখের মোকাবিলায় সক্রিয় হই। বারবার বলছি বটে, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের ডিএনএ-তে এত সহজে বদল বোধহয় আনব না। তাই আমাদের আত্মীয়-স্বজন পরিজনের মৃত্যু হচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকরা রাস্তায় হাঁটছেন তো হাঁটছেন, তাঁদের দুর্দশা দেখছি। রেল লাইনে চাপা পড়ছেন, রাস্তায় ট্রাকের ধাক্কায় মারা যাচ্ছেন। আর আমরা এখনও ব‍্যস্ত তু-তু ম‍্যায়-ম‍্যায় রাজনীতি নিয়ে। এ তোমার করোনা, আমার করোনা নয়।

আরও পড়ুন: ঈদ হোক বা পুজো, করোনা আতঙ্কে উৎসব বিমুখ দুই বাংলাই

আর এখন তো নরেন্দ্র মোদীর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের পর নির্মলা সীতারমনের ধারাবাহিক ব‍্যাখ‍্যা শুনে মনে হচ্ছে, সরকার আর একটা বাজেট ঘোষণা করেছে, আর বিরোধীরা সঙ্গে সঙ্গে তার সমালোচনা করে দিয়েছে। যেদিন প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে আর্থিক প‍্যাকেজের কথা ঘোষণা করলেন, সেদিন তিনি কিন্তু এই প্রস্তাবগুচ্ছ সবিস্তারে জানাননি। পরদিন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন সব জানাবেন, যাকে বলে 'মাইক্রো ডিটেলস্', এমনটাই কথা ছিল।

কিন্তু সেদিন গুজরাতের এক কংগ্রেস নেতা অতি উৎসাহে টুইট করে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন জানিয়ে বসেন, এমনকি আনন্দ শর্মার মত নেতাও আর্থিক প্রস্তাবকে সমর্থন করে বসেন। কংগ্রেস সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনায় রাহুল গান্ধী খুব চটে যান। তাঁর বক্তব্য ছিল, নির্মলা সীতারমনের সাংবাদিক বৈঠক হওয়ার আগে যে যা বলেছেন তা ব‍্যক্তিগত অভিমত হতে পারে, পার্টির বক্তব্য নয়। তারপর পার্টির বক্তব্য হিসেবে যা বলা হলো, তার সবটাই তীব্র সমালোচনামূলক। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে বিরোধীদের কাজ হল বিরোধিতা করা। দেশের মানুষের দুর্দশা যখন চরমে তখন তার মোকাবিলা করার চেয়েও বড় লক্ষ্য হলো ভোট। ভোটের রাজনীতির বাইরে বোধহয় আমরা যেতেই পারব না।

ছাত্রজীবনে রাজনীতি আর ভোটের রাজনীতির ফারাক শিখিয়েছিলেন মাস্টারমশাই। অধ্যাপক সত‍্যব্রত চক্রবর্তী বলতেন, রাজনীতি সর্বত্রগামী। রান্নাঘরেও রাজনীতি আছে। কিন্তু দলীয় রাজনীতি আর রাজনীতি তো এক নয়। রাজনীতি একটা মানবিক আচরণ। আমার রাগ। আমার আবেগ। আমার বাসনা কামনা সব নিয়েই আমার রাজনৈতিক আবরণ। লালুপ্রসাদ যাদব একবার বলেছিলেন, "আমাদের দেশের রাজনীতিতেও বহুত পলিটিক্স হ‍্যায়।"

আরও পড়ুন: করোনার নিয়ম তো অনেক, মানা হবে কি?

প্রধানমন্ত্রী আর্থিক প‍্যাকেজ ঘোষনা করেছেন। গরীব কৃষকদের ধার দেওয়ার সহজ ব‍্যবস্থা করা হচ্ছে। ছোট ছোট গৃহ নির্মাণের জন্য ব‍্যাঙ্ক ঋণ দেবে সহজ কিস্তিতে। এসবই তো ভালো। এখন যা অবস্থা, তা কিন্তু তিরিশের দশকের আর্থিক সঙ্কটের চেয়েও বেশি জটিল। কারণ আজ এটা কিন্তু নিছক বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট নয়, এ এক ভয়াবহ ভাইরাস সংক্রমণ। তাই অর্থনৈতিক দাওয়াই দেওয়ার আগে আবিষ্কার করতে হবে করোনার প্রতিষেধক।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ ঘোষণা করেছেন তাকে সমর্থন এই জন্য জানানো প্রয়োজন, এর উদ্দেশ্য এই আর্থিক সঙ্কট থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা। আজ যদি মোদীর জায়গায় অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হতেন, ধরুন মনমোহন সিং বা নরসিমহা রাও, তবে তিনিও এ কাজ করতেন। একথা সত‍্য, এখন দেখার বিষয়, এই সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবে স্থানীয় প্রশাসনে কীভাবে বাস্তবায়িত হয়। একজন চাষী বা ছোট ব‍্যবসায়ী ব‍্যাঙ্কে ঋণ নিতে গেলে তা সত‍্যি সত‍্যি কতটা সহজ হবে? করোনার সময়েও দেখা যাচ্ছে এক নতুন ধরনের আমলাতন্ত্র জেলায় জেলায় মাথা চাড়া দিয়েছে। হাসপাতালগুলিতে রোগী ভর্তি করার সমস্যা করোনার আগে জেলায় জেলায় যেমনটি ছিল ঠিক তেমনটাই কি এরপরও থাকবে?

আসলে আমরা তো ঘরপোড়া গরু। বেঙ্গল প‍্যাকেজ বাজপেয়ীর কাছ থেকে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার টাকা কোথা থেকে আসবে, এ নিয়ে প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন বাজপেয়ী-আডবানী। তখন প্রমোদ মহাজনের বুদ্ধি ছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জন‍্য স্থিরীকৃত সমস্ত প্রকল্পের সমস্ত বরাদ্দীকৃত অর্থকে যোগ করে একটা মোট সংখ্যা বানানো। তারপর সেই মোট অঙ্কটাই হয়ে যাবে বেঙ্গল প‍্যাকেজ। ব্রিগেড প‍্যারেড গ্ৰাউন্ডে এসে প্রমোদ মহাজন বেঙ্গল প‍্যাকেজ ঘোষনা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও ফাঁকি দিল। পরে মমতাই সেই এনডিএ থেকে বেরিয়ে এলেন।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, পরিসংখ্যান বা 'স্ট‍্যাটিসটিকস' হলো অসত‍্যের 'সুপারলেটিভ ডিগ্ৰি', চরমতম পর্যায়। আশা করি মোদীর প্রস্তাবগুচ্ছে এই ছলচাতুরি থাকবে না। ইতিমধ্যে এই ছলচাতুরি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। মনে আছে, প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। বাংলার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত নিয়মিত শূন্য ঘাটতির বাজেট পেশ করতেন। প্রণববাবুর সঙ্গে অসীমবাবুর এই যোজনা বরাদ্দ নিয়ে কম বির্তক হয়নি। যোজনা কমিশনের অফিসারেরা বলতেন, রাজ‍্যের ঘাটতি যে তিমিরে সে তিমিরেই। প্রত‍্যেক বছর রাজ‍্য এসে যে যোজনা বরাদ্দর রিপোর্ট দিতেন, তাতে ধরে নেওয়া হত অমুক অমুক খাতে রাজ‍্যের কাছে টাকা আসবে।

এমনকি স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের টাকাও আয় হিসেবে দেখাত রাজ‍্য। এর পরের বছর আবার ঘাটতি থাকত, এবং নতুন নতুন আয়ের উৎস দেখিয়ে আবার ঘাটতি শূন্য বাজেট দেখানো হতো। অসীমবাবু অবশ্য প্রণববাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, এতে কোনও ভুল নেই। এ অর্থনীতির একটা পক্রিয়া। ভর্তুকির প্রাসঙ্গিকতা আমেরিকাতেও অনেক বেশি। কেন্দ্রকেও তাই টাকা দিতে হবে।

আরও পড়ুন: ‘বিসি’ ও ‘এসি’, করোনার বাজারে অর্থহীন অর্থনীতি

আমি অর্থনীতিবিদ নই। অতীতের কাসুন্দি এজন্য ঘাঁটলাম যে, এই রাজনৈতিক বিবাদ, কেন্দ্র-রাজ‍্য বিবাদ আমাদের কাছে নতুন নয়। আজ করোনা সঙ্কটে সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নয়, তাই শুধু ভোটের কথা ভেবে কী দিল্লি কী রাজ‍্য, শুধু করোনা মোকাবিলায় মানুষ কীভাবে আমাকে, আমার দলকে, আমার সরকারকে নিচ্ছে সেটাই কি একমাত্র অগ্ৰাধিকার? পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যাটা মোদীর সমস্যা বা মমতার সমস্যা, এভাবে বোধহয় না দেখাই ভালো। তাই উচিত হবে সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে আগে করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।

বিষ্ণুপুরাণে আছে, বিষ্ণু মহামায়াকে বোঝাচ্ছেন যে, রাত এজন্য সৃষ্টি করেছি যাতে দিনের গুরুত্ব মানুষ বোঝে। অসত্য ও অধর্ম আছে বলেই সত্য বা ধর্মের স্বরূপ বোঝা যায়। পদ্মনাভ এভাবেই অসত‍্যের উপর সত‍্যের জয়। পুরাণ কাহিনী মানুষেরই রচিত সাহিত্য। আজও এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে আমরা আলোর সন্ধানে ব্রতী।

স্বাধীনতার সত্তর বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও আজ দেখছি হাসপাতালগুলির কী অবস্থা। চিকিৎসক নেই। নার্স নেই। বিছানা নেই। করোনা আক্রান্ত মানুষকে কোয়ারান্টিনে রাখার জন্য যথেষ্ট ঘর, যথেষ্ট ব‍্যবস্থা নেই। প্রশ্নটা মোদীর ছ'বছর বা মমতার ন'বছর নয়, আমি তো বলব ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার এত বছর পরও জেলায় জেলায় গ্ৰামে গ্ৰামে যে স্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে উঠল না, তার দায় আমাদেরও। মানুষেরও। গণতন্ত্রে রাজনেতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে মানুষ। ঐক্যবদ্ধ থেকে আমরা রাজশক্তিকে তা করতে বাধ্য করতে

পারলাম কই?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment