Advertisment

দুই পক্ষকাল পরে

প্রকৃতির নিজের পাঠানো তীব্র ভয়াল সতর্কবাণীকে কি সত্যি গ্রহণ করবে বাকি বিশ্ব? সভ্য মানুষ কি বদল আনবে নিজের বেঁচে থাকার ধরনধারণে?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lockdown nature

করোনাঘটিত ‘লকডাউন’এর আড়ে বৃহৎ পুঁজি নিজের চূড়ান্ত সংকট থেকে ত্রাণ পেল- বিনা অজুহাতে

কেমন একটা মনে হচ্ছে এই লকডাউনের আগেকার পৃথিবীর সংগে পরের পৃথিবীর যেন আর কোনো মিল থাকবে না। যেন থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে যেমন এক থাকে নি মানবসমাজ! একলা আমার নয়, ক্যালিফর্নিয়া থেকে কলম্বো- প্রায় সর্বত্র কিছু মানুষের নিজের নিজের মত করে মনে হচ্ছে এরকম কথা যে প্রাকৃতিক নিয়মের বিশৃঙ্খলাকে একটা চূড়ান্ত জায়গায় এনে ফেলা হয়েছে, এরপর এই পথে আর এগোনো যাবে না। পাহাড়ে কখনো কখনো যেমন হয়, মোড় ঘোরা অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়, কুয়াশায় অন্ধ গাড়ি খাদের নিচে পড়ে।

Advertisment

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক ছিল তা অস্বাভাবিক হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে প্রকৃতি খুব স্পষ্ট করে দুটি ভিন্নপথের চেহারা দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। মাত্র এই দুই পক্ষকালের প্রকাশ্য মনুষ্য-হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়ায় প্রকৃতির যতোখানি সুস্থ হয়ে ওঠার চেহারা দেখা যাচ্ছে, সেই নীল আকাশ, পরিষ্কার বাতাস, মাত্র ক’দিনের মধ্যে মাঠভর্তি ঘাস, অসংখ্য পাখি- শোনা যাচ্ছে নদীপুকুরে পরিষ্কার জলের উপকথা – প্রকৃতির বার্তা স্পষ্ট। এখনও সময় আছে, কঠিন হলেও এখনও খোলা আছে সুস্থতায় ফেরার পথ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যা দেখা যাচ্ছে, এ প্রকৃত সুস্থতা নয়, এখনো চেষ্টায় কী হতে পারে, তার সংকেত, বা বলা ভাল ট্রেলার মাত্র। স্থায়ী নয়। এখনো একে স্থায়ী করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি।

বিশ্ব-স্বাস্থ্য, সুস্থ বিশ্ব

অতি-উৎপাদনের নামে পৃথিবীর সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে দ্রুত ধ্বংস করে ফেলার বদলে হিসেব করে খরচ করার যে গৃহস্থালী সংস্কৃতি, যাকে আজ বলা হচ্ছে সুস্থায়িত্ব বা সাস্টেনেবিলিটি, বেঁচে থাকার যে ধরণ কয়েকহাজার বছর ধরে মানবসভ্যতা নামে পরিচিত হয়ে এসেছে, তার কাছাকাছি ফিরে যাবার রাস্তা সংকীর্ণ হলেও খোলা আছে এখনও। গত কয়েক দশক ধরে অসংখ্য মাননীয় বিজ্ঞানীর সাবধানবাণী, পরিবেশ কর্মীদের এমনকি ছাত্রছাত্রীদেরও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের চেষ্টা অগ্রাহ্য করে বৃহৎ পুঁজি সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মকে তছনছ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশাল, জটিল ও সুদূরবিস্তারী  প্রাকৃতিক নিয়মগুলোর একেবারে গোড়ার জায়গা লঙ্ঘন করে চলেছে অল্প কিছু মানুষের যুক্তিহীন লোভের অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম।

বহুকাল ধরে প্রকৃতির এই অবস্থার মধ্যে থেকেই মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বস্তু উৎপাদন করেছে, ব্যবহার করেছে- ভূমি জল নদী পর্বত আকাশবাতাস কারো কিছু স্থায়ী ক্ষতি ঘটে নি। মাত্র গত দুশো আড়াইশ’ বছরের অগ্রগমনে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যসকল সংকটাপন্ন আর মানুষের প্রধান যে সম্পদ ছিল তার বুদ্ধি আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সেইগুলো হয়ে উঠেছে উদ্বৃত্ত। একথা আজ মোটেই গোপন নয় যে করোনাঘটিত ‘লকডাউন’এর আড়ে বৃহৎ পুঁজি নিজের চূড়ান্ত সংকট থেকে ত্রাণ পেল- বিনা অজুহাতে, বিনা ক্ষতিপূরণে শত শত কারখানা বন্ধ করে দেওয়া গেল। আমাদের এই দেশেই কাজ হারালেন কয়েক কোটি মানুষ। তাদের পরিবারগুলি ঝরে গেল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভাবনার উৎকর্ষ, খেয়েপরে বেঁচে থাকার ন্যূনতম নাগরিক অধিকার, মানবিক মর্যাদায় জীবন ধারণের সাংবিধানিক অধিকার থেকে। এই অধিকারচ্যূত মানবসংখ্যার দায় বহন করবে কে ? দেশের স্বাভাবিক জীবনযাপনের যে আপাত চেহারা টিকে আছে, তাকে রক্ষা করা যাবে তো আশু ধাক্কার মুখ থেকে? ক্ষিদের চেয়ে বড় কোনো অস্ত্রবল কি দেখেছে ইতিহাস? উন্নয়ন? কিসের মূল্যে কোন উন্নতির কথা ভাবছি আমরা?

পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক

রক্ষা কি করা যাবে পৃথিবীর আজকের এই প্রসন্ন মুখটুকুও? স্বাভাবিক পথে উপার্জন করে সহজজীবন যাপনের কথা কি ভাবা যায় না? যেখানে কোটি কোটি মানুষকে নিজের জীবিকার সাধন হারিয়ে বাধ্য হয়ে দূরদেশে যেতে না হয়? ভয়াবহ সংকটের মধ্যে শত শত মাইল পায়ে হেঁটে অনাহারে অসহায় ফিরতে না হয় কাজ হারিয়ে? যেই পৃথিবী থেকে আমরা বিকট কোন অসুখের ত্রাস ছাড়া সহজভাবেই যেতে পারি, প্রাকৃতিক অবসানের নিয়মে কিন্তু জেনে যেতে পারি যে পরের প্রজন্মের কাছে রইল আমার অভিজ্ঞতার, শ্রমের অর্জিত এক প্রসন্ন জীবন।

যদি ক্ষমতা এতখানি অন্ধ হয়, যদি হয় এতখানি ভবিষ্যত দৃষ্টিহীন, তাহলে হয়ত সে চলবে আবার এতদিনের সর্বনাশা পথেই, প্রকৃতির সাবধানবাণীকে অগ্রাহ্য করে। সে পথেরও একটি ছবির কথা মনে আসে। বিশেষত যখন দেখি ‘নিরাপত্তা’র জন্য নিজের মুখচ্ছবির প্রতি একান্ত ভালোবাসাও এত সহজেই হারাতে রাজি অনেক মানুষ। এঁরা ভাবছেন না- কিসের থেকে নিরাপত্তা! যেমন বলতেন বুড়োমানুষরা- বুড়ো আঙুলটাকে চোখের সামনে তুলে ধরলে সূর্যকেও আড়াল করে, এই মুহূর্তের একটি ত্রাসের সামনে অতীত-ভবিষ্যত সব  অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে না তো আমাদের কাছে? নিজের বারে বারে মনে পড়ছে একটি ফিল্মের কথা। আকিরা কুরোসাওয়ার শেষ ছবি ড্রীমস-এর একটি পর্বের কথা।

আকিরোা কুরোসাওয়া এক প্রাজ্ঞ শিল্পী। অত্যন্ত শক্তিমান চিত্রশিল্পী হিসাবে সম্মানিত মানুষটির এক সময়ে মনে হয় যা কিছু প্রকাশ করতে চান  রঙে তা হচ্ছে না, চিত্রজীবন সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে তিনি সরে আসেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। ক্লাসিক সব ছবি করার পর এক সময়ে প্রাণ ঢেলে কুরোসাওয়া তৈরি করেন তাঁর চূড়ান্ত ছবিটি, আশ্চর্য নিরলংকার, প্রায় উপকথার গল্পের ধরণে তৈরি যে ছবিকে চিত্রবিদরা অনেকেই বলেছেন কুরোসাওয়ার জীবনবেদ – সে এই ছবি, ড্রীমস। বাল্যবয়সে হিরোশিমা প্রত্যক্ষ করেছিলেন কুরোসাওয়া। একটা জীবন হয়ত যথেষ্ট নয় সেই অভিজ্ঞতা ভোলবার পক্ষে। দশটি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত ‘ড্রীমস’ ছবির সাত থেকে নয় পর্বের উপজীব্য ছিল নানাভাবে এই হিংস্রতা-নির্ভর ‘উন্নত’ পৃথিবীর সমাজে মানুষের ভবিষ্যত নিয়ে তাঁর ভাবনা।

ফিরব বললে ফেরা যায় নাকি! – কোভিড দুনিয়ার বাস্তব

নয় নম্বর ছবিতে দর্শক দেখেন ঊষর, ভূদৃশ্যহীন এক পৃথিবী। সেইখানে বসে আছে মুখাবয়বহীন একজন মানুষ, অমানুষী আর্তনাদে সে কাঁদছে। বলছে তার আতঙ্কের কথা- কোন খাবার নেই আর, অবশিষ্ট মানুষেরা নিজেদের মধ্যে দুর্বলতর জনদের খাচ্ছে, সে যে অনাহারে ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে। এইখানে শেষ করেন নি কুরোসাওয়া। হয়ত কোন শিল্পীই শেষ করতে পারেন না এখানে। এই দুঃস্বপ্নেরও পরে তিনি এঁকেছেন এক অন্য জীবন, প্রসন্ন সহজ জীবনের স্বপ্ন।

তারও পরে চলে গেছে অনেকদিন। কুরোসাওয়ার নিজের দেশও গ্রাহ্য করে নি তাঁর সতর্কবাণী। বড়ো বেশি দাম দিয়ে তাকে খানিক সংযম শিখতে হয়েছে। প্রকৃতির নিজের পাঠানো তীব্র ভয়াল সতর্কবাণীকে কি সত্যি গ্রহণ করবে বাকি বিশ্ব? সভ্য মানুষ কি বদল আনবে নিজের বেঁচে থাকার ধরনধারণে?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

COVID-19 Jol Mati
Advertisment